আত্মশক্তি বিকাশের বলয়
- ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
- ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০
বর্তমান সময় ও সমাজে সর্বত্র জড়বাদের জয়জয়কার। সর্বত্র এর পরিব্যাপ্তি। দেশসেবা, সমাজসেবা, সংসার ও অন্যের সেবার মূলে এখন নানাবিধ স্বার্থ নিহিত। প্রযুক্তি প্রসারের সুবাদে বৈশ্বিক ও মুক্ত অর্থনীতির আঙিনায় পুঁজিবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় দৈহিক উপভোগ যেন মানবের চরম ও পরম লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। আধ্যাত্মিকতার অনাবিল আনন্দ ও খোদাপ্রেমে অর্জিত মনের অপার ঐশ্বর্য জড়বাদের জাগতিক স্বার্থচিন্তার কাছে অপাঙ্ক্তেয় ও অপ্রাসঙ্গিক প্রতীয়মান হচ্ছে। অথচ যে পরমাত্মার থেকে নিজ নিজ মানবাত্মার আবির্ভাব ও বিচরণ সেই পরমাত্মার জ্ঞানলাভ, সেই পরমাত্মার প্রেমে মশগুল বা বিভোর হয়ে প্রেমময়ে আত্মসমর্পণের মধ্যে মানবজীবনের চরম লক্ষ্য ও পরম সার্থকতা। পরমাত্মা জ্ঞানের তিনটি মার্গ- জ্ঞানমার্গ, কর্মমার্গ ও প্রেমমার্গ। দার্শনিক জ্ঞান দিয়ে ঐশী জ্ঞান, কর্মপুরুষ সুকর্মসাধনা দিয়ে ও প্রেমিক আত্মজ্ঞান বিসর্জন দিয়ে প্রেমময়ে আত্মসমর্পণ করে। প্রেমময়ের সন্তুষ্টি সাধন যার জীবনের একমাত্র ব্রত তার প্রেম স্বজন, স্বশ্রেণী এমনকি মানবজাতির প্রেমের পরিধি পেরিয়ে পুরো বিশ্বে বিস্তৃত। সে মাশুক। প্রত্যেক সৃষ্ট বস্তুর প্রতি সমভাবে আকৃষ্ট হয় সে, মানুষ, কীট-পতঙ্গ সব কিছুর সাথে একাত্মবোধ করে, নির্জীবের মধ্যেও অস্তিত্ব অনুভূত হয়, সে কোনো কিছুর মধ্যে পার্থক্য বোধ করে না, জড় ও অজড়ে প্রেমময়ের কৃপা বা এহসান লক্ষ করে সে সর্বত্র তার পরিবেষ্টন অনুভব করে। ভূমণ্ডল পেরিয়ে নভো ও পাতালমণ্ডলে এমনকি পরলোকেও তার প্রেম প্রলম্বিত হয়। এ অবস্থায় তার নিজের আমিত্বের জ্ঞান লোপ পায়, আত্মহারা হয়ে সেখানে শুধু প্রেমময়ের জ্ঞান ও তার অস্তিত্বকেই অনুভব করে।
দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে একজন মানুষ। দেহ পার্থিব, রূহ বা আত্মা স্বর্গীয়। দেহ মাটির তৈরি আর আত্মা পরমাত্মা থেকে আগত। দেহ অস্থায়ী, দুনিয়ায় আসার আগে অর্থাৎ জন্মের আগে সে ছিল না এবং মৃত্যুর সাথে এই দেহের অবসান ঘটে। অন্য দিকে আত্মা স্থায়ী। জন্মের আগে ও মৃত্যুর পরও আত্মা বর্তমান। মর্তজাত দেহের মধ্যে যে আত্মার অধিবাস সে স্বর্গজাত (অর্থাৎ মূল) আত্মারই প্রতিবিম্ব, মর্তজাত রূহ নামে পরিচিত। দেহ খাঁচার ভেতর এই অচিন পাখির বাস। দেহ পিঞ্জিরার মধ্যে সে নিত্য আসা-যাওয়া করে। স্বর্গজাত মূল রুহের সাথে তার যোগাযোগ, মুরলী বাঁশির সুর তাকে টানে মূলের প্রতি। কিন্তু দৈহিক কামনা-বাসনা, প্রবৃত্তির দাসত্বের কারণে মর্ত্যজাত রূহে পড়ে কলঙ্কের নানান দাগ, ফলে মরিচা ধরা সে আরশিতে স্বর্গজাত রূহের প্রতিবিম্ব পড়ে না। পরমাত্মার সাথে মিলনের সুযোগে ঘটে বিপত্তি। হেড কোয়ার্টারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে মাঠকর্মীরা যেমন দিশেহারা হয়ে পড়ে, পাপের কলঙ্কে মরিচা ধরা মর্ত্যজাত রূহের অবস্থা দেহপিঞ্জিরায় তেমন অবস্থায় আপতিত হয়।
ধর্ম আর কর্মের মধ্যে সংযোগ সাধন হওয়া প্রয়োজন। চিন্তা থেকে কাজের উৎপত্তি। যেমন ভাবনা তেমনই তার বাস্তবায়ন। মনের মধ্যে বাস করে এক কর্মবিধায়ক তার আবাস অবগাহনের সুতা গাঁথা আরেক সূত্রে। ভাববাদীরা যাকে বলে- আদিবাস তার আরশে মোয়াল্লায়, সেখানে সে থাকে প্রভু নিরঞ্জনের নিরন্তর তত্ত্বাবধানে। আর এ দিকে তার ছায়া ‘(মানবদেহের) খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’ হয়ে বারবার আসা-যাওয়া করে, তার পায়ে বেড়ি দেয়ার প্রয়াস চললেও তাকে বাঁধা যায় না। কেননা, তার মূল সুখ বাঁধা আছে আরশে মোয়াল্লায়। তার প্রতিফলন ঘটে, আট কুঠরি নয় দরজার মধ্যে, অচিন এই পাখিটির পিঞ্জিরায়। মুরলী বাঁশির সুর শুনে সে শুধু লাফায়। নিত্য যোগাযোগ তার সাথে। কিন্তু সে যোগাযোগের অবকাঠামো অনুধাবনে সবার সম্বিত সমান যায় না। আয়নায় মরিচা ধরলে প্রতিফলন পরিস্ফুট হয় না- আয়না পরিষ্কার থাকা চাই, রাখা চাই। মরমি সাধকরা তাদের আয়না পরিষ্কার রাখতে তৎপর। আর দশজনের চেয়ে তাদের যোগাযোগের জ্যোতি ও গতিমাত্রা অনেক বেশি।
মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (১২০৭-১২৭৩) বলেছেন, ‘আমি অনেক মানুষ দেখেছি যাদের শরীরে কোনো পোশাক নেই, আমি অনেক পোশাক দেখেছি যেগুলোর ভেতর কোনো মানুষ নেই।’ সুফিকুল শিরোমণির এই তীক্ষ পর্যবেক্ষণ মানুষের মধ্যে আত্মবিকাশের শক্তি তথা মনুষ্যত্বের অনুসন্ধানের ফলাফল। মানবতার দর্শন। আজকের লক্ষ কোটি সাধারণ জনগণ, গণপ্রজাতন্ত্রী দেশের গণতান্ত্রিক সরকার, রাষ্ট্র্রনায়ক, চৌকস কর্মী, বিরোধী দল, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, ধর্ম প্রবক্তা- এই মানুষের মধ্যে সেই মানুষের খোঁজে যখন হয়রান হতে হয়, অন্তর্ভেদী বেদনার অবয়বে তখন বেজে ওঠে রবীন্দ্রনাথের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের বাণী ও সুর। জাতীয় কবি কাজী নজরুলের আত্মিক সাধনায় নিমগ্ন (খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে) না হলে যেমন নিজেকে চেনা যায় না- আকুতি জাগে না আত্মিক উন্নয়নের তেমনি মানুষের মধ্যে ‘মানুষ’ না থাকলে পোশাকি মানুষের স্বরূপ উন্মোচিত হয় না- স্বরূপের মধ্যে অপরূপের সন্ধান মেলে না। টিএস এলিয়টের ‘রাইম অব দ্য এনশিয়েন্ট মেরিনার’ এর মধ্যেও আত্মসমালোচনা ও শাস্তিভোগের (কুলক্ষণ মনে করে নিরপরাধ আলবাট্রস পাখিকে হত্যার পর অথৈ সাগরের লক্ষ কোটি বারিবিন্দুর মধ্যে পান করার মতো এক ফোঁটা পানি না পাওয়া) মধ্যে, নিরস্ত্র রাজা ডানকানকে ঘুমের মধ্যে তার নিরাপত্তাবিধায়ক স্বয়ং সেনাপ্রধান ম্যাকবেথ তার স্ত্রীর প্ররোচনায় হত্যার পর ম্যাকবেথ দম্পতি যেমন আজীবন আর ঘুমাতে পারেনি (Macbeth has killed the sleep so he will not sleep any more) এ মর্মযাতনার অনুভবের আয়নায় মনুষ্যত্বের জয়-পরাজয়ের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়। সহস্রজনকে কাঁদিয়ে গঙ্গা কেন বয়ে চলছে, লক্ষ কোটি ভারতবাসীকে সে কেন জাগিয়ে তোলে না- এ প্রশ্ন তো আত্মবিকাশের আকিঞ্চন অকাক্সক্ষারই প্রতিধ্বনি।
‘সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ সেই মানুষ তার সত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে পেছাচ্ছে বা এগোচ্ছে তা তার কর্মযজ্ঞ যোজনার মধ্যে প্রকাশ পায়। ‘মোমবাতি হওয়া সহজ কাজ নয়, আলো দেয়ার জন্য প্রথমে নিজেকেই পুড়তে হয়’ মাওলানা রুমির এ পর্যবেক্ষণে মানুষের মধ্যে মানবতাবোধ জাগানোর জন্য আত্মবিশ্লেষণ ও বিচারের সাধনায় নিবেদিত হওয়ার শিক্ষা রয়েছে। ‘যদি তুমি চাঁদের প্রত্যাশা করো, তবে রাত থেকে লুকিয়ো না, যদি তুমি একটি গোলাপ আশা করো, তবে তার কাঁটা থেকে পালিয়ো না, যদি তুমি প্রেমের প্রত্যাশা করো, তবে আপন সত্তা থেকে হারিও না’। এ উপদেশবাণীর মধ্যেই নিহিত রয়েছে সাবধান সতর্কতার প্রলেপ ‘সব কিছু জেনে ফেলাই জ্ঞান নয়, জ্ঞান হলো কী কী এড়িয়ে যেতে হবে বা বর্জন করতে হবে তা জানা।’
মাওলানা রুমি মানবতাবোধের উদ্বোধন প্রত্যাশা করে বলেছিলেন, ‘সুন্দর ও উত্তম দিন তোমার কাছে আসবে না; বরং তোমারই এমন দিনের দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত।’ আত্মিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে মানুষকে মনুষ্যত্ব বিকাশের সাধনায় নিবেদিত হতে হবে। তার আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে রুমির সেই উক্তি- ‘তোমার জন্ম হয়েছে পাখা নিয়ে, উড়ার ক্ষমতা তোমার আছে। তারপরও খোঁড়া হয়ে আছো কেন। তোমার হৃদয়ে যদি আলো থাকে, তাহলে ঘরে ফেরার পথ তুমি অবশ্যই খুঁজে পাবে।’ কিংবা ‘গতকাল আমি বুদ্ধিমান ছিলাম, তাই পৃথিবীকে বদলে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আজ আমি জ্ঞানী, তাই নিজেকে বদলে ফেলতে চাই।’ রুমি একাধারে আরো বলেছেন, ‘তুমি সাগরে এক বিন্দু পানি নও। তুমি এক বিন্দু পানিতে গোটা এক সাগর।’ নিজের দিকে নিজে তাকানোর, আল্লামা ইকবালের, ‘আপকা দুনইয়া আপ পয়দা কর’ এর মধ্যেও খুঁজে পাই প্রেরণা, অন্যের জীবনের গল্প শুনে সন্তুষ্ট হয়ো না, নিজের পথ তৈরি করো, নিজের জীবন সাজাও। আকাশ কেবল হৃদয় দিয়েই ছোঁয়া যায়। নতুন কিছু তৈরি করো, নতুন কিছু বলো, তাহলে পৃথিবীটা হবে নতুন। যে বাতাস গাছ উপড়ে ফেলে, সে বাতাসেই ঘাসেরা দোলে, বড় হওয়ার দম্ভ কখনো করো না। প্রকৃতির বিধান এই যে, গাছ দম্ভভরে বড় হয়, ঝড় তাকে উপড়ে ফেলে। অর্থনীতিতে টেকসই হওয়ার অন্যতম শর্ত হলো সবাইকে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে আত্মস্থ করা, সব অগ্রগতি সমানতালে না এগোলে বৈষম্য পরিবেশে ছন্দপতনের খেসারত অনিবার্য হয়ে ওঠে।
লেখক : কলাম লেখক, ভাববাদী
অর্থনীতির বিশ্লেষক
mazid.muhammad@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা