‘বিএনপি পুনর্গঠনে ভালো মানুষ দরকার’
দেশ জাতি রাষ্ট্র- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ Political Socialization) বলে একটি কথা আছে। এর অর্থ হচ্ছে রাজনৈতিক দলসমূহ ব্যক্তির মন, মানস ও সংস্কৃতি গড়নে নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে। একটি আদর্শবাদী রাজনৈতিক দল তার আদর্শ অনুযায়ী লোকজনদেরকে শিক্ষিত ও দীক্ষিত করে তোলে। উদ্দেশ্যবাদী রাজনৈতিক দলগুলো নেতাকর্মীর মন-মগজ তৈরি করতে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করে না। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে জিয়াউর রহমানের সৃষ্ট বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি একটি ব্যতিক্রম। জিয়াউর রহমান নিজে রাজনীতিবিদ ছিলেন না। তাকে বলা হয় সৈনিক থেকে রাজনীতিক (Soldier turned politician)।
জিয়াউর রহমানের ওপর আমার সামান্য গবেষণা কাজ আছে। আমি সেখানে অবাক হয়ে দেখতে পাই যে, তিনি একটি আদর্শবাদী রাজনৈতিক দলের মতো বিএনপিকে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। নেতাকর্মীদের সৎভাবে, সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। এসব কর্মসূচিতে তিনি নিজে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। নেতাকর্মীরা যাতে লোভী, স্বার্থপর ও সন্ত্রাসী না হয়ে ওঠে সেজন্য তিনি সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দিতেন। বক্তৃতাপূর্বক তার নিজের লেখা নোট থেকে দেখা যায় যে, তিনি নেতাকর্মীদের ‘খাই খাই রব’-এর তীব্র সমালোচনা করেছেন। সবাই জানেন যে, জিয়াউর রহমানের সততা ছিল অভাবিত ও অকল্পনীয়। এ নিয়ে অনেক বাস্তব গল্প আছে। তিনি চাইতেন তার নেতাকর্মীরাও তার মতো সহজ, সরল, স্বাভাবিক ও সৎ জীবনের অধিকারী হোক। জিয়াউর রহমান যে একজন বাগ-চাতুর্যপূর্ণ (Demagogue) নেতার বিপরীতে মহীরুহ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তার কারণ এমনই। এক জিয়া লোকান্তরিত হওয়ার পর ঘরে ঘরে যেভাবে লাখ লাখ জিয়ার সৃষ্টি হয়েছে তার কারণ তার অনুসৃত জীবন ও তার অমলিন আদর্শ। তাই আওয়ামী নেতৃত্ব সবসময়ই জিয়াউর রহমান ও তার উত্তরাধিকারকে তাদের ক্ষমতার প্রতি চ্যালেঞ্জ মনে করেছে। জিয়ার নাম-ধাম ও আদর্র্শকে মুছে দিতে চেয়েছে। কিন্তু জিয়ার আদর্শ মুছে যায়নি বরং তারাই বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে মুছে গেছে। এটা আশা ও আনন্দের কথা যে শহীদ জিয়ার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারে সেসব আদর্শ-উদ্দেশ্যের সংযোজন ঘটেছে।
শহীদ জিয়াউর রহমানের ‘রক্তের উত্তরাধিকার ও আদর্শের উত্তরাধিকার যেথা এক দেহে হলো লীন’, সেই তারেক রহমান একটি আহ্বান জানিয়েছেন। কয়েক দিন আগে দলকে পুনর্গঠন ও শক্তিশালী করতে মেধাবী ও ভালো মানুষদের সামনে আনার জন্য নেত-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের ভালো মানুষ দরকার। কারণ, এই রাষ্ট্রকে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচার ধ্বংস করে দিয়েছে, অনেক পেছনে নিয়ে গেছে। কাজেই আমাদের দলকে যদি পুনর্গঠন করতে হয় সেরকম মানুষ দরকার। সেরকম মানুষকে বের করে নিয়ে আসা হবে। বিএনপির সদস্য নবায়ন কর্মসূচি উদ্বোধনকালে তারেক রহমান এ কথা বলেন। তিনি লন্ডন থেকে অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন। এ প্রসঙ্গে দলের প্রস্তাবিত ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, ‘জনগণের সমর্থন পাওয়ার দেশ পুনর্গঠন করতে হবে। দেশকে পুনর্গঠন করার জন্য আমরা ৩১ দফা দেশের সামনে, মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছি। সেটি যদি বাস্তবায়ন করতে হয়, অবশ্যই মেধাবী পরিশ্রমী, সৎ মানুষগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে।
অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নেতাকর্মীদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের কর্মীরা কেন জানি না রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। গতকাল আমাদের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকী পালন করা হলো, এখানে আমাদের কর্মীরা যারা আসেন সাধারণত ভাইদের পেছনে আসেন, এসে সেই ভাইদের পক্ষে স্লোগান দিতে থাকেন। তারপর স্লোগান দেন পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ। এটা রাজনীতি না, এটা রাজনীতি হতে পারে না। বিএনপির মহাসচিব বলেন, দেখুন, রাজনৈতিক কর্মীর মুখ থেকে এ ধরনের স্লোগান আসা উচিত নয় এবং রাজনীতি কতটা দেউলিয়াপনা হতে পারে, সেটা বোঝা যায়। আমাদের এক জায়গায় চরম দৈন্য আছে, এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত।’ তিনি বলেন, আমি মনে করি আমাদের চেয়ারম্যান সাহেব (তারেক রহমান) উদ্যোগ নিবেন, এখন প্রতিটি উপজেলা এবং জেলায় রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। বিএনপিকে আদর্শ দলে পরিণত করতে হবে। মেধার নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে।
প্রসঙ্গত, উল্লেখযোগ্য যে জিয়াউর রহমান নিজের অতুলনীয় সৎ জীবনের সাথে সাথে শাসনব্যবস্থায়ও সৎ নিষ্ঠা ও সেবার আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। তার আমলের উপদেষ্টা পরিষদ কিংবা মন্ত্রিপরিষদের দিকে নজর দিলেই তার প্রমাণ মেলে। তার পরিষদের মানুষেরা ছিলেন সৎ, যোগ্য, অভিজ্ঞ এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। যারা বিএনপির প্রাথমিক ইতিহাসের কথা জানেন তারা সবাই স্বীকার করবেন যে, সারা দেশে তিনি সৎ মানুষ, সাহসী মানুষ ও নিষ্ঠাবান মানুষ খুঁজে বেড়িয়েছেন। স্থানীয় পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত এসব সৎ লোকেরা নির্মাণ করেছিল বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। এর প্রমাণ মেলে ১৯৯১ সালের বাংলাদেশের সবচেয়ে স্বচ্ছ নির্বাচনে। আওয়ামী লীগের লোকেরা মুজিব কোট কেটে অপেক্ষা করছিল মন্ত্রী, আধামন্ত্রী ও পাতিমন্ত্রী হওয়ার। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সারা দেশের মানুষ ভোট দিয়েছে বিএনপিকে। এর জন্য যেমন বেগম খালেদা জিয়ার আপসহীন নেতৃত্বের সুষমা কাজ করেছে, তেমনি শহীদ জিয়ার উত্তরাধিকার আরও বেশি কাজ করেছে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে কম বেশি শহীদ জিয়ার আদর্শ অনুসৃত হয়েছে। শহীদ জিয়ার উত্তরাধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে ১/১১-এর লক্ষ্য এবং আওয়ামী স্বৈরাচারের নির্যাতনের শিকার। সে আরেক গল্প। আজকের গল্প শহীদ জিয়ার সততা ও মেধার বিকাশের ধারাবাহিকতায় তারেক রহমানের আহ্বান ও উদ্যোগ।
অস্বীকার করে লাভ নেই যে, ইতোমধ্যে পদ্মা, মেঘনা, যমুনায় প্রবাহিত হয়েছে অনেক পানি, আর বিএনপিকে অতিক্রম করতে হয়েছে অনেক নিপীড়ন, নির্যাতন ও নির্মমতা। বিগত ১৭ বছর ধরে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিএনপির টিকে যাওয়া একটি অনন্য ঘটনা। যেভাবে নেতাকর্মীরা লোভ-লালসা ও ভীতিকে অতিক্রম করে বিএনপিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তা স্মরণযোগ্য। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে বিএনপির ভূমিকাও অনস্বীকার্য। সেই ভূমিকার বিপরীতে বিজয়ের পর পর বিএনপির কিছু বিপথগামী লোকের কারণে বিএনপি বদনামের শিকার হয়েছে। সর্বোচ্চ নেতৃত্বের নির্দেশনা ছিল সর্বোচ্চ ত্যাগের। কিছু লোক ত্যাগের বিপরীতে ভোগের জগতে বিচরণ করেছে। ১৭ বছরের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ও বঞ্চনার পর নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ সহজ ছিল না। কিন্তু বিএনপির নেতৃত্ব কঠিন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সারা দেশে শুরু হয় নৈরাজ্য ও সহিংসতা। যে কোনো মূল্যে দেশে সম্প্রীতি রক্ষা, লুটপাট, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব বন্ধসহ শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে বিএনপি। দল কিংবা দলের নাম ব্যবহার করে অপকর্মের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে এরই মধ্যে সারা দেশে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ১৫ শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার কিংবা পদ স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু ধর্মের কাহিনী অধর্মকারীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। সারা দেশ থেকে এখনো অভিযোগ আসছে। এই প্রেক্ষিতে তারেক রহমানের বিএনপি পুনর্গঠনের কথা প্রাসঙ্গিক ও সময়োচিত।
আবার ফিরে যাই তত্ত্বকথার আলোকে। এ আলোচনার প্রথমেই আমরা উল্লেখ করেছি রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের কথা। একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল তার আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি অনুযায়ী কর্মী ও নেতৃত্বকে গড়ে তুলবে এটাই স্বাভাবিক। ডান ও বাম ধারার রাজনৈতিক দল যেমন জামায়াতে ইসলামী ও কমিউনিস্ট পার্টির তরফ থেকে কর্মী ও নেতাদের বিভিন্ন পর্যায়ে দীক্ষিত করার নিয়ম-রীতি রয়েছে। যদিও বিএনপি সে রকম আদর্শবাদী দল নয়। আমরা বলি গতানুগতিক রাজনৈতিক দল। কিন্তু সেখানে ব্যতিক্রম হচ্ছে সেই জিয়াউর রহমানের পার্টি দর্শন। দীর্ঘ বছরগুলোতে বিএনপি হামলা-মামলা ও গুম-খুনের মোকাবেলা করায় নিজেদের দিকে নজর দিতে পারেননি। এখন এটা অভিনন্দনযোগ্য সিদ্ধান্ত যে বিএনপির কর্ণধার তারেক রহমান তাদের নেতাকর্মীদের শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে মন ও মানস তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সৎলোকের শাসন বা সৎলোকের নেতৃত্ব একটি জাতির অন্যতম চাওয়া। কারণ অসৎ ব্যক্তির কাছে শাসনভার পড়লে সেই ব্যক্তি জনগণের ওপর জুলুম করার পাশাপাশি অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিগত ১৫ বছরের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমরা এই সত্যতা উপলব্ধি করেছি। তিনি নাকি কুরআন পাঠ করতেন, তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন অথচ অন্যায়, অসততা, লুণ্ঠন ও অত্যাচারের সীমা লঙ্ঘন করেছিলেন। অসৎ নেতৃত্বের ফলে একটি দেশ-জাতি ও জনগণের কী চরম দুর্দশা হতে পারে তিনি তার প্রমাণ রেখে গেছেন।
বস্তুত বাংলাদেশ সমাজ ও রাষ্ট্রে সততার বড়ই অভাব। এ সমাজে যারা সৎ নয়, তারাও সৎলোককে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস করে। কোনো চোর তার চুরির মাল আর এক চোরের কাছে আমানত রাখে না, কোনো সৎলোকের কাছেই রাখে। অসৎ লোকও সৎলোকের প্রশংসা করে। তারা নিজে অসৎ হলেও সততা কী তা জানে। আল্লাহ পাক মানুষকে ভালো ও মন্দের পার্থক্য বুঝবার যোগ্যতা দিয়েছেন। এ যোগ্যতা আর কোনো জীব-জানোয়ারের নেই। এরই নাম বিবেক। বিবেকই আসল মানুষ। সততাই বিবেকের অপর নাম। এটাই মানুষের নৈতিক সত্তা। মানুষের দেহ হলো বস্তুসত্তা। দেহের ভালো-মন্দের কোনো ধারণা নেই। দেহের যা দাবি সে তা পেলেই খুশি। তা সে হালাল পথে পেল কিনা সে হিসাব সে করে না। বিবেকই সে হিসাব করে। সৎলোক তারাই, যারা বিবেকের দ্বারা পরিচালিত। অর্থাৎ তারা বিবেকের বিরুদ্ধে চলে না। সৎলোক আসমান থেকে রেডিমেড নাজিল হয় না। বিদেশ থেকে আমদানি করে আনার জিনিসও এটি নয়। সুপরিকল্পিত উপায়েই সৎলোক তৈরি করতে হয়।
সেই পরিকল্পনারই অংশ তারেক রহমানের ভালো মানুষ গড়ার ঘোষণা। মানুষ হিসেবে জন্মগতভাবে কিছু ভালো কিছু মন্দ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। মানুষ ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। সেই মানুষ কতই না নিকৃষ্ট আচরণ করে, কতই না অকৃতজ্ঞ হয়। সনাতন শাস্ত্রে মানুষের ষড়রিপুর কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য। আবার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী থমাস হবস বলেছেন, ‘Man is by born selfish, poor, brutish, nasty and short.’ মানুষের এসব অনিবার্য নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের অবসানে ইতিবাচক গুণের চর্চা ও অনুসরণ প্রয়োজন। সেখানেই সামাজিকীকরণ (Socialization) প্রত্যয়টির প্রয়োগ। তারেক রহমান যে রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ (Political Socialization)-এর নির্দেশনা দিয়েছেন, তার মাধ্যমে দীর্ঘ সময়ান্তরে বিএনপি হয়ে উঠবে দেশের একটি উত্তম আদর্শবাদী রাজনৈতিক দল। সেই প্রার্থনা সব মানুষের।
লেখক : অধ্যাপক (অব:), সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা