ইতিহাসে জুলাই অভ্যুত্থানের দায় ও খালদুনের পরামর্শ
উৎসের উচ্চারণ- মুসা আল হাফিজ
- ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
এক.
জুলাই অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাস কাঁপিয়ে দিয়েছে। এই অভ্যুত্থান গণমানুষের অভিব্যক্তিকে আত্মপ্রকাশের এমন বিবৃতি দিয়েছে, যাকে অনেকেই বিপ্লবের শিরোনাম দিচ্ছেন। অভ্যুত্থানটি সমাজ-রাষ্ট্রের বিপ্লবাত্মক রূপান্তরে অনূদিত হয়নি। যদিও বিপ্লবাত্মক সম্ভাবনা সে এখনো ধারণ করছে। সে ইতিহাসের ভেতর থেকে এমনভাবে উঠে এসেছে, যা আমাদের আত্মতা ও বিকাশের গুরুতর মাত্রাগুলোকে প্রগাঢ়ভাবে স্পর্শ করে। এই চরিত্র তাকে করে তুলেছে বাংলাদেশের যা কিছু অভিপ্রায়, তার সমসাময়িক জামিনদার।
জুলাই অভ্যুত্থানের আগে বাংলাদেশ অনেক অভ্যুত্থান উদযাপন করেছে। কোনো অভ্যুত্থানই বাংলাদেশের ইতিহাসের পুনর্গঠনে গুণগত পরিবর্তনের কর্মসূচি হাজির করেনি। লাল জুলাইয়ের অভূতপূর্ব আবেগ, ক্ষোভ, ত্যাগ, সাহস ও সৃষ্টিশীলতার ভেতর থেকে যে লাল অভ্যুত্থান উঠে এলো, তা কি ইতিহাসের পুনর্গঠন ও পুনর্গঠনের কোনো রূপকল্প প্রস্তাব করে?
সেটি করে। কারণ এ অভ্যুত্থান কেবল ৩৬ দিনের ঘটনাপরিক্রমা ছিল না। সে যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের আত্মসত্তার ভেতরে নিজেকে তৈরি করছিল। তার আত্মগঠনের পেছনে অন্যতম যে উপাদান কাজ করছিল, তা হলো ইতিহাসের ওপর অন্যায্য দখলদারি ও তার আজাদীর জরুরত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের ওপর আওয়ামী লীগ ও শেখ পরিবারের দখল কায়েম এবং ইসলামোফোবিয়ার হাত দিয়ে তার চিত্র ও চরিত্র বয়নের চেষ্টা কয়েক যুগ পার করেছে।
এই বয়ানকে নিপীড়ন, অবিচার, গুম, খুন ও স্বৈরতন্ত্রের পাহারায় নিয়োজিত করা হয়। ইতিহাসকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর হাত থেকে হাইজ্যাক করার মধ্য দিয়ে জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় অপরায়নের রাজনীতি। ইতিহাসের আশ্রয়ে তৈরি করা হয় এমন সব বাইনারি, যার ওপর দাঁড়ায় জুলুমতন্ত্র ও বৈষম্যরীতি।
জুলুমের এই ধারা প্রাতিষ্ঠানিক অবয়ব লাভ করে এবং রাষ্ট্রীয় ইনস্টিটিউটগুলোর চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যকে হত্যা করে। বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনের ওপর সে শাসন জারি করে এবং বিতাড়িত করে ইতিহাসের সত্যমূল্য। এর ফলে সবচেয়ে বেশি লাঞ্ছিত হয় আদল বা ইনসাফ।
রাষ্ট্র, রাজনীতি যখন আদল বা ইনসাফকে অঙ্গীকার করে না, তত্ত্ব ও আচরণে জুলুমকে নিয়মে পরিণত করে, তখন কী ঘটে? আবদুর রহমান ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬) ইতিহাসের তরফ থেকে জানাচ্ছেন, আজ জুলমু ইযা দা-মা, দাম্মারা। জুলুম যখন অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে, ক্ষমতা, জুলুমকেন্দ্রিক ব্যবস্থা ও শাসনধারাকে ধ্বংস করে দেয়। ধ্বংসটা কীভাবে ঘটে? ইবনে খালদুনের ভাষায়, প্রক্রিয়াটা হলো তাদমির তথা প্রচণ্ড ক্ষোভ ও ঘৃণার ভেতর থেকে ভলকানো উত্তেজনা, যা বিদ্যমানতাকে ভেঙেচুরে দেয়।
জুলাই অভ্যুত্থানে এ তাদমির জোরালোভাবে দৃশ্যমান ছিল এবং এতে ইতিহাসের ওপর জমিদারিমূলক বয়ানের বিরুদ্ধে প্রবল ঘৃণা উচ্চারিত হয়েছে।
‘আমি কে তুমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ এমন এক স্লোগান, যা বলে দেয়, ইতিহাসকে নিজের মালিকানায় নিয়ে স্বৈরাচারী চক্র যেসব অন্যায্য বাইনারি খাড়া করেছে, তা সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে। ফলে অভ্যুত্থানটা ইতিহাসের মধ্যে নিজেকে উপস্থাপন করেছে জোরালোভাবে। সে তাদমির বা প্রচণ্ড ক্ষোভ উৎপাটন করতে চেয়েছে অধিপতি বুদ্ধিজীবী ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক মন্দিরের সেবায়েত পণ্ডিতদের যাবতীয় মিথ্যাচারকে, যে মিথ্যাচার স্বৈরাচারের জবানে উচ্চারিত হয় গণহত্যা চালানোর প্রেক্ষিতে।
এই তাদমির জরুরি ছিল। কিন্তু ইবনে খালদুনের তাদমির একা আসে না। সে আসে বিপরীতে থাকা পরিগঠন ও সৃষ্টিধারা নিয়ে, যাকে বলে তা’মির। সেটি কিভাবে হবে? ইবনে খালদুন জানাচ্ছেন, আল আদলু ইয়া দা-মা, আম্মারা। ন্যায়, ইনসাফ ও যথার্থতাকে যখন তত্ত্ব, সিস্টেম ও আচরণে কায়েম করা হয়, তখন সমাজ, রাষ্ট্র ও জীবনধারায় গাঠনিক ইতিবাচকতা বিকশিত হয়। সমাজ ও রাষ্ট্র যথার্থ উজ্জীবন ও অগ্রগতি লাভ করে। এই প্রক্রিয়ায় ইতিহাসের বিনির্মাণ অত্যন্ত জরুরি, যা না ঘটলে কোনো অভ্যুত্থানই তা’মির তথা পরিগঠনের মধ্য দিয়ে অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে না; বরং ঝড়ের স্মৃতি হিসেবে কালের পৃষ্ঠায় থেকে যায়।
দুই .
সমাজ ও সভ্যতার উদ্ভব, বিকাশ ও প্রকৃতি সম্পর্কে নতুন প্রজ্ঞা হাজির করেন ইবনে খালদুন। এই দুর্গম পথে তার গন্তব্য ছিল সুস্পষ্ট। তিনি চেয়েছিলেন, যা যেমন, তাকে তেমনই দেখার দৃষ্টি ও ক্ষমতা সরবরাহ, রূপ থেকে স্বরূপে যাওয়া, বাইরে থেকে অন্তরালে প্রবেশ, বিষয়কে ধরে বিষয়ীকে ধরা এবং সহজাত নীতির নিরিখে মানুষের অতীত ঘটনাচক্রের সত্যস্বরূপ আবিষ্কার করে বর্তমানের সাথে তার সংযোগসূত্র সুস্পষ্ট করা। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের বিনির্মাণ। এই বিপুল বিশাল কর্ম সম্পাদনে জরুরি হলো বাতেনি ইতিহাস চর্চা, সমাজ অধ্যয়ন ও ইতিহাসের তা’মির।
সেই সাপেক্ষে জুলাই বিপ্লব কিভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসকে তাদমির ও তা’মির করবে, এর জন্য ইবনে খালদুন ছয়টি কেন্দ্রীয় কর্মনীতি পেশ করেন। সেগুলো হচ্ছে :
(১) নজর; থিউরি, তত্ত্বীয় দৃষ্টি, ভাবনার শৃঙ্খলা। এর মধ্য দিয়ে তত্ত্বীয় অবয়ব গঠন, পুনর্গঠন, পঠন, পুনর্পঠন- এই প্রক্রিয়ায় তত্ত্বীয় উন্নয়ন, নবসৃষ্টি ও জ্ঞানসৃষ্টি। ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত নানা বিষয় ও বাস্তবতাকে বিচারে এনে অতীত-বর্তমানের ঘটনার মূল্যায়ন করা। ইতিহাসকে শুধু পাঠ বা রচনা নয়, বরং পর্যালোচনা করা এবং কোনো ঘটনাকেই তার পূর্ববর্তিতা থেকে বিচ্ছিন্ন না করা।
(২) তাহকিক : যাচাই ও সত্য উদঘাটনমূলক ভাবনা ও জ্ঞানকর্ম। সত্য ও বাস্তবতায় উপনীত হওয়ার জন্য ক্রিটিক্যাল থিংকিং। কোনো কিছু প্রামাণ্য সূত্র পড়ে বা শুনে তদন্ত ও অনুসন্ধান করে তার পর গ্রহণ করা। ব্যাপারটিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করা। বাস্তব অনুসন্ধান, অভিজ্ঞতাবাদী বিচার, জ্ঞানের বিভিন্ন দিকের সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষণ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে মর্মবস্তু ও সত্যমূল্য অনুসন্ধান করতে হবে।
(৩) তালিল বা কারণ ও ফলাফল বিচার। যা প্রতিটি বিষয়ে- ‘কেন’গুলোর জবাব দেয়। কারণ ও ফলাফলের মিল ও অমিল বিশ্লেষণ করে। প্রতিটি বিষয় ও ঘটনার ডিজাইনের মধ্যে কারণ ও ফলাফল নিহিত রয়েছে। আবার প্রতিটি ঘটনা ও বিষয়ের কারণ ও ফলাফলের মধ্যে তার ডিজাইনের যোগসূত্র রয়েছে। ফলে কোন বিষয়, চিন্তা বা ঘটনাকে মূলীভূত সব কারণসহকারে দেখলেই তাকে বোঝার প্রথম ধাপ পার হওয়া যাবে। শেষ ধাপটা হলো তার সব রকমের ফলাফল ও পরিণতি বিশ্লেষণ করা। এই প্রক্রিয়া যত সামগ্রিক ও নিখুঁত হবে, একটি বিষয়ের সত্যচিত্র তত পরিষ্কার হবে।
(৪) মাবাদিয়ে দাকিক : সূক্ষ্ম, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ও অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ নীতিমালা; যা কারণ ও ফলাফলকে মেলানোর নীতি বাতলে দেবে। বিশ্লেষণের পথ দেখাবে। প্রয়োজনীয় সূত্র সৃষ্টি করবে। তত্ত্বের শাখা-প্রশাখার নবায়ন ও বিস্তারণ ঘটাবে। সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে শেখাবে এবং পদ্ধতির অভ্যন্তরীণ কাঠামোকে এমন বহুবিস্তারী বানাবে, যা যে কোনো ঘটনাকেই আতশকাচে হাজির করতে সক্ষম।
(৫) ইলমুল কাইফিয়াহ : প্রকরণগত জ্ঞান, শৈলী ও পদ্ধতিভিত্তিক বিজ্ঞান। ইবনে খালদুন এ জ্ঞানের পরিচয়ে লিখেছেন ইলমুন বি কাইফিয়াতিল ওয়াক্য; যা মূলত অন্তর্নিহিত সারবস্তু, বাস্তবতা, রহস্য ও মূলতত্ত্বকে অবগত করে। সে কারণগুলোর জানান দেয়।
(৬) আসবাবে আমিক : গভীরতর কার্যকারণ। এই গভীরতা এক স্থির, একমর্মী বা একধর্মী নয়। এতে রয়েছে কারণের কারণ, কারণের মৌলিক কারণ, শাখাগত কারণ, এমন কারণ, যা অন্য কারণের মধ্যস্থতায় কারণ হয়েছে, নিকট, মধ্যম ও দূরবর্তী কারণ, স্থায়ী কারণ, অস্থায়ী কারণ, ইচ্ছুক কারণ, অনিচ্ছুক কিংবা ইচ্ছেশূন্য কারণ, সূক্ষ্ম কারণ প্রভৃতি। এসব কারণও বহু শাস্ত্রে, বহু শাখায়, বহু স্থানে, বহু সময়ে বিস্তৃত থাকতে পারে। এগুলোকে বিবেচনা ও বিচারের বাইরে রেখে কোনো ঘটনা বা ইতিহাসের সঠিকতা অধ্যয়ন করা যাবে না, ইতিহাসের সত্যস্পর্শ করা যাবে না।
ইবনে খালদুনের এই প্রকল্প বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের নামে যাবতীয় টাল্টিবাল্টির উপর তাদমির ও তামিরের মিশন পরিচালনা করতে পারে।
তিন.
এখানে ইতিহাসের নামে রচিত রাশি রাশি গ্রন্থের স্তূপ হাজির থাকলে খালদুনীয় অন্তর্দৃষ্টি তার হাকিকত সম্পর্কে রায় দিয়ে দেবে। বলে দেবে, এসব ইতিহাস চর্চা জাহেরি ধারার না বাতেনি ধারার। এসব ইতিহাসচর্চা ইতিহাসের সত্যসন্ধানের কোন কোন শর্ত লঙ্ঘন করেছে অথবা কোন কোন সূত্রের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ করেনি।
এখানে ইতিহাসকাররা কেমনতরো ভুল করেছেন এবং কেন ভুল করেছেন। ঘটনাটি যে কালেই হোক; বখতিয়ার খিলজির ঘটনা, পলাশী বা অন্ধকূপের ঘটনা, ১৯৪৮ এর ঘটনা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক তর্ক, এখানে ভারতের ভূমিকা ও আমাদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের মাত্রা, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, যুদ্ধ ও বিজয়ের মূলীভূত উপাদানগুলো, বিশেষ ব্যক্তি, পরিবার ও দলের মনোপলি প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে প্রতিটি দরকারি প্রশ্ন ও প্রসঙ্গকে নির্মোহ আলোতে অবলোকন করা যায়। ব্যাপারগুলো বিচারিক কাঠামোর সুনির্দিষ্ট নীতির আওতায় বিশ্লেষিত হবে। এতে বাতেনি রূপটাই প্রাধান্য লাভ করবে। কারণ বাতেনি ইতিহাস জাহেরি ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বেশি প্রবল, বেশি বিস্তৃত ও শক্তিশালী। সে অতীতের ঘটনাবলির স্বরূপ উন্মোচনে কাজ শুরু করবে। যেকোনো ঘটনা কিংবা বিষয়কে ‘কিভাবে’(ঐড়)ি ও ‘কেন’ (ডযু) দ্বারা প্রশ্ন করে তার মূলের দিকে অগ্রসর হতে থাকবে নিজস্ব নিয়মে। সব ধরনের কারণ ও উপাদানকে সে মূল্য দেবে। কাউকে এখানে প্রাপ্যের অধিক মূল্য দেয়া চলবে না। প্রাপ্যের কম মূল্য দিলেও মুশকিল।
অধিবিদ্যায় এরিস্টটল কথিত উপাদানগত কারণ, আকারগত কারণ, কার্যকরী কারণ এবং উদ্দেশ্যমূলক কারণ যেমন বিশ্লেষিত হয়, তেমনি ইবনে খালদুনের পরামর্শ মেনে জুলাইকে ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বে নিজস্ব বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সব ধরনের কারণের প্রতি তার প্রাপ্য অনুযায়ী মনোযোগ দিতে হবে। তবে এরিস্টটলের বিশ্লেষণ ভাবের জিনিস, তা ধারণাপ্রধান, ইবনে খালদুনের বিশ্লেষণ বাস্তব জগতের জিনিস ও পরীক্ষাপ্রধান। বস্তুত বিশ্লেষণকে ধারণার শাসন থেকে মুক্তি দিয়ে বাস্তব পরীক্ষার জগতে নবজন্ম দান করতে হবে।
এখানে নানামুখী তথ্য-উপাত্ত, বিস্তর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নিয়ে এগোতে হয়। কাণ্ডজ্ঞান ও গভীর অন্তর্দৃষ্টি কাজে লাগিয়ে মিথ্যা বিবরণের কুহক, রক্তচক্ষু ও মায়াজাল থেকে সুরক্ষা পেতে হয়। মিথ্যা শনাক্ত করতে হয়। সত্যের সাথে মিশ্রিত মিথ্যাকেও আলাদা করতে হয়। ইতিহাসের যে কোনো শাখায় ইতিহাসের নামে প্রচলিত বহুব্যক্ত, বহুশ্রুত যেকোনো জঞ্জাল সাফ করতে হয়।
একটি সুস্থির সত্যে উপনীত হওয়ার যথাযথ ও বিশ্বাসযোগ্য ভাষ্য নিশ্চিত করতে হয়। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তাই ইবনে খালদুন চ্যালেঞ্জ করেন বহু উদ্ধৃত, বহু ব্যক্ত বহু রটনাকে। এক রটনার দাবি হলো ইবরাহীম আ: ৭০ হাত লম্বা ছিলেন। ইবনে খালদুন লিখেন আমি বায়তুল মাকদিসে গিয়েছি বহুবার। ইবরাহিম আ:-এর কবর দেখেছি বারবার। তার কবর তো এত লম্বা নয়!
বহুব্যক্ত, বহুশ্রুত একটা রটনা হলো উজ ইবনে উনুক খুবই লম্বা ছিলেন। তিনি মাছ ধরে উপরের দিকে তুলে রাখতেন। সূর্যের তাপে তা সিদ্ধ হয়ে যেত। ইবনে খালদুন সৌরবিদ্যার সত্য দিয়ে এটি খারিজ করলেন। কারণ তাপ মাটির সাথে যুক্ত। কেউ যত উপরে যাবে, ততই মুখোমুখি হবে শীতলতার।
জুলাইকে প্রশ্ন করতে হবে, যিনি যুদ্ধটা দেখেন নেই, যুদ্ধে অংশ নেন নেই, নিজের তরফে স্পষ্ট ঘোষণাটাও দেন নেই, বরং শত্রুর কাছে করেছেন আত্মসমর্পণ, তিনি কিভাবে যুদ্ধের আসল নায়কের কৃতিত্ব পেতে পারেন? কিভাবে একটা মরিয়া যুদ্ধে ধর্মীয় প্রেরণা ও চেতনা অনুপস্থিত থাকলে ধর্মপ্রাণ মানুষেরা জীবন দেয় পঙ্গপালের মতো? কিভাবে বিসমিল্লাহ, ইনশা আল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, নারায়ে তাকবির ইত্যাদি যুদ্ধকালে মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে অনবরত হাজির থাকার পরও ইসলামী সব অনুষঙ্গ মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষে খাড়া করা হয়?
আমাদের ইতিহাসেও লাখ লাখ মৃত্যু ও ধর্ষণের বিবরণী আছে। বহু কণ্ঠস্বর ও কলম তার পুনরোল্লেখ করেছে। এতে তাকে প্রশ্ন করার ন্যায্যতা শেষ হয়ে যায় না। বরং আরো গুরুত্বসহ তা হাজির হয়।
ফলে ইবনে খালদুন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বিতর্কগুলোকেও মোকাবেলা করেন। ধরা যাক তার সামনে হাজির করা হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভাষ্যগুলো। বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ভাষ্য এবং ভারতীয়, আমেরিকান, রুশ, চীনা বা পাকিস্তানি ভাষ্য। দেখা যাবে এগুলো পরস্পর থেকে কত আলাদা। কিন্তু কেন? ইবনে খালদুন এখানে প্রয়োগ করবেন জাহেরি ইতিহাস রচনা ও বিকৃতির সূত্রগুলো। এত সব ভাষ্যের মধ্যে সঠিকতা কোথায়? ইবনে খালদুন একজন বাংলাদেশী বা বাঙালি জাতীয়তাবাদী হয়ে কথা বলবেন না। তিনি এখানে প্রয়োগ করবেন ইতিহাসের তা’মিরের বাতেনি সূত্রগুলো।
সূত্রগুলোই বলে দেয়, কোথায় ভুল বলা হচ্ছে, কেন বলা হচ্ছে, কিভাবে বলা হচ্ছে? তিনি দেখবেন-
(ক) ইতিহাস রচনায় লেখক কোন ঝোঁকপ্রবণতা বা পক্ষপাত দ্বারা পীড়িত কি না?
(খ) তিনি আপন আদর্শ দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা চালিত ও শাসিত হয়ে ইতিহাস লিখছেন নাকি ঐতিহাসিকের নির্মোহ অবস্থান থেকে লিখছেন?
(গ) পূর্ববর্তী লেখক ও বর্ণনাকারীদের ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন? কারো প্রতি অন্ধ বিশ্বাস আছে কি না? সেটা থাকলে তিনি দৃষ্টিশক্তিহীনের মতো তার বা তাদের আনুগত্য করবেন।
(ঘ) ঘটনাগুলো যারা যেভাবে লিখেছেন, তাদের রচনা ও ন্যারেটিভ কোনো উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত? কোন লক্ষ্যের লাগাম কি ছিল তার কলমে? কোন উদ্দেশ্য চালিত করেছে তার রচনা বিস্তার ও উপসংহারকে? তার রচনা থেকে এর কী কী লক্ষণ ধরা পড়ে? যিনি ইতিহাস লিখছেন, তিনি পূর্ববর্তী বিবরণদাতাদের এসব বিষয় যাচাই করেন কি না, এসব বিষয়ে তিনি উদাসীন না সচেতন?
(ঙ) যিনি ইতিহাস লিখছেন, তিনি অতীতের ঘটনার সাথে বর্তমানের দৃশ্যপট ও সমগোত্রীয় বিষয়কে মিলিয়ে দেখতে সক্ষম কিনা? তিনি অবর্তমানের সাথে বর্তমানের যোগসূত্র সন্ধানে কতটা পক্ষপাতী আর কতটা সত্যসন্ধানী? কতটা নির্মোহ ও দক্ষ আর কতটা প্রোপাগান্ডিস্ট ও আরোপী?
(চ) যিনি ইতিহাস লিখলেন, তিনি কি পূর্বানুমান দ্বারা পীড়িত, চালিত, প্রভাবিত? এসব অনুমানের ছায়ায় বসে তিনি ইতিহাস লিখছেন, না ঐতিহাসিকের দায় ও নিষ্ঠা তাকে পূর্বানুমান থেকে নিরপেক্ষতা দিয়েছে?
(ছ) যিনি ইতিহাস লিখছেন, তিনি কি ক্ষমতাসীন শক্তির মোসাহেবি করেন? তাদের থেকে সুবিধা কামনা করেন? তাদের নৈকট্য লাভ ও বৃদ্ধির জন্য তিনি কি স্তুতিবৃত্তি করে ঘটনার বিবরণে অতিরঞ্জন ঘটান?
(জ) ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন জ্ঞান ও শাস্ত্রের সাথে তার যোগাযোগ কতটা? তিনি কি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সাথে যুক্ত অন্যান্য জ্ঞান ও শাস্ত্রের সহায়তা নিয়ে সত্য উন্মোচনের পথে হাঁটতে পারেন? তার প্রজ্ঞা কি তাকে বিচারিক দক্ষতা সরবরাহ করে? তিনি কি ঘটনার সাথে পূর্ববর্তী ঘটনার যোগসূত্র সন্ধানে সক্ষম? বিভিন্ন সংস্কৃতি, নানা সভ্যতা ও রীতি-নীতি, ভৌগোলিক অবস্থা ও বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ভাষা, প্রথা, সমসাময়িক বাস্তবতা, রাজনীতি, অর্থনীতি, মূল্যবোধ, বিবিধ পক্ষ-প্রতিপক্ষ, স্বার্থ-প্রতিস্বার্থ, মতবাদ-প্রতিমতবাদ ইত্যাদির সক্রিয় ভূমিকা ও মাত্রাগুলো সম্পর্কে তিনি কি জ্ঞানীয়ভাবে সচেতন? তিনি কি এসব বিষয়ে ফাঁক ও ফাঁকি ধরতে সক্ষম? ইতিহাসের বিবরণীতে মিথ্যার অনুপ্রবেশের আশঙ্কাজনক দিকগুলোর সাথে তিনি কি দায়িত্বশীল আচরণ করেন?
(ঝ) যিনি ইতিহাস লিখছেন, তিনি কি নির্ভরযোগ্য লেখক বা বর্ণনাকারীর অনুকারিতায় আবদ্ধ? নাকি তিনি বক্তব্যের বস্তুনিষ্ঠতা তলিয়ে দেখেন?
ইবনে খালদুনের প্রকল্প ও মানদণ্ডে বাংলাদেশের ইতিহাসের তাদমির না করলে এই অভ্যুত্থান পূর্ণতা পাবে না আর তা’মির না করলে সে বিপ্লবে রূপায়িত হবে না।
লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা