০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১, ১ শাবান ১৪৪৬
`

ফ্যাসিস্টবিরোধীদের খোঁচাখুঁচিতে শঙ্কা

-


কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলছে না। বলতে গিয়ে কথার মধ্যে সম্মান-শ্রদ্ধার লেশমাত্র থাকছে না প্রায়ই। সেই সাথে কারো কারো বডিল্যাঙ্গুয়েজও আপত্তিজনক। কখনো কখনো সরকারকেও পক্ষ করে ফেলা হচ্ছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেই ফেলেছেন, অন্তর্র্বর্তী সরকার নিরপেক্ষ না থাকলে নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হতে পারে। অন্তর্র্বর্তী সরকার যেন নিরপেক্ষতা বজায় রাখে সেই আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। মোট কথা, অন্তর্র্বর্তী সরকার নিরপেক্ষ নয়- এ কথা বলতে বাকি রাখেননি। সরকারটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র ও তাদের রাজনৈতিক সংগঠন নাগরিক কমিটির প্রতি পক্ষপাত করছে- এটিই তার মূল অভিযোগ।
মির্জা ফখরুলের এমন কথার প্রতিক্রিয়া দিতে দেরি করেননি সরকারের পার্ট, সরকারের শরিক ছাত্রদের প্রতিনিধি তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। বিএনপি মহাসচিবের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে বলে অভিযোগ করেছেন নাহিদ। ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যে সামনে আরেকটা ওয়ান-ইলেভেন সরকার, সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা এবং গুম-খুন ও জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার আভাস রয়েছে। নাহিদ ইসলামের পোস্ট শেয়ার করে সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, আন্দোলনের ডাক দিয়ে, যারা মাঠ থেকে সরে যেত, তারাই আঁতাতের রাজনীতি করছে।

যেকোনো বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতাকেন্দ্রিক লড়াই হয় বিপ্লবীদের মধ্যে। এটি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। বিভিন্ন মত ও পথের মানুষ বিপ্লবে শামিল হওয়ায় এমনটি হয়ে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হয়েছে। বিপ্লবের পর বিভাজন রেখা স্পষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এই স্বাভাবিক ঘটনা, এই বিভাজন এড়িয়ে যেতে পারাটাই কাক্সিক্ষত। সেখানে বড় হতাশা। তাদের এ বাহাস ও খোঁচা-খোঁটা চলমান রাজনীতিতে নতুন ঝড়-ঝঞ্ঝার শঙ্কা জাগাচ্ছে। নিজেদের মধ্যে বিবাদের পাশাপাশি ফ্যাসিস্টদের ফিরে আসার পথঘাট তৈরি হচ্ছে বলেও আভাস পাচ্ছেন রাজনীতির বোদ্ধারা। মির্জা ফখরুল যুক্তিগ্রাহ্যভাবেই কথা বলেছেন; যেহেতু ছাত্ররা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করছে। এখানে সরকারে যদি ছাত্রদের প্রতিনিধি থাকে, তাহলে তো সরকার নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না। তা রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেবে না। বলা চলে, এটি সরকারকে সতর্কবার্তা বা এক ধরনের প্রেশারে রাখার বক্তব্য। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের কাছে তা এরকম নয়। তাদের জবাব আক্রমণাত্মক।

ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম লিখেছেন, ওয়ান-ইলেভেনের বন্দোবস্ত থেকেই আওয়ামী ফ্যাসিজমের উত্থান ঘটেছিল। তাই বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যে সামনে আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন সরকার, সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা এবং গুম-খুন ও জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার আভাস রয়েছে বলে মনে করছেন নাহিদ ইসলাম। তিনি আরো লিখেন, ছাত্র এবং অভ্যুত্থানের নেতৃত্বকে মাইনাস করার পরিকল্পনা ৫ আগস্ট থেকেই শুরু হয়েছে। ৫ আগস্ট যখন ছাত্র-জনতার রাজপথে লড়াই চলছিল, পুলিশের গুলি অব্যাহত ছিল তখনো আপসকামী অনেক জাতীয় নেতা ক্যান্টনমেন্টে জনগণকে বাদ দিয়ে নতুন সরকার গঠনের পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিলেন। সমগ্র বিএনপি এই অবস্থান নিয়েছে বলে মনে করেন না তিনি; বরং বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের বড় অংশই অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন চায়। নাহিদের পোস্ট নিজের ফেসবুক ওয়ালে শেয়ার করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আলোচিত কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। তিনি বলেছেন, আন্দোলনের ডাক দিয়ে যারা মাঠ থেকে সরে যেত, তারাই আঁতাতের রাজনীতি করছে। এর আগে, মুজিববাদ-জিয়াবাদ উল্লেখ করে বিএনপি-আওয়ামী লীগকে এক কাতারে বিবেচনা করা হয়েছে।

এদিকে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যেও এখন একাধিক গ্রুপিং। ছোটখাটো সঙ্ঘাতও বেধেছে তাদের মধ্যে। বাংলামোটরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় অফিসে হামলা, মারামারি হয়েছে। এর পূর্বাপরে, ভেতরে-বাইরে রয়েছে নানা অঘটন। নমুনাও ভালো নয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এখন সর্বজনীন কোনো সংগঠন কিনা- প্রশ্ন। রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মীদের অনেকেই এ প্ল্যাটফর্ম ছেড়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানে সবচেয়ে ঝুঁকি নেয়া ছাত্ররা কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় পড়ে যায় কি না, এমন জিজ্ঞাসার মধ্যে একটু একটু জবাবও মিলছে। বিপ্লব বা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে তাদের কেবল শিক্ষাজীবন নয়, জীবনই ‘নাই’ হয়ে যেত। তাদের সেই শক্তি এখন আর অটুট নেই। জাতীয় নাগরিক কমিটি নামে তাদের যে অংশটি নতুন দল গঠনে মাঠে সক্রিয় তাদেরও রয়েছে অনেক অব্যক্ত কথা। জাতীয় নাগরিক কমিটি জুলাই ফাউন্ডেশন সম্পর্কে যে অভিযোগ করেছে তাও গুরুতর। ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক পদ ছেড়ে দিয়েছেন আলোচিত আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম। এর কারণ হিসেবে বলেছেন, তিনি এখন আর এ কাজে সময় দিতে পারছেন না। পুরো বিষয়টিই গোলমেলে। অথচ তারা বিশ্বময় আলোচিত-প্রশংসিত। দেশেও সমাদৃত-আদরণীয়। সেই সাথে বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্ট। এমন একটি গরম সময়ে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের ফ্রন্টলাইনার শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভেদ। আবার আন্দোলনের মাঠকে বিজয়ের উপযুক্ত করে দেয়ার সুপার পাওয়ার বিএনপির সাথেও তাদের বিরোধ। এর মধ্যে অদৃশ্য সুতার টান ধারণা করছেন কেউ কেউ। সেটিও আবার নির্বাচনী ট্রেনের হুইসেল বাজার সময়ে।

বিএনপি বলছে, সরকারে নিজেদের প্রতিনিধি রেখে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেবে না।
গণতান্ত্রিক সমাজে নিজের মত প্রকাশ করার ও দল করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের আছে। কিন্তু সেই দলের সাথে রাষ্ট্র বা প্রশাসনযন্ত্রের কোনোরূপ সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, সেই বিবেচনা থেকেই প্রশ্ন উঠেছে।
আর এই কারণেই কি, অন্তর্র্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ছাত্র-জনতার উদ্যোগে গঠিত হতে যাওয়া নতুন রাজনৈতিক দলের হাল ধরতে পারেন বলে খবর প্রকাশ হয়েছে! এছাড়া আগামী জুন মাসে আরেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও নাকি পদত্যাগ করতে পারেন। এদিকে, ছাত্রদের নতুন দলের গঠনতন্ত্রের কাজ চলমান রয়েছে। দেশের ও দেশের বাইরে বিশেষ করে বিভিন্ন দেশে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যেসব রাজনৈতিক দল গঠন হয়েছে সেসব দলের গঠনতন্ত্র নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। এই তালিকায় আছে তুরস্কের এরদোগানের একে পার্টি, পাকিস্তান তেহরিক ইনসাফ পার্টি, ইন্দোনেশিয়ার আন্না হাদা পার্টির গঠনতন্ত্র।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের কাছে এ নিয়ে নানা বিশ্লেষণ রয়েছে। যেকোনো বিপ্লব বা অভু্যুত্থানের পর ক্ষমতাকেন্দ্রিক লড়াই হয় বিপ্লবীদের মধ্যে। এটি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। বিভিন্ন মত ও পথের মানুষ বিপ্লবে শামিল হওয়ায় এমনটি হয়ে থাকে। এই বিভাজন এড়িয়ে যেতে পারাটাই মঙ্গলজনক।

মাত্র ক’দিন আগে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, সব রাজনৈতিক দলসহ তাদের একসাথে দেখলে তিনি সাহস পান। অথচ সেখানে এখন প্রধান উপদেষ্টার ‘সব রাজনৈতিক দলকে একসঙ্গে দেখা’র অভিপ্রায়ে গোলমাল দেখা দিয়েছে। মির্জা ফখরুল তার শঙ্কার কথা জানাতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, নির্বাচন যদি দ্রুত না হয়, সময়ক্ষেপণ করা হয়, তাহলে অন্যান্য শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। তখন জনগণের যে চাহিদা, সেই চাহিদা থেকে তারা পুরোপুরিভাবেই বঞ্চিত হয়।’
বলার অপেক্ষা রাখে না, জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রতি সর্বস্তরের মানুষের বিপুল সমর্থন ছিল। কিন্তু মাত্র মাস কয়েকে সেই মনোজগতে পরিবর্তন। জনমনেও নানা সংশয়-শঙ্কা। ৫ আগস্টের আগে আন্দোলনকারী ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক দলের অভিন্ন প্রতিপক্ষ ছিল স্বৈরাচারী সরকার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেই সরকার বিদায় নেয়ার পর জনগণের প্রত্যাশা ছিল, আন্দোলনকারী সব পক্ষের সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে অন্তর্র্বর্তী সরকার দক্ষতার সাথে দেশ পরিচালনা করবে। অন্তত তারা জনগণের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধানে ব্রতী হবে। কিন্তু বাস্তবটা দিনে দিনে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে বিএনপির নেতৃত্ব ও একাধিক উপদেষ্টা-ছাত্রনেতার মধ্যে চলমান বাহাস এ শঙ্কাকে কেবলই ভারী করছে। পাশাপাশি সরকারের গ্রহণযোগ্যতায়ও দিনে দিনে কিছুটা ভাটা পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারেনি সরকার। অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে শতাধিক পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানোয় ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন মহল নাখোশ।

গণহত্যাকারী পুলিশ, র‌্যাব, গুমকারী আয়নাঘরের সাথে জড়িত সেনাসদস্যদের বিচার দেখতে চায় জনগণ। এসব বিষয়ে সরকারের কার্যক্রম সন্তোষজনক নয়। বিএনপির সাথে শিক্ষার্থীদের সংস্কার নিয়েও মতভিন্নতা রয়েছে। বিএনপি চায় প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচিত সরকারের হাতে বাদবাকি সংস্কারের দায়িত্ব দেয়া হোক। সরকার সংস্কারের জন্য বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন করেছে। সংস্কারের জন্য কমিশন গঠনের ধারণাও বিএনপির। অনেক আগেই তারা ৩১ দফায় এসব কথা বলেছিল। সংস্কার কমিশনগুলো যে প্রস্তাব দিয়েছে, তার অধিকাংশই বিএনপি অনেক আগেই ঘোষণা করেছে যে তারা ক্ষমতায় গেলে এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে। বিএনপি এ-ও বলেছে, নির্বাচিতদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। ওই নির্বাচিত সরকার সবাইকে নিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার করবে। বিএনপির এসব প্রস্তাব ছাত্রদের পছন্দ নয়। তাদের ধারণা, নির্বাচনে জয়ের পর বিএনপি এসব ভুলে যাবে। তখন বিএনপিও ছাত্রদের সাথে ওই আচরণই করবে যা আওয়ামী লীগ করেছে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করতে না পারার জন্যও তারা বিএনপিকে দুষছে। বিএনপি এ নিয়ে অতি রাজনীতি করেছে, ক্ষমতায় গেলে আরো করবে বলে একরকম নিশ্চিত ছাত্ররা।

এ নিয়ে কোনো পক্ষে অবস্থান নেয়ার অবস্থা অন্তর্র্বর্তী সরকারেরও এখন আর নেই; বরং সরকারই ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিপক্ষ হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের বিরুদ্ধে কটূক্তির চর্চাও চলছে। গোটা বিষয়টি খারাপ নজির তৈরি করছে। তার ওপর বাজার পরিস্থিতির জন্য মানুষ নানা সমালোচনায় সরকারের ছালবাকলা তুলে ফেলতে শুরু করেছে। এ দেশ ও প্রকৃতির নিয়মও বড় কঠিন। প্রকৃতি বদলায় মাস-মাসান্তরে, মানুষের মনোজগৎ বদলায় সকাল-সন্ধ্যায়। এই নিয়মে এখানে কাউকে নিন্দাবাদ-মুর্দাবাদ দিতে তত সময় লাগে না। মাথায় তুলতে যেমন সময় নেয় না, ছুড়ে পায়ের তলায় ফেলতেও তেমনি সময় লাগে না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল