২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সৌদি-ইরান সম্পর্ক : কতটা উন্নয়ন সম্ভব

অবলোকন
-

মুসলিম বিশ্বের দুই শক্তিধর দেশ সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরে সম্পর্ক উন্নয়নের আলোচনা চলছে। কয়েকদিন আগে ইরাকে এর চতুর্থ রাউন্ড সম্পন্ন হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের অধিবেশন চলাকালে যুক্তরাষ্ট্রেও একদফা আলোচনার খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু কি সব বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, এই আলোচনায় কতটুকু অগ্রগতি হচ্ছে এর কোনো কিছুই জানানো হয়নি কোনো পক্ষ থেকে। তবে দু’পক্ষই আলোচনার কথা স্বীকার করছেন। এই আলোচনা এখনো আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক পর্যায়ে শুরু হয়নি। শীর্ষ নীতিনির্ধারক পর্যায়ে হবে হয়তো আরো পরে।
জটিল সম্পর্কের বিষয়গুলো নিয়ে বিবদমান দু’টি দেশ যেভাবে ব্যাক চ্যানেলে আলোচনা সম্পন্ন করে আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে প্রবেশ করে সৌদি আরব-ইরানের ক্ষেত্রেও আলোচনা সেই পর্যায়েই রয়েছে। সম্ভবত দু’দেশের গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা এই আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন যার সাথে সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কেউ কেউ জড়িত থাকার কথা জানা যাচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্যের দুই শক্তি
সৌদি আরব ও ইরান মুসলিম বিশ্বের একেবারে বিপরীত ধারার দুটি শীর্ষ দেশ। সৌদি আরব ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি রক্ষণশীল সুন্নি পরম রাজতন্ত্র, যার সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ঐতিহ্য রয়েছে। আধুনিক ইরান ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি টুয়েলভার শিয়া সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। কিন্তু ১৯৭৯ সালে দেশটি একটি বিপ্লবী ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়, যার মধ্যে এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা রয়েছে যা একজন ‘সর্বোচ্চ নেতা’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। একটি ধর্মতান্ত্রিক ব্যবস্থার তত্ত্বাবধানে রাষ্ট্রপতি শাসিত গণতন্ত্রের উপাদান রয়েছে এখানে। উভয় দেশ প্রধান তেল ও গ্যাস রফতানিকারক এবং জ্বালানি নীতি নিয়ে বিবাদমুখর অবস্থায় থাকে।
ওয়াহাবি ধারার শীর্ষ আলেম ও ধর্মবেত্তারা শর্তসাপেক্ষে সৌদি রাজতন্ত্রকে সমর্থন দেন। রাজপরিবারের মধ্যে শাসক মনোনীত হলেও আমির হিসেবে বাদশাহ বাইয়াত গ্রহণের মাধ্যমে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। ধর্মীয় নেতা আর রাজপরিবারের মধ্যে সমঝোতার অংশ হিসেবে সৌদি সরকার ধর্ম প্রচারের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন এবং অভ্যন্তরীণভাবে ইসলামী অনুশাসন চালু করেছিলেন। সাম্প্রতিক কয়েক বছরের ব্যতিক্রম বাদ দেয়া হলে সৌদি শাসক ও ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে এই সমঝোতা সবসময় বজায় ছিল।
অন্য দিকে ইরান হলো শীর্ষ শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ। ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের আগ পর্যন্ত চালু থাকা রাজতন্ত্র আমলে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের সাথে ধর্মের বিষয়ে একটি দূরত্ব বজায় রাখা হতো। আয়াতুল্লাহ খোমেনি বিপ্লবের পর সেই ধারা পাল্টে একটি ধর্মাশ্রয়ী গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করেন। যেখানে রাষ্ট্র পরিচালনায় শিয়া ধর্মমতের প্রাধান্য থাকে। তবে অনুশাসনের ক্ষেত্রে ইসলামের মৌলিক বিধি বিধানগুলো পর্যায়ক্রমে ইরানে চালু করা হয়েছে।
সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে শিয়া-সুন্নি ধর্মগত বিশ্বাসের ব্যবধান ছাড়াও কৌশলগত কিছু বিরোধ রয়েছে। এ বিরোধের সূত্রপাত ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে শুরু হয়ে তা গভীরতর হয় দশককালব্যাপী ইরাক-ইরান যুদ্ধ, সৌদি আরবে ইরানি হজযাত্রীদের নিয়ে গোলযোগ, শিয়া জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য ও অন্যায্যভাবে শিয়া আলেমকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার অভিযোগ এবং সর্বশেষ ইয়েমেনে দু’দেশের মধ্যে রক্তক্ষয়ী প্রক্সিযুদ্ধ।
রাজনৈতিক মতাদর্শ ও শাসনব্যবস্থার পার্থক্যও উভয় দেশকে বিভক্ত করেছে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ইসলামী আইনবিদদের অভিভাবকত্বের নীতির ওপর ভিত্তি করে, যা মনে করে যে একজন ফকিহর (ইসলামী আইনবিদ) তাদের শাসনব্যবস্থাসহ সব মুসলমানের ওপর তত্ত্বাবধায়ক হওয়া উচিত। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা একজন শিয়া ফকিহ। ইরানি বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি মতাদর্শগতভাবে রাজতন্ত্রের বিরোধী ছিলেন, যাকে তিনি ইসলামী নীতির পরিপন্থী বলে বিশ্বাস করতেন। অন্য দিকে, সৌদি আরবের রাজতন্ত্র রক্ষণশীল এবং এর ধর্মীয় নেতারা দীর্ঘদিন ধরে রাজতন্ত্রকে সমর্থন করে আসছেন যেখানে রাজাকে পরম আনুগত্য দেয়া হয় যতক্ষণ না তিনি ইসলামী শরিয়া আইন লঙ্ঘন করেন। তবে সৌদি আরবের একটি শিয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রয়েছে যারা এর বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য সম্পর্কে তিক্ত অভিযোগ করে এবং যারা মাঝে মধ্যে বাদশাহকে উৎখাত করার আহ্বান জানায়। উভয় দেশই প্রধান তেল রফতানিকারক কিন্তু জ্বালানিনীতি নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত। সৌদি আরবের বৃহৎ তেলের মজুদ এবং ছোট জনসংখ্যার সাথে, বৈশ্বিক তেলের বাজারের ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি এবং মাঝারি দামের প্রণোদনা দেয়ার প্রতি আরো বেশি আগ্রহ রয়েছে। বিপরীতে, ইরান স্বল্প মেয়াদে উচ্চমূল্যের ওপর ফোকাস করতে বাধ্য হয়।
সৌদি আরব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ষাট বছরেরও বেশি সময় ধরে কৌশলগত মিত্র। সৌদি আরব নিজেকে শীতলযুদ্ধ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সঙ্ঘাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় এবং উদার অংশীদার হিসেবে দেখে। ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত, মোহাম্মদ রেজা পাহলভির অধীনে ইরানও কমিউনিস্ট-বিরোধী শিবিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ছিল। ২০০৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সৌদি আরব সফরকালে এই সম্পর্ককে আবার নিশ্চিত করে। যদিও সৌদিদেরকে সবসময় আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতি থেকে বিশেষ করে ইরানের ব্যাপারে নিজেদের কিছুটা দূরে সরিয়ে রাখতে দেখা যায়।
সৌদি ইরান বিরোধ ও সঙ্ঘাতে কোনো পক্ষই হয়তো চূড়ান্তভাবে লাভবান হচ্ছে না। যাতে তৃতীয় একটি পক্ষ তার কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে লাভবান হচ্ছে। এই উপলব্ধি দু’দেশের কোনো কোনো প্রভাবশালী নীতিনির্ধারকের মধ্যে এর আগেও এসেছিল। কিন্তু ক্ষমতাধররা শেষ পর্যন্ত সেই পথে কার্যকরভাবে অগ্রসর হয়নি। এবার এ ক্ষেত্রে কার্যকর অগ্রগতির কিছু সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।

সম্পর্কে ভাঙন
সর্বশেষ ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে সৌদি আরব শিয়া ধর্মগুরু শেখ নিমর আল-নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর তেহরানে সৌদি দূতাবাসে হামলা হয়। এই হামলাকে কেন্দ্র করে ইরান ও সৌদি কূটনৈতিক সম্পর্ক একেবারে ভেঙে পড়ে। ইসলামের ব্যাখ্যা, ইসলামী বিশ্বের নেতৃত্বের আকাক্সক্ষা, তেল রফতানিনীতি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক ইত্যাদি বেশ কয়েকটি ভূরাজনৈতিক বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে টানাপড়েন আগে থেকেই চলে আসছে।
ইরান সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে আসাদ সরকারকে সামরিক এবং অর্থনৈতিকভাবে সমর্থন করেছে। আর এ সময় সৌদি আরব বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সাহায্যের ক্ষেত্রে প্রধান সরবরাহকারী ছিল। উভয় দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে সমর্থনের অভিযোগ করে। উভয়েই তাদের অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে।
এমনকি যখন ইসরাইলের সাথে তার শত্রুতাপূর্ণ বৈদেশিক নীতির জন্য ইরানের সাবেক রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আহমাদিনেজাদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সমালোচনা ছিল, তখন সৌদি আরব উল্লেখ করে যে ইরান একটি সম্ভাব্য হুমকি এবং একটি আঞ্চলিক শক্তি যা তাদের সীমানার মধ্যে সমস্যা তৈরির অবস্থানে রয়েছে। সময়ের সাথে সৌদি আরবের নিরাপত্তার জন্য তার ভৌগোলিক প্রতিবেশী বিশেষ করে ইরানের সাথে সুসম্পর্কের প্রয়োজনের বিষয়টি উপলব্ধি করে। অবশ্য ইরানের বিরুদ্ধে নিরাপত্তার জন্য সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য থেকে গুটিয়ে নেয়ার সঙ্কেত সৌদি আরবের ইরানের সাথে সমঝোতার প্রয়োজনকে আরো বৃদ্ধি করেছে বলে মনে হয়।
দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক বাড়ানোর উদ্যোগ এর আগেও বিভিন্ন সময় নেয়া হয়েছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ ১৯৮০ সালে ইরানের বিপ্লবী উচ্চাকাক্সক্ষা প্রতিহত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) প্রথম বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন ২০০৭ সালে। ইরানের প্রেসিডেন্টের এই সফর সম্পর্কের সম্ভাব্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এই বৈঠকের পরপরই আহমদিনেজাদকে মক্কায় বার্ষিক হজে অংশ নিতে সৌদি আরবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু সম্পর্ক উন্নয়নের এই প্রয়াস বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
১১ অক্টোবর ২০১১ তারিখে মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল এরিক হোল্ডার ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি-আরবের তদানন্তীন রাষ্ট্রদূত আদেল আল-জুবায়েরকে হত্যার পরিকল্পনার অভিযোগ আনেন। ২০১৩ সালে, ব্রিটেনে সৌদি রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ বিন নওয়াফ বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি সম্পাদকীয় লিখেন। এতে সিরিয়া ও ইরানের বিরুদ্ধে যথেষ্ট সাহসী পদক্ষেপ না নেয়ার জন্য পশ্চিমা মিত্রদের সমালোচনা করা হয়। এভাবে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান সৌদি আরবের সম্পর্ক উন্নয়নের একটি উদ্যোগ বিফলে যায়।
শেখ নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে। এই অবস্থাতেও দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা চলে। ২০১৬ সালে, পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এবং সেনাপ্রধান রাহিল শরিফ সৌদি আরব থেকে ইসলামাবাদে উচ্চপর্যায়ের সফরের পর রিয়াদ ও তেহরান সফর করেন। পাকিস্তানের তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা ইমরান খান ইরান ও সৌদি আরবের দূতাবাস পরিদর্শন করেন এবং তাদের অবস্থান বোঝার জন্য ৮ জানুয়ারি ২০১৬ তারিখে ইসলামাবাদে তাদের কমিশনের প্রধানের সাথে দেখা করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ইরান ও সৌদি আরবের প্রতিনিধিদের মধ্যে বাগদাদে চারটি এবং নিউ ইয়র্কে একটি বৈঠক হয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই বৈঠকগুলো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখবে বলে মনে হচ্ছে যা ২০১৬ সাল থেকে একবারে স্থবির ছিল। নতুন করে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং কূটনৈতিক স্বস্তির পথও সুগম করবে।

দ্বন্দ্বের পটভূমি ও সমাধানের উদ্যোগ
প্রথমত, তাদের মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলমান দ্বন্দ্ব ধর্মীয় পার্থক্যের কারণে বেড়ে যায়। তারা প্রত্যেকেই ইসলামের দু’টি প্রধান শাখার একটি অনুসরণ করে। ইরান মূলত শিয়া মুসলিম, অন্য দিকে সৌদি আরব নিজেকে সুন্নি মুসলিমশক্তি হিসেবে দেখে। ঐতিহাসিকভাবে, সৌদি আরব, একটি রাজতন্ত্র এবং ইসলামের জন্মস্থান, নিজেকে মুসলিমবিশ্বের নেতা হিসেবে দেখে আসছে। তবে ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামী বিপ্লব হওয়ার পর এটিকে চ্যালেঞ্জ করা হয়। এই বিপ্লবের মাধ্যমে এই অঞ্চলে একটি নতুন ধরনের রাষ্ট্র তৈরি হয় যার নিজস্ব সীমানার বাইরে এই মডেলটি রফতানির একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য ছিল।
দ্বিতীয়ত, আঞ্চলিক শীতল যুদ্ধের অংশ হিসেবে সৌদি আরব এবং ইরান আঞ্চলিক আধিপত্যের জন্য এক ভয়ঙ্কর লড়াইয়ে যুক্ত দীর্ঘ সময় ধরে। আরব বিশ্বজুড়ে বিদ্রোহ (২০১১ সালে আরব বসন্তের পরে) সমগ্র অঞ্চলজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। ইরান ও সৌদি আরব তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য এই উত্থানগুলোকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে, যা বিশেষভাবে সিরিয়া, বাহরাইন এবং ইয়েমেনে পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস আরো বাড়িয়ে দেয়। তা ছাড়া, সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যকার দ্বন্দ্ব আরো বাড়িয়ে তুলতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মতো বহিরাগত শক্তিও বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে।
তৃতীয়ত, ইরান এবং সৌদি আরব সরাসরি যুদ্ধ করছে না কিন্তু তারা এই অঞ্চলের চারপাশে বিভিন্ন প্রক্সিযুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ এবং মিলিশিয়াদের সমর্থনের মাধ্যমে জড়িত হয়ে আছে। উদাহরণস্বরূপ, সৌদি সীমান্তবর্তী দেশ ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের কথা উল্লেখ করা যায়। এই ধরনের গোষ্ঠীগুলো যত বেশি সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে এই অঞ্চলে তত বেশি অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে। সৌদি আরব ইরানের বিরুদ্ধে হুথিদের সমর্থনের অভিযোগ করে।
ইরান সৌদি আরব সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণের উদ্যোগের পেছনে নানা কারণ রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো সৌদি আরবের ভিশন-২০৩০ কৌশলের বাস্তবায়ন। দেশটি তেলনির্ভর অবস্থা থেকে শিল্প বাণিজ্য ও পর্যটননির্ভর অর্থনীতি তৈরি করতে চায়। যার আওতায় দেশের অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা, পর্যটন এবং পুনঃনবায়নযোগ্য জ্বালানির মধ্যে লক্ষ্যযুক্ত সংস্কারের পরিকল্পনা নেয়া হয়। কোভিড-১৯-এর প্রেক্ষাপটে সৌদি আরব বুঝতে পারে যে বড় ধরনের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য ইরানের সাথে ডি-এস্কেলেশন প্রয়োজন বিশেষভাবে।
আঞ্চলিক ফ্রন্টে সমঝোতাও সম্পর্ক উন্নয়নের অন্যতম লক্ষ্য। বর্তমান সঙ্ঘাত চলতে থাকার অর্থ হলো যেকোনো সময় সৌদি সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতায় আঘাত আসা। ইয়েমেনে হুথিদের ওপর যেমন সৌদি বিমান হামলা চালানো হচ্ছে। তেমনিভাবে ইয়েমেন থেকে হুথিদের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র রিয়াদ পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। দেশটির অতি গুরুত্বপূর্ণ তেল স্থাপনাও তা থেকে মুক্ত থাকছে না। এই অবস্থায় দুই শক্তির মধ্যে সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই।
এই অঞ্চল থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের আগমন এবং আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহার আর সে সাথে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বেশি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার অর্থ হলো সৌদি নিরাপত্তায় আগের মতো আমেরিকান সমর্থন পাওয়া যাবে না। ট্রাম্প প্রশাসন চেয়েছিল সৌদি আরবের সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে রিয়াদের নিরাপত্তায় ইহুদি দেশটি প্রয়োজনীয় সমর্থন দেবে। ট্রাম্প নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় সেই হিসাব নিকাশ আর থাকেনি। ফলে মার্কিন-ইসরাইলের ওপর নির্ভরশীল নিরাপত্তার চিন্তা ঝুঁকিপূর্ণই থেকে যায়। ইরানের প্রতি সৌদি আরবের অবস্থান নরম করার এটি একটি কারণ হতে পারে।
এই উপলব্ধি থেকে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে দূরত্ব কমাতে আঞ্চলিকভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ দেখা যায়। সিরিয়ার ক্ষমতাসীন বাশার আসাদকে আরব লিগে প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায়ও সৌদি আরব জড়িত। ইরান এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে এর নানা ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্কের উষ্ণতা ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন সমস্যা মোকাবেলায় একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। একই সাথে তেলের বাজারের স্থিতিশীলতা আসার সম্ভাবনা রয়েছে এতে। ইরান এবং সৌদি আরব তাদের অর্থনীতিতে স্থিতিশীল তেলের দামের মধ্যে একটি সাধারণ স্বার্থ ভাগ করে নিতে পারবে। দুই বড় তেল উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ সব উৎপাদনকারী দেশের জন্য স্থির তেলের রাজস্ব নিশ্চিত করবে এবং উভয়ের অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকারীদের কাছে আরো নির্ভরযোগ্য পূর্বাভাস হাজির করবে।
ইরান-সৌদি আরব সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে হলে ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে। সে ক্ষেত্রে রিয়াদ ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞাকে আর সমর্থন করবে না। ইরানের ইয়েমেনে যুদ্ধবিরতিকে প্রকাশ্যে সমর্থন করে যুদ্ধ বন্ধে তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা একটি সঙ্কেত তৈরি করতে পারে।

বরফ গলছে কতটা
সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে বরফের সম্পর্ক গলছে এবং এটি নতুন করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার দিকে নিয়ে যেতে পারে দু’দেশকে। বাস্তবিকভাবে, দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন এই বৃহত্তর অঞ্চলে বার্তা পাঠাবে যে ইরান একটি আঞ্চলিক শক্তি যার সাথে আমাদের লড়াই করতে হবে। এই মন্তব্য করেছেন লন্ডনভিত্তিক থিংকট্যাংক চ্যাথাম হাউজের মধ্যপ্রাচ্য উত্তর আফ্রিকা প্রোগ্রামের ডেপুটি ডিরেক্টর সানাম ভাকিল।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাইদ খতিবজাদেহ এই মাসের শুরুর দিকে বলেছিলেন যে ইরানি ও সৌদি আলোচকদের এখন পর্যন্ত চার দফা ‘ধারাবাহিক’ আলোচনা হয়েছে, যদিও উভয় পক্ষ তা গোপন রাখতে রাজি হয়েছিল। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমিরাবদুল্লাহিয়ান বলেছেন, আলোচনা সঠিক পথে চলছে। একজন ইরানি বাণিজ্য কর্মকর্তা আরো একধাপ এগিয়ে বলেন, এটি এমনকি সৌদি আরবে ইরানি ব্যবসায়ীদের জন্য বাণিজ্যের সুযোগ দিতে পারে। ফ্রান্স ২৪ টিভির পর্যবেক্ষণ অনুসারে অবশ্য, পাঁচ বছরের ফাটল এবং গত কয়েক দশকের পারস্পরিক সন্দেহ নিরাময়ে ইতিবাচক সঙ্কেতের চেয়ে বেশি কিছু লাগবে। এজেন্সি ফ্রান্স- প্রেস সংবাদ সংস্থা, নাম প্রকাশ না করা ফরাসি কূটনীতিককে উদ্ধৃত করে বলেছে যে, সৌদি আরব তেহরানের সাথে তার ব্যয়বহুল বিরোধের অবসান ঘটাতে চায়। এর মধ্যে পক্ষগুলো কনস্যুলার অফিসগুলো আবার চালু করতে সম্মত হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির রয়েছে নানা ধরনের জটিল সমীকরণ। এখানকার বড় আঞ্চলিক খেলোয়াড় হলো ইসরাইল। দেশটির অনুসৃত কৌশলের অন্যতম প্রধান দিক হলো প্রতিবেশী মুসলিম দেশগুলোকে নিরাপত্তার জন্য তেল আবিবের ওপর নির্ভরশীল করে গড়ে তোলা। ৮০-এর দশকে এই নীতি গ্রহণের পর মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব শক্তিশালী দেশই কোনো না কোনোভাবে ভেঙে পড়েছে অথবা বিপর্যয়ের মোকাবেলা করছে। ইরাক সিরিয়া ইয়েমেন লিবিয়ার নাম এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। অন্য শক্তিমান দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব তুরস্ক ইরান মিসর বা সুদান সব দেশই কোনো না কোনো সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। এই অবস্থায় ইরান সৌদি আরব দ্বন্দ্ব নিরসন কোনোভাবেই ইসরাইল ও তার পৃষ্ঠপোষক দেশগুলো চাওয়ার কথা নয়।
এরপরও মুসলিমবিশ্বের কয়েকটি শক্তিমান দেশ চাইছে ওআইসির সদস্য দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের অবসান ঘটাতে। দেরিতে হলেও রিয়াদ বা তেহরান দুই পক্ষই এতে সাড়া দিচ্ছে। তারা যদি সত্যি সত্যি চায় তাহলে নিজেরা মারামারি করে শত্রুকে সুবিধা করে দেয়ার বর্তমান অবস্থার অবসান ঘটতে পারে। ইরান-সৌদি সমঝোতা হলে মধ্যপ্রাচ্যের খেলায় অনেক বড় পরিবর্তন আসবে, এখানকার কোনো দেশকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ইসরাইলের কাছে ধরনা দেয়ার প্রয়োজন হবে না। হ
mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement