জুলাই বিপ্লব : কোন দিকে যাচ্ছে জেন জেড
- আবদুল্লাহ আল-আহসান
- ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
বাংলাদেশের বিপ্লবী ছাত্ররা দেশের ফ্যাসিবাদী সরকারকে সফলভাবে উৎখাত করার পর বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভেঙে দিয়ে আবার আরেকটি সহিংসতার কাজ করেছে। ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ান ঘটনাটির বর্ণনা করেছে, ‘হাসিনার প্রতিবেশী ভারতে থেকে নির্বাসিত সমর্থকদের উদ্দেশে একটি বক্তৃতাকে কেন্দ্র করে হামলার সূত্রপাত হয়, যেখানে তিনি তার ১৫ বছরের শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র নেতৃত্বাধীন ভয়ঙ্কর বিদ্রোহের সময় গত বছর পালিয়ে গিয়েছিলেন।’ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তাৎক্ষণিকভাবে এ কাজের তীব্র নিন্দা করেছেন এবং এটিকে দুঃখজনক বলে অভিহিত করেছেন। দেশের অন্যান্য শহর ও নগরে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। কিছু সংবাদমাধ্যম এসব ঘটনাকে ভাঙচুর হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে বেশির ভাগ পর্যবেক্ষক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকারের মতে, এসব বিস্ফোরণ ছিল বহিষ্কৃত ফ্যাসিবাদী শাসনের ক্রমাগত উসকানিতে ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া। আমাদের দৃষ্টিতে এসব ঘটনা সমাজের অনেক উপাদান এবং স্টেকহোল্ডারকে উন্মোচিত করেছে। আসুন এই ঘটনাবলির কিছু দিক পরীক্ষা করা যাক। এতে জেড জেনারেশন হিসেবে চিহ্নিত শিক্ষার্থীরা কোন দিকে যাচ্ছে তাও আমরা বোঝার চেষ্টা করব।
ঘটনাগুলো কিভাবে উন্মোচিত হলো
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ (এএল) নেত্রী হাসিনা ভারত থেকে একটি প্রকাশ্য ঘোষণা দেন যে, তিনি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে ৫ ফেব্রুয়ারি তার মাসব্যাপী রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। জবাবে শিক্ষার্থীরা হুঁশিয়ারি দেন, আওয়ামী লীগ তাদের কর্মসূচি নিয়ে এগোলে রাজধানীতে তার বাবার বাড়ি থেকে শুরু করে সারা দেশে আওয়ামী লীগের প্রতীক তারা গুঁড়িয়ে দেবে। যেহেতু আওয়ামী লীগ তাদের সতর্কবার্তায় কোনো পাত্তা দেয়নি, তাই ছাত্ররা বুলডোজার নিয়ে প্রস্তুত হয়। প্রশাসনের কিছু মহলের কাছ থেকে তারা কিছুটা সমর্থন পেয়েছে বলে মনে হয়; তাদের বুলডোজার সংগ্রহ সেটির ইঙ্গিত করে। হাসিনা যখন তার অনলাইন ঠিকানা থেকে বক্তৃতা দিতে শুরু করেন, ততক্ষণে ধ্বংসের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে এবং তিনি অশ্রু ঝরাতে শুরু করেন বলে জানা গেছে। ‘কুমিরের কান্না’ অবশ্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনো আবেদন সৃষ্টি করেনি। তারা আরো কয়েক দিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের প্রতীককে টার্গেট করতে থাকে। তারা তাদের কর্মকাণ্ড কিছুটা পরিকল্পনা করে চালিয়েছে বলে মনে হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিক্রিয়া
৫ ফেব্রুয়ারি ভোরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ তার ফেসবুক পেজে বাংলাদেশ থেকে ফ্যাসিবাদ নির্মূল করার বিষয়ে ছাত্রদের অভিপ্রায় ঘোষণা করেন এবং সেদিন সন্ধ্যায় প্রথম হামলার পরই তাদের বক্তব্যের গুরুত্ব স্পষ্ট হয়। ভারত সরকার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে প্রতিক্রিয়া জানায়। কিন্তু বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস উইং দুই দিন পরে ‘ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের প্রচেষ্টা’ নিয়ে ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করে একটি বিবৃতি দেয়। ‘হাসিনার ভাষণ তার দল আওয়ামী লীগের সব অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সম্প্রচার করা হয়েছে’, যার প্রতিবাদে সরকার বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করে। এসব ঘটনা ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্যাটির সংবেদনশীলতা তুলে ধরে।
অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বলতা
ঘটনা থেকে বোঝা যায় ছাত্ররা আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে। প্রশ্ন হলো কেন এটি হলো? গত ছয় মাসে দেশের সাধারণ উন্নয়ন স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে অন্তর্বর্তী সরকার তাদের আকাক্সক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস সবার শ্রদ্ধা ও আস্থা উপভোগ করেন বলে মনে হচ্ছে। তবে অনেক পর্যবেক্ষক প্রশাসনের অন্যান্য উপদেষ্টার যোগ্যতা ও আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। বেসামরিক প্রশাসনে, বিশেষ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় বড় কোনো রদবদল হয়নি; যারা ফ্যাসিবাদী শাসনের সেবা করেছে তাদের অনেকেই এখনো সরকারি যন্ত্রের অংশ। গত ডিসেম্বরে সচিবালয় ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়েছে প্রশাসন। একই রকম আরো অনেক ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে।
ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদী সরকারের সবচেয়ে জটিল রহস্যগুলোর মধ্যে একটি ছিল ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত বন্দিশালা, যেখানে বলপূর্বক গুমের শিকার অনেককে পশুর মতো আটকে রেখে নিয়মিত নির্যাতন করা হয়। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য নাগরিক সমাজের সদস্যদের পক্ষ থেকে জোরালো দাবি ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টি সম্পর্কে একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের ঘোষণা দিয়েছে। তবে সুইডেনভিত্তিক নেত্র নিউজ ৫ ফেব্রুয়ারি রিপোর্ট করে যে ‘সংবেদনশীল সরকারি আলোচনার বিষয়ে কর্মকর্তারা বলেছেন যে, নিরাপত্তা বাহিনী এখন ভয় পায় যে ‘আয়নাঘর’ থেকে বেঁচে থাকা ব্যক্তি ও সাংবাদিকদের সংশ্লিষ্ট আটকে রাখা কেন্দ্রগুলোর প্রকাশ্য পরিদর্শন তাদের ভাবমর্যাদা নষ্ট করতে পারে।’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘প্রধান উপদেষ্টা তার মূল পরিদর্শন পরিকল্পনা চালিয়ে যেতে চান, নিরাপত্তা বাহিনীর ইচ্ছার সাথে একাত্ম হওয়ার জন্য এটিকে পরিবর্তন করতে চান, নাকি সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করতে চান, তা তখনো স্পষ্ট হয়নি। আপাতদৃষ্টিতে প্রতিশ্রুত সফরকে দেশের অস্বচ্ছ নিরাপত্তা যন্ত্রের একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে অধিকার গোষ্ঠীগুলো দ্বারা স্বাগত জানানো হয়।’ তবে প্রধান উপদেষ্টা ১২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে আয়নাঘর হিসেবে চিহ্নিত কয়েকটি বাড়ি পরিদর্শন করেছেন এবং প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলো এই প্রতিবেদন করে। তিনি এই আটক কেন্দ্রগুলোর অনুশীলনগুলোকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যেটি এটি আরবের প্রাক-রাসূল সময়ের অন্ধকার সময়ের একটি উল্লেখ। ইসলামী ঐতিহ্যে এ ধরনের অবস্থার কঠোরভাবে নিন্দা করা হয়েছে।
৫ ফেব্রুয়ারি নতুন করে ছাত্র-অভ্যুত্থানের পর, সরকার শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সাড়া দিতে আরও সক্রিয় হয়েছে বলে মনে হয়। একজন ছাত্র উপদেষ্টা এগিয়ে এসে আন্দোলনকারীদের আশ্বস্ত করেন যে, সরকার শিগগিরই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ নেবে। এটি তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে, গাজীপুরে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা আবারো ছাত্র আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালিয়ে পাঁচজন আহত করেছে, যার মধ্যে একজন পরে মৃত্যুবরণ করে। এটি স্বরাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টাকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে এবং সন্ত্রাসীদের আটকাতে অভিযানের দিকে পরিচালিত করেছে। এমনকি সরকারকে সারা দেশে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিবৃতি দিয়েছে বিএনপিও। এসব ইতিবাচক উন্নয়নের প্রশংসা করা আবশ্যক।
ইতিহাস লেখার চ্যালেঞ্জ
ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদী হাসিনা শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়কে ক্ষুণœ করে জাতীয় ইতিহাসকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে পাল্টে দেয়া। অধ্যাপক রশিদুজ্জামান, যিনি ১৯৭১ সালের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপনা করতেন, সম্প্রতি একটি নিবন্ধ লিখেছেন, এই প্রক্রিয়ায় ভারতের আশীর্বাদে সাবেক শাসকগোষ্ঠী ‘ঔপনিবেশিক বাংলায় মুসলিম স্বাতন্ত্র্যের ঐতিহাসিক শিকড়কে’ ছিন্নœ করার পরিকল্পনা করেছিল। তিনি আরো উল্লেখ করেছেন কিভাবে হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন ১৯৭১ সম্পর্কিত তথ্য অতিরঞ্জিত করেছে, তার পরিবারকে মহিমান্বিত করেছে এবং বিগত শতাব্দীতে আবির্ভূত বাঙালি মুসলিম পরিচয়ের চেতনাকে ক্ষুণœ করে ইতিহাস পাঠ্যক্রমকে বিকৃত করেছে। এই সিরিজের আগে একটি প্রবন্ধে, আমরা গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছি যে, কিভাবে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম বাংলার এই পরিচয় গঠনের দীর্ঘ ইতিহাসে একটি সাময়িক ফাটল ছিল বলে এআইয়ের জবাবে বলা হয়েছে। কিন্তু ফ্যাসিবাদী শাসন ইতিহাস বিকৃত করে সেই আত্মপরিচয়কে দুর্বল করার চেষ্টা করেছিল। জুলাই বিপ্লব ছিল ইতিহাস বিকৃতির এমন কারসাজির ফল, আর গত ৫ ফেব্রুয়ারির বিদ্রোহ ছিল জুলাই বিপ্লবের ধারাবাহিকতা। এই ধারাবাহিকতা অন্তর্বর্তী সরকারকে মনে করিয়ে দেয় যে তাদের দাবিগুলোকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়।
সমাপনী মন্তব্য
সময়ের সাথে সাথে, আমি এই দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছিলাম যে, জেন জেড প্রযুক্তি মানিয়ে নিতে বেশ দক্ষ এবং বৈশ্বিক বিষয়গুলো নিয়ে গুরুত্বের সাথে তারা চিন্তা করেন না। কিন্তু তারা আমাকে ভুল প্রমাণ করেছেন। ভুল তথ্যের সাগরে, তারা জানে কোন তথ্য গ্রহণ করতে হবে এবং কোনটি প্রত্যাখ্যান করতে হবে। আমি আশা করি তারা সত্য খুঁজে বের করার জন্য সক্রেটিক পদ্ধতির (প্রশ্ন করা ও উত্তর দেয়ার ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তিদের মধ্যে তর্কমূলক কথোপকথনের মাধ্যমে সত্যে পৌঁছার একটি রূপ) বিকাশ ঘটাবে।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত স্কলার। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল-আহসান মালয়েশিয়া, পাকিস্তান ও তুরস্কের বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ে প্রায় সাড়ে তিন দশক অধ্যাপনা করেছেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা