০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, empty
`

অর্থনৈতিক দৈন্য, মানুষের আর্তনাদ

চোখের আলোয়
-

করোনাভাইরাস দ্রুত বিস্তারের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি এখন বড় ধরনের বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যে কোনো সময় দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সংস্থা এ বিষয়ে সতর্ক বার্তা দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশগুলোর দরিদ্র মানুষ করোনাভাইরাসের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। কঠোর লকডাউনই করোনার বিস্তার রোধের উপায় ভেবে প্রায় দেড় বছর ধরে থেমে থেমে সরকার দেশজুড়ে যে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করছে তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ। করোনার বিস্তার রোধ করাও সম্ভব হচ্ছে না। করোনায় মৃত্যু ও সংক্রমণ কোনোটাই কমছে না। গত মাসের শেষ থেকে চলতি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত টানা বেশ কিছুদিন দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন মৃত্যু ২০০ জনের কাছাকাছি বা ওপরে ছিল। করোনার বিস্তার এখন গ্রামপর্যায়ে চলে গেছে। এর মধ্যেই তুলে নেয়া হলো লকডাউন।
কিন্তু করোনায় আক্রান্ত, শনাক্ত ও মৃত্যুর হার কমেছে এমন নয়। গৃহবন্দী থাকতে থাকতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। দিনে রোজগার করে দিনে খায় এ ধরনের মানুষের সংখ্যা দেশে সবচেয়ে বেশি। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। বর্তমান পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থার জটিলতার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ক্রমশই বাড়ছে। উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীন। শুরুর দিকে চীনের পরিস্থিতি এতটাই জটিল ছিল যে গোটা বিশ্বে এ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু চীন এ ভয়াবহতাকে কৌশলে এমনভাবে রোধ করেছে যা দেখে গোটা বিশ্ব হতবাক হয়ে যায়। চীন সরকার কিভাবে করোনার বিস্তার রোধের উপায় নিয়ে প্রায় দুই মাস গবেষণা চালিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয় এবং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ শুরু করে। অল্প সময়ের মধ্যেই তারা সফলতা অর্জন করে। চীনের অর্থনীতিতে আগের মতোই গতি ফিরে এসেছে। বিশ্ব অর্থনীতি এখন চীনের কব্জায়। বাংলাদেশের উচিত ছিল চীনের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করে পদক্ষেপ নেয়া। চীন এখন করোনা বিস্তারের পথ রোধ করে দিয়ে বিশ্বের প্রথম স্থান দখল করে নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের এ ব্যাপারে বন্ধুরাষ্ট্র চীনের সুপরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। এখনো সময় আছে চীনের কৌশলগত দিকটি গ্রহণ করে, তারপর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর রুজি-রোজগারের পথে সহায়তা করা। আমাদের দেশে রোগীর তুলনায় যথেষ্ট সংখ্যক হাসপাতাল নেই। অভিজ্ঞ ডাক্তারের স্বল্পতাও লক্ষণীয়। নানা কারণে করোনা দীর্ঘমেয়াদি রূপ নিচ্ছে। সরকারের ভুল পদক্ষেপে জনভোগান্তি বাড়ছে। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে বিশ্বব্যাংক তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ থেকে নেমে দুই কিংবা তিন শতাংশ হতে পারে। দেশের অর্থনীতি সেই পথেই হাঁটছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতিটি খাত গত এক মাসে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে মোটা দাগে কৃষি, সেবা এবং শিল্প খাতে ভাগ করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, দেশের অর্থনীতিতে এখন সেবা খাতের অবদান প্রায় ৫০ শতাংশ। এছাড়া শিল্প খাত ৩৫ শতাংশ এবং কৃষির অবদান এখন ১৫ শতাংশের মতো। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলেন, গত এক মাস অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় সেবা খাত ও শিল্প খাত মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক যে ধারণা দিচ্ছে সেটা রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। বাংলাদেশ আশা করেছিল, ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। মহামারীর কারণে ২০১৯-২০২০ সালে তা কমে ৫ দশমিক ২ শতাংশে এসেছিল। বিশ্বব্যাংক বলছে, অবস্থা আরো খারাপ হবে ২০২১ সালে। ১ জুলাই ২০২১ বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদে বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য উত্থাপিত ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার এই বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ২ শতাংশ ধরা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, আগামী বছর বাংলাদেশ ৫ দশমিক ১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পেতে পারে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি আগামী বছর হতে পারে সাড়ে ৭ শতাংশ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ দিয়েছে যা সরকারেরও লক্ষ্য। করোনা মহামারীর কারণে এটা অর্জন করা সম্ভব হবে না বলে মত প্রকাশ করেছেন দেশের অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদরা। করোনাভাইরাস মহামারীর প্রথম বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে সরকার মানুষের জীবন জীবিকা রক্ষার স্লোগান দিয়ে এ বছরের জন্য বাজেট দিয়েছে। আকারে বিশাল হলেও সুনির্দিষ্ট পথরেখা না থাকায় তার বাস্তবায়ন নিয়ে জোর সংশয় প্রকাশ করেছে সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর)। সর্বশেষ এক রিপোর্টে সংস্থাটি পূর্বাভাস দিয়েছে যে, মাত্র সাত বছর পরেই চীন হবে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। ২০৩০ সালে ভারত হবে তৃতীয়। আর ২০৩৫ সাল নাগাদ ১৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বহু ধাপ উপরে উঠে পৌঁছে যাবে ২৫ নম্বরে। ২০২০ সালের সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। সিইবিআর বলছে, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে অনেক ওলট-পালট ঘটে গেছে। অর্থনীতির অঙ্ক এখন মেলানো যাচ্ছে না। অর্থনীতি বিশ্লেষক ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, মহামারীকালে জরুরি প্রয়োজন মেটাতে ২০২০ সালের মতো ২০২১ সালেও ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব রয়েছে বাজেটে। আশা করেছিলাম, আউটলাইন দেবে। কিভাবে ১২ কোটি মানুষকে টিকা দেবে? বিশাল কর্মযজ্ঞ। সেই প্ল্যান না থাকলে শুধু টাকা নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। সরকার বলছে বাজেটে কোভিড ফোকাস আছে। যেহেতু এবারের বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকা থেকে বরাদ্দ রাখা হয়েছে শুধু ভ্যাকসিনের জন্য। গত বছরও (২০২০) বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছিল, রেজাল্ট কী? শুধু টাকা দিয়ে ভ্যাকসিন কিনলেই হবে না। এক্সিকিউশন প্ল্যান থাকতে হবে। সেই পরিকল্পনা কি সরকার এবার নিতে পেরেছে? মহামারী রুখতে একমাত্র ভরসা টিকা প্রয়োগের বিশাল কর্মযজ্ঞের জন্য জাতীয়পর্যায়ে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা একান্ত দরকার। এ বছরের বাজেটে উল্লেখ করা হয়নি কত লোককে ভ্যাকসিনেট করতে হবে। যদি মাসে ২৫ লাখ করে ডোজ দেয়া হয় তাহলে সময় লাগবে সাত বছর । তা হলে ২৪ কোটি ডোজ দিতে কত সময় লাগবে? তাহলে দৈনিক কত ডোজ প্রয়োজন, বর্তমানে এক লাখের মতো হচ্ছে। এখানে বিশাল গণ্ডগোল। আমরা ধার করা বাজেট দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। সরকারের কোনো সেভিংস হচ্ছে না। এক পয়সাও সেভিংস নাই। ধার করে আমরা বিনিয়োগ করছি (সূত্র বিডিনিউজ ২৪.কম ৪ জুন ২০২১)। দীর্ঘমেয়াদি কঠোর লকডাউন কর্মজীবী মানুষকে পথে বসিয়ে দিয়েছে। ইতোমধ্যেই আয় রোজগার নিয়ে মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে দেশের কৃষক, শ্রমিক, জনতা। বাস্তবতায় দেখছি, তাদের প্রকৃত অভিভাবক বলতে কেউ আছে বলে মনে হয় না। হাসপাতালে অক্সিজেন ও শয্যাসঙ্কট। বিরোধী দল স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। আর নির্বাহী প্রধান আশ্বাসের বাণী দিয়ে বলছেন, সব কিছুই ঠিক হয়ে যাবে, সবাইকে টিকা দিয়ে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেয়া হবে। মানুষ এসব কথায় ভরসা পাচ্ছে না। দেশে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ এ বছর দারিদ্র্যের খাতায় নাম লিখিয়েছে। এ দিকে সরকার বারবার বলছে, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ। বর্তমানে আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করছি। অপর দিকে সাধারণ মানুষের পেটে ভাত নাই। উচ্চবিত্তরা ত্রাণের নামে সেলফি তোলে। নিম্নবিত্ত মানুষ বলছে, আমরা ভিক্ষা চাই না। আমরা কাজকর্ম করে বাঁচতে চাই। একজন রিকশাওয়ালার কথা, ভোট দিতে না পারলে কিসের জনগণ। সরকারের কাছে কিছু চাইতে গেলে মাইর খেতে হয়। দুইডা বছর ধরে লকডাউন। কিছু বললে বলে জঙ্গি জামায়াত বা বিএনপি। কোথায় যাব আমরা। আমার দুই বাচ্চা দুই দিন ধরে উপোস। নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছে পরিবহন শ্রমিকরা। পরিবহন শ্রমিকদের কল্যাণের টাকা দিয়ে কয়টা হাসপাতাল হয়েছে। কয়জন পঙ্গু শ্রমিককে মাসোয়ারা দিয়েছে সরকার? একজন ভ্যানচালক বলছে, গাড়ির চাকা অচল, সচল ক্ষুধা, আমরা কী খেয়ে বাঁচব? চরম দুর্ভোগে আছে প্রবাসী কর্মীরা। বিদেশে দেড় বছরে মারা গেছে চার হাজার ২৬২ কর্মী। মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রবাসী কর্মীর লাশ আসছে বেশি। দেশে চাকরি না পেয়ে বিদেশগামী শত শত মানুষ ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরছে। উন্নতির স্বপ্নে মৃত্যুর পথযাত্রা। চরম দুর্ভোগে নগরবাসী। একটু বৃষ্টি হলেই রাজধানীর বেশির ভাগ সড়ক থাকে পানির নিচে। নগরবাসীর সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করা হলো অথচ মানুষের সুযোগ সুবিধা বাড়েনি এবং সঙ্কট আরো তীব্র হয়েছে। দুই সিটি মেয়র শুধুই বাগাড়ম্বর করছেন উন্নয়ন নিয়ে। বাস্তবে নগরবাসীর কষ্ট কমছে না। একদিকে বিগত ১৮ মাস কোভিড-১৯ মহামারীতে আক্রান্ত দেশের মানুষ। মৃত্যু ১৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। শনাক্ত হয়েছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ। সব কিছুই দুঃখজনক মাইলফলক অতিক্রম করছে। কত বলব দুঃখ দুর্দশার কথা। লিখলে শেষ হবে না মানুষের দুঃখ যন্ত্রণা নিয়ে। হ
লেখক : কলামিস্ট ও গ্রন্থকার
E.m: harunrashidar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement