০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৯ মাঘ ১৪৩১, ২ শাবান ১৪৪৬
`

পশ্চাৎপদ বয়ান, ইসলাম ও সাম্প্রদায়িকতা

-

ব্রিটিশ শাসনপূর্ব গোটা ভারতীয় অঞ্চলে প্রায় ৮০০ বছর সাম্প্রদায়িকতার তেমন নজির নেই। ধর্মীয়, গোত্র ও জাতিগত দাঙ্গার ইতিহাস নেই। ভারত ভূখণ্ডে ব্রিটিশ আর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িতা আমদানি করে। দুই গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য এক ছিল। ক্ষমতা কুক্ষিগত এবং দীর্ঘায়িত করা। এ জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নস্যাৎ এবং এক ধর্মের লোকদের অন্য ধর্মের লোকের প্রতিপক্ষ বানানো, ভাগ করা ও ঐক্য বিনষ্ট করার অপপ্রয়াস সবসময় ছিল।
সাম্প্রদায়িকতার কার্ড খেলে ১৯০ বছর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল ব্রিটিশ। আর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ভোটব্যাংক ঠিক রাখতে বরাবর সাম্প্রদায়িকতার জিগির তুলে এক দিকে প্রতিবেশী দেশকে খুশি রেখেছে, অন্য দিকে একই ভাষা-সংস্কৃতির একটি জাতির দু’টি ধর্মের মানুষের মাঝে বিবেদ-পারস্পারিক অবিশ্বাস ছড়াতে সর্বদা অপচেষ্টা করেছে। কখনো সফল হয়েছে। কখনো এসব দুর্মুখের পরিকল্পনার যে অংশ, তা স্পষ্ট হয়েছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে মৌলিক তিনটি বিষয়ের সুস্পষ্ট ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও দুর্মুখরা শুরুতেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিচালনাতন্ত্রে চতুরতার সাথে সেক্যুলারিজম (ধর্মনিরপেক্ষতা), সমাজতন্ত্রকে আমদানি করে। এর মাধ্যমে বিবেদ উসকে দেয়া হয়। পৌত্তলিক সংস্কৃতির বিস্তার ও জড়বাদী শিক্ষার প্রসার ঘটায়। ভোটব্যাংকের রাজনীতি এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের সমর্থন আদায়ে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ধর্ম ইসলামকে নিশানা করা হয়। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রঙ দিতে ইসলামপন্থী ব্যক্তিত্ব ও দলগুলোকে সাম্প্রদায়িক দল-গোষ্ঠী হিসেবে চিত্রিত করার অপচেষ্টা চলে। শুধু তাই নয়, ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে দাঁড় করানোর অপপ্রয়াস আওয়ামী লীগ ও তার দোসর রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়মিত এজেন্ডা হয়ে দাঁড়ায়। তারা দেশে-বিদেশে নানা মাধ্যমে একপ্রকার নেরেটিভ (বয়ান) তৈরিতেও সক্ষম হয়। ঐতিহ্যগতভাবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ এভাবে কৃত্রিম সাম্প্রদায়িকতার জিগির এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের বয়ান জারি রাখে। চব্বিশের বিপ্লবের পরও তারা এ ধারা থেকে বের হতে পারেনি; বরং এটি এখন তাদের রাজনৈতিক অপকৌশলের প্রধান অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, ইসলামপন্থা রাজনীতি ও ইসলামপন্থীদের নিয়ে আওয়ামী লীগের চিরাচরিত এ বয়ান এখনো কোনো কোনো রাজনীতিবিদের বেশ পছন্দ। জুলাইয়ের রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানের পর যখন রাজনৈতিক এবং জাতীয় ঐক্যের ডাক এলো তখন হঠাৎ পশ্চাৎপদ এ বয়ানকে কিছু রাজনীতিবিদের কেন ধারণ করতে হচ্ছে; তা-ই এখন বড় প্রশ্ন। এটি আমাদের কাছে বোধগম্য নয়।
ভৌগোলিক মানচিত্রে মুসলিম বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশ। অমুসলিম ভূমিবেষ্টিত বাংলাদেশ থেকে ইসলাম মাইনাস বা দুর্বল করতে পারলে বাংলাদেশ নামের সার্বভৌম রাষ্ট্র যে থাকবে না, এ ঐতিহাসিক সত্য উপলব্ধি করতে সোকল্ড ক্ষমতালোভী ও তাদের অনুসারী-সমর্থকরা বরাবর ব্যর্থ হয়েছেন এবং হচ্ছেন। মুসলিম জাতীয়তাবাদের দর্শন ধারণ করে ভারত-পাকিস্তান আলাদা হয়েছে। ইসলাম ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ভিত্তি ধরে ব্রিটিশরা, রেডক্লিপরা এ ভূমি ভারত থেকে আলাদা করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানভুক্ত করেছে। ইতিহাসবিদদের অনেকে এই বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন যে, পাকিস্তানের জন্ম না হলে এবং আজকের বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ না হলে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পরাধীন বাংলা আজও পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হতে পারত না। যেমন-পশ্চিম বাংলা সর্বভারতীয় সংস্কৃতিতে লীন হয়েছে।
দ্বি-জাতিতত্ত্ব এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন পাকিস্তানভুক্ত হয়। পাক শাসনের বৈষম্য, জনগণের রায় অমর্যাদা ও প্রত্যাখ্যানের ফলস্বরূপ রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে একাত্তরে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে পৃথক স্বাধীন দেশ হিসেবে আভির্ভূত হয়। ১৭৫৭ সালে ঘসেটি বেগম, মীরজাফর, জগৎশেঠ, উমি চাঁদরা আমাদের স্বাধীনতা ব্রিটিশ বেনিয়াদের হাতে তুলে দেয়। বাংলার মানুষকে ১৯০ বছরের গোলামির জিঞ্জির পরায়। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুনের আগ পর্যন্ত আমরা স্বাধীন ছিলাম। ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির বঙ্গবিজয় এবং এর ধারাবাহিকতায় ১৩৫২ সালে শামসুদ্দিন মুহাম্মদ ইলিয়াস শাহের বাংলা সালতানাত প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চল স্বাধীন ভূমি, স্বাধীন রাষ্ট্র-রাজ্য হিসেবে গড়ে ওঠে।
গোটা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যাসহ পূর্ব-উত্তর ভারতের আজকের সেভেন সিস্টার্স ও আরাকান মুহাম্মদ শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের প্রতিষ্ঠিত বাংলা সালতানাতের অধিভুক্ত স্বাধীন ভূমি ছিল। নেপাল ও ভুটানের দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল ভূমিও বাংলা সালতানাতের অধীনে ছিল। সেই সময় পুরো পৃথিবীর মোট জিডিপির ১২ শতাংশ ছিল বাংলা সালতানাতের। শিক্ষা, প্রগতি, উন্নয়ন, সমৃদ্ধি অর্জনে ইলিয়াস শাহ এবং তৎপরবর্তী রাজা, সম্রাট, নবাবদের শাসনামলে বাংলা সালতানাত গোটা পৃথিবীর কাছে ঈর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর এ অঞ্চল ছিল অসাম্প্রদায়িক এক সম্প্রীতির মেলবন্ধন। ইলিয়াস শাহের রাজ্যক্ষমতায় মুসলিমসহ সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। এ সময়ে গোটা অঞ্চলে ইসলামের প্রসার ও মুসলমানের আধিক্য বাড়তে থাকে। পরবর্তী সময়ে ধীর ধীরে নানা পটভূমিতে আজকের বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাধিক্যে পরিণত হয়। সেই সময়ে বাংলা ভাষার অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি ও উন্নতি সাধিত হয়। বাংলা সালতানাতের প্রায় আড়াই শ’ বছরের শাসনামলে বাংলা পৃথিবীর অন্যতম ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
ইসলামে উগ্রতা, চরমপন্থা ও জঙ্গিপনা নিষিদ্ধ। এসব পবিত্র আল-কুরআনের নির্দেশনা বিরোধী। মুসলিমরা কুরআন নির্দেশিত মধ্যমপন্থার জাতি। বাংলাদেশের মানুষ শতাব্দীই নয়, সহস্রাব্দ ধরে তা মেনে চলেছে এবং প্রমাণ করেছে। হিন্দু-বৌদ্ধ এমনকি খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এ অঞ্চল শতাব্দীর পর শতাব্দী শাসন করেছেন মুসলিম শাসকরা। মুসলিম সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, সভ্যতা ও সংস্কার এবং মুসলিম শাসকদের উদারতা দেখে এ অঞ্চলে ধীরে ধীরে মুসলমানের সংখ্যা বাড়তে থাকে। যাদের পূর্বসূরিরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অন্য ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।
তিন দিকে বিশাল ভারতবেষ্টিত বাংলাদেশে ইসলাম না থাকলে স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সীমান্ত বলে কিছু থাকবে না। আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, আত্মমর্যাদা ও অখণ্ডতার রক্ষাকবচ ইসলাম। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ও ইসলাম অধ্যুষিত অঞ্চল হওয়া ব্যতীত বাংলাদেশের সাথে ভারতের অন্য কোনো অসামঞ্জস্যতা নেই। দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হিসেবে দুর্মুখরা তাই ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের নিশানা করে তাদের মিশন বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছিল। চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থান তাদের সেই অপপ্রয়াসকে আপাতত কবর দিয়েছে।
আজ সব ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠীর সমমর্যাদা, ইনসাফ, মানবাধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ঈর্ষা-বিদ্বেষ কবর দিয়ে সমতা, সমৃদ্ধি ও প্রগতির বাংলাদেশ নির্মাণে সব পক্ষকে যতœশীল হতে হবে। একটি জনগণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত ও বৈষম্যহীন সমাজ-রাষ্ট্র গঠনে আমাদের অঙ্গীকার করতে হবে, ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, যা সময়ের দাবি।
লেখক : সাংবাদিক ও সংগঠক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
সিরাজগঞ্জে নদীতে ডুবে ৩ কলেজছাত্র নিখোঁজ, একজনের লাশ উদ্ধার ইংল্যান্ডের ক্লাব এসেক্সে ডাক পেলেন শরিফুল উজিরপুরের সন্ধ্যা নদী থেকে ট্রলার চালক মাহাবুল নিখোঁজ লিবিয়া উপকূলে ২০ লাশ উদ্ধার, সবাই বাংলাদেশী হওয়ার আশঙ্কা জাকসু নিয়ে ছাত্রদল-শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি অবস্থান কর্মসূচি, বিক্ষোভ মিছিল রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতে ৩১ দফার বিকল্প নেই : রহমাতুল্লাহ ইজতেমায় দুই দিনে ৪ জনের মৃত্যু সুরভি'র ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন রংপুরে ছাত্র আন্দোলনে নিহত মুন্না হত্যা মামলায় যুব লীগ নেতা গ্রেফতার ১৮ ফুটবলারকে ডেকেছে কমিটি ড্রামের খোলা ভোজ্যতেল জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি

সকল