২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৩ শাবান ১৪৪৬
`

জালালাবাদী এক অনন্য চিন্তাবিদ

-

প্রবীণ আলেম লেখক মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী সম্পর্কে কয়েকটি কথা লিখতে আমি খুব উৎসাহিতবোধ করছি। মাওলানা জালালাবাদী বয়সে আমার চেয়ে মাত্র পাঁচ বছরের ছোট ছিলেন। কিন্তু যতবার তাকে দেখেছি, ততবার তার কর্মের গতিশীলতা দেখে আমি অবাক হয়েছি। তিনি প্রবীণ হয়েও তরুণের মতো চিন্তা করতেন অনেক বিষয়ে।
সাম্প্রতিক একটি ঘটনার কথা বলি, বছরখানেকরও আগে বাংলা একাডেমিতে শিক্ষা সংস্কার নিয়ে একটি সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এ সমাবেশের প্রধান লক্ষ্য ছিল, ধর্মপ্রাণ বাংলাদেশী ছেলে-মেয়েরা স্কুলে তাদের ধর্ম সম্পর্কে যেন একটি পরিষ্কার ধারণা পায়। এ প্রসঙ্গে তার সাথে কথা বলতে বলতে আমি উল্লেখ করলাম ইংল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার কথা। অনেকের জানা নেই যে, ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং ওয়েলসে ১৯৮৫ সালের পরে একটি বিষয় বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল; তা হলো রিলিজিয়াস স্টাডিজ।
তবে, রিলিজিয়াস স্টাডিজে কোনো সূরা শেখানো বা মন্ত্র শেখানো, প্রার্থনা সঙ্গীত শেখানোর কথা ছিল না। আসল উদ্দেশ্য ছিল, নীতি-নৈতিকতার ভিত্তিতে ছাত্রছাত্রীদের ভালো নাগরিক করে গড়ে তোলা। শেখানোর বিষয়বস্তু ছিল, অন্যের অধিকার নষ্ট না করা, অন্যকে কথা দিলে কথা রাখা, অন্যকে সাহায্য করা এবং কাউকে আক্রমণ না করা।
আমি যখন এ কথা বলে শেষ করলাম, তখন তিনি অনেকটা উচ্ছ্বাসের সাথে বললেন, ‘এটা তো ইসলামেরও কথা। আমরা যদি শিক্ষা বোর্ডের পাঠ্যপুস্তকে নবীজীর বিরুদ্ধে ওই বুড়ির কাঁটা বিছানোর কথা লিখি এবং যে দিন সে আসতে পারেনি, সে দিন নবীজী তাকে গিয়ে দেখেন সে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। নবীজী তার সেবা-শুশ্রƒষা করলেন। এতে বুড়ি অবাক হয়ে নিজের সব ভুল বুঝতে পারলেন।’
আমাদের পাঠ্যসূচিতে যদি আরো থাকে সাহাবায়ে কেরামের জীবনী থেকে মূল্যবান কিছু শিক্ষা, তাহলে আমরাও স্কুলে এথিকস এবং মোরালিটির কথা শেখাতে পারব। জালালাবাদী সাহেব এটা যে শুধু সমর্থন করলেন তাই নয়, তিনি আরো বললেন, অন্যান্য ধর্মের লোকেরাও তাদের সন্তানদের নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে, তাদের ধর্মের শিক্ষণীয় বিষয়টি তুলে ধরতে পারেন। এখানে বিরোধটা কোথায়?
আমরা দু’জনে এক মত হলাম যে, এভাবে শিক্ষাকার্যক্রম গড়ে তুলতে পারলে দেশে ভবিষ্যতে সৎ মানুষের অভাব হবে না। জালালাবাদী সাহেব শুধু যে ইসলামিক লাইনে লেখাপড়া শিখেছিলেন তাই নয়, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাকে একজন ইসলামিক হিউম্যানিস্ট হিসেবে ভুল বোঝার কোনো অবকাশ ছিল না। তিনি নিজ ধর্মের মাহাত্ম্য যেমন তার লেখনী ও অন্যান্য জায়গায় তুলে ধরেছেন, তেমনি তিনি অন্যান্য ধর্মের প্রতি সহৃদয় দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। তার একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তিনি গভীরভাবে যা বুঝতেন তা প্রকাশ করতে এতটুকু দ্বিধা করতেন না। তার এ গুণ শেখ মুজিবুর রহমানের নজরে পড়ে। যার কারণে তিনি ১৯৭২ সালে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের জুমার পূর্ববর্তী বাংলা খুতবার দায়িত্ব পান। তিনি বাংলাদেশ জমিয়তুল মোদার্রেছীনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অন্যতম সদস্য ছিলেন।
এ ছাড়া তিনি দীর্ঘ দিন গণভবন ও বাংলাদেশ সচিবালয় মসজিদের ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। তার জীবনের আরেকটি মূল্যবান অবদান এই যে, তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠনে বিশেষ অবদান রাখেন।
তুখোড় ছাত্রনেতা হিসেবেও মাওলানা জালালাবাদী সফল ছিলেন। তার হাত ধরে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন সফলভাবে গড়ে ওঠে। তার লিখিত, অনূদিত এবং সম্পাদিত পুস্তকের সংখ্যা এক শ’র বেশি। তার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, কর্মজীবনে যেখানেই তিনি ছিলেন, সেখানে বইয়ের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। তার একটি নেশা ছিল, দুর্লভ ইসলামী বইয়ের সন্ধান করা। তার নিজের পাঠাগারে এমন সব গ্রন্থের সমাহার করেছিলেন, যার অনেকগুলো বহু ইসলামী পণ্ডিত এখনো হয়তো সেগুলোর সন্ধান নাও পেয়ে থাকবেন।
একটি কথা না লিখলেই নয়, তা হলো মাওলানা জালালাবাদীর মূল্যবান গ্রন্থ সংগ্রহ সম্পর্কে। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে তিনি আমাকে ‘মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ সা:’ শীর্ষক একটি বই পাঠান, যে বইটির লেখক ডক্টর মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ (রহ:) এবং অনুবাদক তিনি নিজে। অর্থাৎ মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী আল-আযহারী, আমার পড়ার জন্য এবং মতামত প্রদানে বইটি পাঠিয়েছিলেন। স্মরণযোগ্য যে, বইটি বইয়ের বাজারে দুষ্প্রাপ্য। এটি একটি দুর্লভ পড়া বইও বটে। বর্তমানে বইটি বাংলা একাডেমি থেকে বের হতে চলেছে।
মাওলানা জালালাবাদীর একটি বিরাট প্রচেষ্টা ছিল দুর্লভ এবং দুষ্প্রাপ্য বইগুলো সংগ্রহ করা এবং এ সম্পর্কে তার প্রিয় সহপাঠীদের জ্ঞাতার্থে আনা। তিনি ইন্তেকালের কয়েক দিন আগে আমাকে আরো একটি বই পাঠিয়েছিলেন। সেটির রচয়িতাও ছিলেন ডক্টর মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ এবং প্রকাশক ইদারা-এ-ইসলামিয়াত, দাহির, করাচি, পাকিস্তান। এটিও দুষ্প্রাপ্য বইয়ের মধ্যে পড়ে।
জ্ঞানতাপস জালালাবাদী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ইসলামী জ্ঞানের প্রচার ও প্রসারে যে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছেন তার জুড়ি মেলা ভার। ইসলাম ধর্মের ঐতিহ্য এই যে, যদি কেউ নতুন জিনিস আবিষ্কার করেন, অনুধাবন করেন, তা নিজের মধ্যে না রেখে অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে পরিগণিত হয়। মাওলানা জালালাবাদী এই ইসলামী ঐতিহ্যের একজন বড় ধারক এবং বাহক ছিলেন।
ইসলাম যে একটি শান্তির ধর্ম এটা শুধু তিনি নিজেই বোঝেননি এবং আমল করেননি, তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে সে কথা নির্ভীকভাবে আমজনতার কাছে তুলে ধরেছেন। তার জীবনের বিশ্বাস, কর্মকাণ্ড ও মানবতাবাদী কর্মকাণ্ডে তাকে ভুল বোঝার কোনো অবকাশ কারো ছিল না। এ ধরনের মানুষ পৃথিবীতে যত জন্মাবে তত মানবতার জন্য মঙ্গলজনক।
আমি তার গলার স্বর কোনো দিন ভুলব না। প্রগতিবাদী মানুষের এককাতারে দাঁড়িয়ে তিনি সারা জীবন যে কাজগুলো করেছেন; তা এ দেশের মানুষের মনে চিরস্থায়ীভাবে দাগ কাটবে।
আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তার মতো লোক ইসলামী জগতে আরো জন্মগ্রহণ করুন এবং আল্লাহ তাকে বেহেশতের একটি উপযুক্ত স্থান দান করুন। আমরা সবাই যদি তার দর্শন, তার বলিষ্ঠ কর্মপদ্ধতি এবং তার জ্ঞানপিপাসু মনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে কাজ করি, তবে তা-ই হবে তার প্রতি সঠিক শ্রদ্ধা জানানো। আল্লাহ মাওলানা জালালাবাদীর সন্তান ও পরিবারকে তার আদর্শে অনুপ্রাণিত করুন এটা-ই আমার প্রার্থনা।
লেখক : পরমাণু বিজ্ঞানী


আরো সংবাদ



premium cement