ভাঙা-গড়ার রাজনীতি
- শরিফুল ইসলাম
- ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে অবস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িটি ‘বত্রিশ নম্বর’ বাড়ি হিসেবেই মানুষের কাছে বেশি পরিচিত। এই সড়কে আরো অনেক বাড়ি আছে; কিন্তু বত্রিশ নম্বর সড়ক বললে মানুষের স্মৃতিতে মূলত শেখ মুজিবের বাড়িই ভেসে ওঠে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত শেখ মুজিব তার বত্রিশ নম্বর সড়কের বাড়িতেই বসবাস করতেন। পরে শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে ভারত থেকে দেশে ফিরে বত্রিশ নম্বর সড়কের বাড়িটি তার বাবার নামে জাদুঘরে রূপান্তর করেন। গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত বাড়িটি জাদুঘরই ছিল। এটি মূলত আওয়ামী ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বিশেষ আইকন হিসেবে রীতিমতো তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছিল।
২.
স্বাধীনতা আন্দোলন এবং তার আগে এ দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় ভূমিকার কারণে শেখ মুুুুজিবুর রহমান বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন; কিন্তু স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে তিনি রক্ষীবাহিনী ও বাকশাল গঠনসহ নানা গণবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং ব্যর্থ শাসক হিসেবে জনগণের কাছে ব্যাপকভাবে সমালোচিত ও অপ্রিয় হয়ে পড়েন। একনায়কতান্ত্রিক বাকশালব্যবস্থা কায়েমের মাধ্যমে শেখ মুজিব নিজেই নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বৈরশাসকে পরিণত করেন।
শেখ মুজিবের সংক্ষিপ্ত শাসনামলে (১৯৭২-১৯৭৫) সিরাজ শিকদারসহ ৪২ হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সময়ে শেখ মুজিব মাত্র চারটি পত্রিকা রেখে সব পত্রিকা বন্ধ করে দেন। এভাবে তিনি স্বৈরাচারী কায়দায় জনগণের কণ্ঠ রোধ করেন এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করেন। এর ফলে প্রায় সব সাংবাদিক ও সংবাদপত্রসেবী বেকার হয়ে পড়েন। তার শাসনামলে আইনের শাসন ছিল চরমভাবে অনুপস্থিত। শেখ মুজিবের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি বলতেন, ‘আমরা আইনের শাসন চাই না, শেখ মুজিবের শাসন চাই।’ আর শেখ মুজিবের সেই শাসনে তখন দেশে চলছিল হত্যা, লুণ্ঠন আর দমন-পীড়নের এক সীমাহীন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। আইন-আদালত বা নিয়ম-কানুনের সেখানে কোনো জায়গা ছিল না।
বাকশাল কায়েমের মাধ্যমে শেখ মুজিব রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনের স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ করে দেন। দুর্ভিক্ষ, দুঃশাসন, নৈরাজ্যের কারণে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। এমনই এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নৃশংস ঘটনা। এটি ছিল শেখ মুজিবের স্বৈরশাসনের চূড়ান্ত পরিণতি। সে সময় তিনি সপরিবারে নিহত হলেও তার বত্রিশ নম্বর সড়কের বাড়িটি অক্ষতই ছিল। সরকার যদি তখনই স্বৈরশাসক শেখ মুজিবের স্মৃতিবাহী এই বাড়ির বিষয়ে কোনো দৃষ্টান্তমূলক সিদ্ধান্ত নিত তাহলে আজকে শেখ হাসিনা, শেখ মুজিবের মতো স্বৈরশাসক হয়ে ওঠার দুঃসাহস পেতেন কি না সন্দেহ।
অন্যায় করার আগে প্রতিটি মানুষই ভালো থাকেন; কিন্তু কোনো মানুষ যখন অন্যায় করেন তখন তিনি সমাজের দৃষ্টিতে মন্দ হয়ে ওঠেন। সমাজের রীতি অনুযায়ী অন্যায়কারীকে শাস্তি পেতে হয়। আবার কেউ যখন অন্যায় করে পুরো সমাজকেই জিম্মি করে ফেলেন, তাকেও সময়ের ব্যবধানে সমাজের শাস্তির মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। সমাজ অন্যায়কারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এ জন্যই নিশ্চিত করতে চায়, যাতে করে একজনের অন্যায়ের শাস্তি দেখে অন্যরা সেই অন্যায় কাজে জড়িয়ে না পড়েন। স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃস্থানীয় ভূমিকার জন্য শেখ মুজিব মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন; কিন্তু স্বাধীনতার পর বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও দেশ শাসনে ব্যর্থতার জন্য একসময় বিপুল জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত শেখ মুজিব মানুষের ক্রোধের অনলে জ্বলতে থাকেন।
৩.
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান বত্রিশ নম্বর সড়কের বাড়িতে নিহত হওয়ার সময় শেখ হাসিনা বিদেশে ছিলেন। সাথে ছিলেন তার বোন শেখ রেহানাও। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবের একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করলে সব দলের রাজনীতি করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ঠিক এ সময়েই দেশে ফিরে রাজনীতি করা শুরু করেন শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের মানুষ ক্ষমাপ্রবণ, উদার ও কিছুটা দুর্বল স্মৃতিশক্তির অধিকারী। বিজ্ঞ জনরা এমনটাই বলে থাকেন। শেখ মুজিবের স্বৈরশাসনের দুঃস্বপ্নের দিনগুলো অনেকটা ক্ষমা করে ও ভুলে গিয়েই মানুষ দেশের রাজনীতির মাঠে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়েছিল; কিন্তু দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা তার পিতা শেখ মুজিবের স্বৈরশাসনের পথেই হাঁটেন। অনেক ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা তার পিতা শেখ মুজিবের দুঃশাসন ছাড়িয়ে যান। তার দুঃশাসনের পরিধি আরো বহু গুণ বিস্তৃত হয়।
শেখ হাসিনার ক্ষমতার প্রথম মেয়াদে ১৯ হাজারের বেশি রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়। এ সময়েই বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলামকে অপাঙ্ক্তেয় করার ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন শুরু হয়। দেশের নানা স্থানে একের পর এক ধর্ম অবমাননার ঘটনা ঘটিয়ে দেশের ইসলামপ্রিয় মানুষের মনে চরমভাবে আঘাত দেন শেখ হাসিনা। সংসদ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার হিজাব পরে ও হাতে তসবি নিয়ে জায়নামাজে বসার ছবি বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে তার ইসলামপ্রীতির হাস্যকর উদাহরণ হয়ে ওঠে।
২০০৯ সালে ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দীনের যোগসাজশে দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে শেখ হাসিনা পুরোপুরি কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসকে পরিণত হন। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে দমন, দেশের ইসলামবিদ্বেষী শক্তিগুলোকে আরো শক্তিশালী করা, আয়নাঘর বানিয়ে বিরোধী মতের মানুষকে বছরের পর বছর গুম করে রাখা ও হত্যার মতো জঘন্যতম কাজগুলো শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ মদদে সম্পন্ন হয়। সর্বশেষ জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সময় প্রায় দুই হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা ও অসংখ্য মানুষকে আহত করা হয় শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে। এমতাবস্থায়, বত্রিশ নম্বর সড়কের বাড়িসহ জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাথে যা হয়েছে তা সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে আওয়ামী দুঃশাসনের শিকার অগণিত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাই শ্রেয়।
এসব ঘটনা বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, মুহাম্মদ কামারুজ্জামানসহ আরো যাদেরকে বিচারিক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের পরিবার কিংবা মুগ্ধ আর আবু সাঈদের মতো শহীদদের পরিবার-পরিজন ও তাদের প্রিয়জনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া কিছুই নয়। এগুলোকে ‘মব কালচার’ নাম দেয়া অনুচিত মনে করি।
শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষের বারবার এমন ক্ষোভ প্রকাশের অর্থ হলো, তারা আর নতুন বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে চায় না। এই ক্ষোভের মাধ্যমে মানুষ আওয়ামী লীগকে এই বার্তাও দিচ্ছে যে, জার্মানির নাৎসি দলের মতো ফ্যাসিবাদী আদর্শ ধারণ করা দল আওয়ামী লীগকেও তারা আর রাজনীতিতে দেখতে চায় না। তারা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের ঘোষণা চায়।
৪.
৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়ার পরপরই সরকারে থাকা ছাত্র উপদেষ্টাসহ গণ-অভ্যুত্থানের নায়কদের অনেককেই ‘রিবিল্ড বাংলাদেশ’ লিখে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম আরো একধাপ এগিয়ে বলেছেন, ‘ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ নিছক ভাঙা নয়; বরং বিকল্প গড়ারও লড়াই। নতুন বন্দোবস্তে আমরা ভাঙার চেয়ে গড়ার দিকে গুরুত্ব দিতে চাই।’ গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজটিই অন্যতম চ্যালেঞ্জ। নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রধান টার্গেট হওয়া উচিত এখানে যেন আর কোনোভাবেই ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা ফিরে না আসে। কোনো শাসক ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে গেলেই যেন এখানে আবু সাঈদেরা রুখে দিতে বুক পেতে দিয়ে বলে ওঠেন, ‘বুক পেতেছি গুলি কর, বুকের ভিতর অনেক ঝড়।’ এখানকার প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যেন নিজস্ব সত্তা বজায় রেখে চলতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। দেশকে কোনো দেশের করদরাজ্য বানানোর কুবাসনা যেন কারো মনে জাগতে না পারে সে আলোকেই নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা প্রয়োজন।
পৃথিবীতে ভাঙা ও গড়ার রাজনীতি অতি পুরনো। ফ্যাসিস্ট অ্যাডলফ হিটলারের পতনের পর তার জন্মস্থান অস্ট্রিয়ায় তার বাড়িটি ফ্যাসিস্টরা দেখতে আসত। বাড়িটি নব্য-ফ্যাসিস্টদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছিল। অস্ট্রিয়ার সরকার হিটলার-ভক্তদের কোনোভাবে রুখতে পারত না। অবশেষে বাড়িটি ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয় অস্ট্রিয়া সরকার।
স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে উৎখাতের পর এখন দেশের মানুষের চাওয়ার আলোকে সুশাসন নিশ্চিত করার সময় এসেছে। সময় এসেছে মানুষের প্রতি ইনসাফ প্রতিষ্ঠার। বিভেদ-বিদ্বেষ ভুলে নতুন বাংলাদেশ হয়ে উঠুক সবার- সেটিই মানুষের কামনা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা