২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা

-

‘কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়, ভালো উৎপাদনে উত্তম পুষ্টি সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন’ বিশ^ খাদ্য দিবস-২০২২-এর প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল এটি। কৃষি মন্ত্রণালয় ও জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) উদ্যোগে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালন করা হয়। করোনা পরবর্তী চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ^ব্যাপী মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির মধ্যে খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিষয়টি নিয়ে দেশ-বিদেশে আলোচনা, গবেষণা, পর্যালোচনা চলছে। কারণ, খাদ্য সঙ্কট নিয়ে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিলে তা নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবেলা করা যে কতটা দুরূহ ও কঠিন হবে সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।
খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উন্নত পরিবেশ, উন্নত জীবন সুন্দর ও টেকসই পরিবেশ সুরক্ষায় পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাবার প্রয়োজন। বর্তমান বিশ^ পরিস্থিতিতে আমাদের জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে মানবিক বিপর্যয়সহ নানা ধরনের সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হবে। তাই উন্নত জীবন, উত্তম পুষ্টি, পরিবেশ সুরক্ষা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কৃষি ও কৃষি উৎপাদনের বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান এখনো ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। আমাদের দেশের উর্বর মাটি, কৃষি ও খাদ্যশস্য উৎপাদনের অনুকূল। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের অনুকূল পরিবেশ রয়েছে এ দেশে। শুধু ধান ও গম উৎপাদনে নয়, মাছ, সবজি, পশুপালন, গোশত উৎপাদন, আলু উৎপাদন, নানা ধরনের ফল, সবজিসহ পোলট্র্রি খাতেও উৎপাদনে বাংলাদেশে অনুকূল পরিবেশ রয়েছে। এসব খাতে উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের তথ্য থেকে দেখা যায়, ধান উৎপাদন, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশে^র তৃতীয়, ইলিশ উৎপাদনে প্রথম, মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয়, ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ ও ছাগলের গোশত উৎপাদনে সপ্তম অবস্থান রয়েছে। পোলট্রি ও ডিম উৎপাদন মানুষের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বার্ষিক ডিম উৎপাদন এক হাজার ৭০০ কোটি। কলা চাষেও বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। ইদানীং স্ট্রবেরি, ড্রাগন ও পেয়ারার ভালো ফলন হচ্ছে। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশে^র সপ্তম এবং বছরে এ দেশে আলু উৎপাদন হয় এক কোটি ১০ লাখ টন।

পুষ্টিকর খাদ্য দুধ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে দুধ উৎপাদন হয় এক কোটি ৬৮ লাখ টন। গোশত উৎপাদন হয় ৭৬ টন। উৎপাদনের এ অবস্থান আরো বৃদ্ধি ও গতিশীল করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যকর পদক্ষেপ এবং প্রয়োজনীয় আর্থিক, কারিগরি সহযোগিতা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত না রাখলে সঙ্কট আরো ভয়াবহ হতে পারে। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশে^র অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ হলেও দেশে চালের উৎপাদন বাড়েনি। বিশেষজ্ঞরা আগামী বছর খাদ্য সঙ্কটের যে আভাস দিয়েছেন সেটি মোকাবেলা করতে হলে চালের মজুদ বাড়াতে হবে। ধান উৎপাদনসহ কৃষিসামগ্রী ও শাক-সবজি উৎপাদন বাড়াতে হবে। মৎস্য উৎপাদনও বাড়াতে হবে। এদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সঙ্কট খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে। বর্তমানে বিশ^ব্যাপী খাদ্য উৎপাদন কমতির দিকে। এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশে ব্যাপকভাবে খাদ্যঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক তথ্য থেকে জানা যায়, বাইরে থেকে সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলে আগামী বছরগুলোতে খাদ্য ঘাটতি বড় সঙ্কটের আকার নেবে। মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা এসব দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নামও রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীও খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দিতে বলেছেন।
আমাদের যে প্রচুর আবাদি জমি আছে তা সঠিক ব্যবহারের পাশাপাশি অনাবাদি জমি আবাদযোগ্য করে উৎপাদন কাজে লাগাতে হবে। কৃষি এখনো আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে যাতে কৃষি ও কৃষক সুরক্ষা পায় সেদিকে জোর নজর দিতে হবে। কৃষি থেকে আসে শিল্পের কাঁচামাল। কৃষি উৎপাদন বিঘিœত হলে খাদ্য সঙ্কট ও শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হয়। বর্তমানে বিশ^ব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানি সঙ্কট আরো গভীর হতে পারে। দীর্ঘদিন জ্বালানি সঙ্কট থাকলে খাদ্য উৎপাদন ও শিল্পোৎপাদনসহ অর্থনৈতিক বিভিন্ন খাতের সঙ্কট তৈরি হবে।

বিশ^ব্যাংক বলেছে, সঙ্কুুচিত মুদ্রার মান বিশ^ব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানি সঙ্কটকে আরো গভীর করতে পারে। বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি সঙ্কুচিত মান খাদ্য ও জ্বালানির দাম এমনভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে তা খাদ্য ও জ্বালানি সঙ্কটকে আরো গভীর করতে পারে। জ্বালানি পণ্যের উচ্চমূল্য যা কৃষি উৎপাদন ইনপুট হিসেবে কাজ করে খাদ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যদি আরো দীর্ঘ দিন চলমান থাকে, তাহলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার চ্যালেঞ্জকে দীর্ঘায়িত করতে পারে। কৃষকরা কৃষিপণ্যের মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে পান না। কৃষিতে মুনাফা কম হওয়ায় নতুন প্রজন্ম এ খাতে আসতে চায় না। এ পেশার গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। বেশির ভাগ মানুষ কৃষিকে পেশা হিসেবে নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না। কৃষকরা তাদের সন্তানদের এই পেশায় আনতে উৎসাহী নন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় কৃষিপণ্যের মূল্য সংযোজন ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত। এ খাতে কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। কৃষক প্রয়োজনীয় সার, বীজ ও কীটনাশক ব্যবহার করে যেন লাভের মুখ দেখতে পায়, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। কৃষি খাতে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সঙ্কট দূর করতে হবে। কৃষিঋণ সহজলভ্য করাসহ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য মাঠপর্যায়ে তদারকি বাড়াতে হবে। কৃষি পেশায় লোকবলের সঙ্কট দেখা দিলে উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে খাদ্য সঙ্কট আরো তীব্রতর হবে। খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।

বিবিএস সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে মোট ফসলি জমির পরিমাণ এক কোটি ৫৪ লাখ ৩৮ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮৫ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর। সেচের আওতায় ৭৪ লাখ ৪৮ হাজার হেক্টর, পতিত দুই লাখ ২৩ হাজার, এক ফসলি জমি ২২ লাখ ৫০ হাজার, দুই ফসলি জমি ৩৯ লাখ ১৪ হাজার ও তিন ফসলি জমির পরিমাণ ১৭ লাখ ৬৩ হাজার হেক্টর।
কৃষি গবেষকদের মতে, দেশে যে বিশাল আবাদযোগ্য জমি রয়েছে তা যদি পরিকল্পিতভাবে খাদ্যশস্য উৎপাদনে ব্যবহার করা হয় তাহলে বৈশি^ক এ মন্দাতেও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষির অবদান আরো বাড়ানো সম্ভব। কৃষির জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো সার।
শিল্প করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, দেশে মোট ইউরিয়া সারের চাহিদা ২৮ লাখ টনের বেশি। এর মধ্যে দেশে উৎপাদন হয় ১০ লাখ টন, বাকিটা আমদানি করতে হচ্ছে। বেশি দামে সার আমদানি করে কম দামে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। যদিও কৃষি খাতে এ ভর্তুকি কতটা কৃষকরা পান তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
দেশের প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান দিতে ফল-ফলাদি, মাছ, গোশত, দুধ, ডিম, গম ও ভুট্টা উৎপাদনের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। ডিম ও মুরগি সরবরাহের অন্যতম পোলট্রি খাতের উন্নয়ন ও বাজার ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত। কৃষির উন্নয়ন, কৃষকের উন্নয়ন ও এ খাতের শ্রমিকদের কথাও ভাবতে হবে। কৃষদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উচিত। আধুনিক কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। উন্নত বাজারব্যবস্থা গঠনের মাধ্যমে কৃষিসামগ্রী, সবজি, ফলমূলকে জনগণের মধ্যে সহজলভ্য করতে হবে। দেশে কর্মসংস্থান সঙ্কট দূরীকরণে কৃষি পেশাকে বিকল্প পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে।
সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে কৃষি প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ সহজীকরণ ও সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে কৃষিতে আগ্রহী করতে হবে। কৃষি খাতে চলমান সঙ্কট ও প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে তার সমাধানের ব্যবস্থা করলে উৎপাদনকে আগের তুলনায় কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে মূল্যস্ফীতিও ক্রমান্বয়ে কমে আসবে।
ইমেইল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement