জুলাই বিপ্লবীদের সম্মান ও নিরাপত্তা
- ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) রুকন উদ্দিন
- ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
একটি জাতির ইতিহাস রচিত হয় তার সাহসী সন্তানদের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের মাধ্যমে। যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে, স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে জাতিকে মুক্তির পথ দেখান, তাদের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকে। জুলাই বিপ্লবের সাহসী সন্তানরা তেমনই এক ইতিহাসের অংশ, যারা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন আমাদের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে। কিন্তু আজকের বাস্তবতা আমাদের গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করছে- এ বীরদের সাহস, আত্মত্যাগ ও সংগ্রামকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা চলছে। তাদের নিরাপত্তা চরমভাবে হুমকির সম্মুখীন।
জুলাই বিপ্লবে তরুণ ছাত্ররা নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে দেশ ও জাতির মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন। কিছু মহল তাদের সংগ্রামের গুরুত্ব কমিয়ে দেখানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত। বিভিন্নভাবে তাদের ত্যাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। তাদের ঐক্য বিনষ্টের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। তাদের অনেকে এখনো সেই আন্দোলনের জন্য ভোগান্তির শিকার, অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
দেশের শত্রুরা সবসময় সক্রিয় থাকে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করতে। একই সাথে বীরদের ইতিহাস মুছে ফেলতে চায়। তাই এখনই সময়, জাতি হিসেবে আমাদের দায়িত্ব পালনের- এই বিপ্লবী সন্তানদের যথাযথ সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
জুলাই বিপ্লবের অনেক মুরব্বি ও নীতিনির্ধারক হয়তো প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা রক্ষা করেননি। কিছু মহল তাদের ভুলপথে পরিচালিত করার চেষ্টা করছে, বিভ্রান্ত করছে এবং তাদের প্রকৃত লক্ষ্য থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাচ্ছে। জাতির ভবিষ্যৎ তরুণদের হাতে। যদি তারা পথভ্রষ্ট হন, তবে জাতির অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। সঙ্গত কারণে আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীদের উপহাসের পাত্রে পরিণত হতে দেয়া যায় না। তাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। একটি শক্তিশালী প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করার পথ রচনা করতে হবে, যাতে তারা ভবিষ্যতেও জাতীয় স্বার্থে লড়াই করতে পারেন।
ঐক্যবদ্ধ শক্তি সাধারণত পরাজিত হয় না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, একতা থাকলে যেকোনো স্বৈরাচারী শক্তি পরাজিত হয়। তাই, জুলাই বিপ্লবের সাহসী সন্তানরা যদি নিজেদের শক্তিশালী প্রেসার গ্রুপে পরিণত করতে পারেন, তবে তারা ভবিষ্যতে জাতীয় সঙ্কটময় মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন।
ইতিহাস সাক্ষী, যখন কোনো পরিবর্তনের আন্দোলন সফল হয়, তখনই তার নেতাকর্মীদের বিভিন্নভাবে দমন-পীড়নের শিকার হতে হয়। কিছু মহল তাদের ভয় দেখাতে চায়, হুমকি দেয়, এমনকি শারীরিক ও মানসিকভাবে হয়রানির অপচেষ্টাও চালায়। তাই, নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে তাদের সংগঠিত হতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন। একটি নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। সবাইকে আইনগত সচেতন হতে হবে। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনের সাহায্য নিতে হবে, প্রশাসনের কাছে নিরাপত্তার দাবি জানাতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা রক্ষা করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা ইলেকট্রনিক ডিভাইসে নজরদারির শিকার হওয়া এড়াতে সতর্ক থাকতে হবে। তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। আত্মরক্ষার কৌশল শিখতে হবে। যদি কেউ শারীরিকভাবে আক্রমণ করে বা ক্ষতি করতে চায়, তার মোকাবেলা করতে আত্মরক্ষার কৌশল জানা দরকার।
জুলাই বিপ্লব ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা চলছে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ বিপ্লবের প্রকৃত চেতনা ভুলে যায়। ভুল তথ্য দিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করা যায়। এ ধরনের অপচেষ্টা রুখতে প্রামাণ্য তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে। যারা সেই সময়ের সাক্ষী, তাদের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করতে হবে। সঠিক তথ্য প্রচার করতে হবে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গবেষণার মাধ্যমে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে হবে। বিকৃত তথ্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। কেউ যদি মিথ্যা প্রচার করে, তাহলে সেটির বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নিতে হবে। তথ্য-প্রমাণসহ তা খণ্ডন করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন ভুল ইতিহাস না শেখে, সে জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং পারিবারিক পর্যায়ে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে।
যেকোনো বড় আন্দোলনের পর শুরু হয় ষড়যন্ত্র। যারা ক্ষমতা হারিয়েছে বা স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে চায়। বদনাম করতে চায়। এমনকি ভিন্নপথে পরিচালিত করার ষড়যন্ত্র চালায়। এ ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে দৃঢ় মনোবল রাখতে হবে। কোনো মিথ্যা প্রচার বা ষড়যন্ত্র যাতে আন্দোলনকারীদের বিভ্রান্ত করতে না পারে, সে জন্য মানসিকভাবে দৃঢ় হতে হবে।
বিশ্বাসঘাতকদের চিহ্নিত করতে হবে। অনেকসময় শত্রুরা গোপনে নিজেদের এজেন্ট পাঠায়, যারা অভ্যন্তরে থেকে বিভেদ তৈরি করে। এদের চিহ্নিত করা এবং সতর্ক থাকা জরুরি। গোপন তথ্য ফাঁস হওয়া রোধ করতে হবে। কোনো ষড়যন্ত্র যাতে সফল না হয়, সে জন্য নিজেদের পরিকল্পনা ও কর্মকৌশল গোপন রাখতে হবে। জনসমর্থন বাড়াতে হবে। জনগণের সমর্থন থাকলে ষড়যন্ত্র সফল হতে পারে না। তাই জনগণের কাছে প্রকৃত তথ্য পৌঁছে দিয়ে তাদের পাশে রাখতে হবে।
গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন কখনো শেষ হয় না। একবার স্বৈরাচার পতন হলেই যে দেশ চিরকাল গণতান্ত্রিক থাকবে, তা নয়। তাই জাতীয় স্বার্থে সবসময় প্রস্তুত ও সজাগ থাকতে হবে, যাতে ভবিষ্যতেও অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো যায়। এ ধরনের গণতান্ত্রিক আন্দোলন সফল করতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা করতে হবে।
আন্দোলনের নেতাদের স্বচ্ছতা, সততা ও গণতান্ত্রিক চেতনা থাকতে হবে। সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে হবে। গণতান্ত্রিক আন্দোলন যেন সহিংসতামুক্ত থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সহিংস হলে জনগণের সমর্থন হারানোর ঝুঁকি থাকে। আইনগত ও কৌশলগত প্রস্তুতি থাকতে হবে। আন্দোলন পরিচালনায় আইনি কাঠামো জানা গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো প্রতিবাদ ও আন্দোলন যেন আইনসম্মতভাবে হয়, সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
একটি জাতির ভবিষ্যৎ তার শিক্ষিত জনগণের হাতে থাকে। শুধু আন্দোলন করলে দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না; নেতৃত্ব গ্রহণে যোগ্যতা অর্জন করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই, শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে হবে এবং তা অর্জনে মনোযোগ দিতে হবে। নেতৃত্বের জন্য জ্ঞানার্জন করতে হবে। ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনায় শুধু সাহস থাকলে হবে না, যোগ্যতাও থাকতে হবে। তাই রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতে হবে। ব্যক্তিগত দক্ষতা বাড়াতে হবে। শুধু অ্যাকাডেমিক শিক্ষা নয়, নেতৃত্বের জন্য যোগাযোগ দক্ষতা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জন করা আবশ্যক। আন্তর্জাতিক বিষয়াবলিতে অভিজ্ঞতা নিতে হবে। বিশ্বরাজনীতি, কূটনীতি, অর্থনীতি সম্পর্কে জানা থাকলে জাতীয় স্বার্থরক্ষায় ভূমিকা রাখা সহজ হয়। প্রযুক্তিতে দক্ষ হতে হবে। এর ব্যবহার শিখতে হবে। বর্তমান যুগ প্রযুক্তিনির্ভর। তাই তথ্যপ্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো বিষয়গুলোর ওপর দক্ষতা অর্জন করা দরকার। সাহসী ছাত্রছাত্রীদের উচিত নিজেদের পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়া, যাতে ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্বে আসতে পারেন। ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই চালিয়ে যেতে পারেন। যারা তাদের বিতর্কিত করতে চায়, তাদের অন্যতম হাতিয়ার অজ্ঞতা ও ভুল তথ্য। যদি শিক্ষার মাধ্যমে সত্যিকারের ইতিহাস ও প্রকৃত দর্শন জানা যায়, তাহলে কেউই সহজে বিভ্রান্ত করতে পারবে না।
সরকারের অন্যতম দায়িত্ব হলো দেশের সাহসী সন্তানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতায়ও তা জরুরি। তাদের সঠিকভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, ইতিহাস বিকৃতির অপপ্রয়াস বন্ধ করা এবং তাদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি দেয়া।
জুলাই বিপ্লবের সাহসী সন্তানদের রক্তের দামে আমাদের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের শত্রুরা সবসময় আমাদের সাহসী বীরদের ক্ষতি করতে ও জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করতে সচেষ্ট। তাই, জাতি হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো- এ সত্যিকারের বীরদের যথাযথ সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। জুলাই বিপ্লবের সাহসী সন্তানদের লড়াই এক দিনে শেষ হওয়ার নয়। তারা দেশের জন্য বড় একটি আত্মত্যাগ করেছেন, সেই লড়াইয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা প্রয়োজন। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ইতিহাস রক্ষা করা, ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করা, জাতীয় স্বার্থে গণতান্ত্রিক আন্দোলন পরিচালনা করা এবং ভবিষ্যতের নেতৃত্বের জন্য শিক্ষিত হওয়া- এ পাঁচটি দিকের প্রতিটির ওপর সমান গুরুত্ব দেয়া দরকার। এ প্রজন্মের ওপর নির্ভর করছে আগামী দিনের বাংলাদেশ। যদি তারা সঠিক পথে থাকে, তাহলে জাতি উপকৃত হবে; তারা যদি বিভ্রান্ত হয়, তাহলে জাতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তাই এখনই সময়, ঐক্যবদ্ধভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার এবং জাতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখার।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা