নতুন অভিযাত্রার ৬ মাস
সময়-অসময়- মাসুম খলিলী
- ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:২৪
বাংলাদেশ জুলাই বিপ্লবের পর একটি নতুন বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে। বলা যায়, ছাত্রদের সূচিত এই বিপ্লব বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ‘প্যারাডাইম শিফট’। ’২৪-এর বিপ্লবোত্তর যে নতুন সময় সেটিকে আর কোনোভাবেই ছয় মাস আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া যাবে না।
এটি ঠিক যে জুলাই বিপ্লবের আগে দেশের তারুণ্য যে স্বপ্ন নিয়ে বন্দুকের অবিরাম গুলির মুখে নিজেদের বুক চিতিয়ে দিয়েছিল তার সবটা পূরণ হয়নি। অধরা স্বপ্নের ব্যাপ্তি যাই হোক না কেন পরিবর্তনের যে মৌলিক কাজগুলো এর মধ্যে হয়েছে তা একেবারেই অনুল্লেখযোগ্য নয়। সেটিকে উপেক্ষা করা কোনো শক্তির পক্ষে সম্ভব হবে না।
প্রধান উপদেষ্টার আনুষ্ঠানিক অনানুষ্ঠানিক ইঙ্গিত অনুসারে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর বা পরবর্তী জানুয়ারির মধ্যে সাধারণ নির্বাচন হয়ে যাবে। নির্বাচন কমিশনের প্রধান ও অন্য কমিশনারদের বক্তব্য ও কাজ এ সময়কে কেন্দ্র করে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে নানা ইস্যুতে মতান্তর হলেও শেষ পর্যন্ত এটি সমাধানের বিন্দুতে পৌঁছতে পারে বলে আশা করা যাচ্ছে।
বিপ্লবের মূল চেতনা
জুলাই বিপ্লবে আন্দোলনের নেটওয়ার্ক নতুন প্রজন্মের ছাত্ররা তৈরি করলেও এর সাথে সর্বস্তরের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষ যুক্ত হয়। এতে দুটি প্রধান চেতনা কাজ করে প্রথমত, বাংলাদেশ থেকে ফ্যাসিবাদ বা কর্তৃত্ববাদ বিদায় নেবে এবং জনগণের ইচ্ছা তথা অবাধ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতার মেয়াদ শেষে পালাবদল ঘটবে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ পরিচালিত হওয়ার সিদ্ধান্ত তার নিজস্ব স্বার্থকে বিবেচনা করে নেবে, যেখানে অন্য কোনো দেশের নির্দেশনা থাকবে না। আগের দেড় দশকে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এমনকি কৌশলগত নিরাপত্তার ইস্যুগুলোতেও বৃহৎ প্রতিবেশী দেশের নির্দেশনা মানা হতো বলে ধারণা করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে।
জুলাইয়ের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে এ দুটি মৌলিক বিষয় বেরিয়ে আসে। এর বাইরে ফ্যাসিবাদ আমলে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ গণহত্যা ইত্যাদির বিচারসংক্রান্ত কিছু ইস্যু রয়েছে যা অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর এজেন্ডা হিসাবে সামনে চলে এসেছে।
অগ্রগতি কতটা
দিন দশেকের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস পূর্তি হতে যাচ্ছে। সরকার গঠনের পর যে অস্থির পরিবেশ ছিল তাতে সরকারের সব ধরনের প্রশাসনিক ক্ষেত্রগুলোতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ছিল প্রধান এজেন্ডা। এ সময় পুলিশ প্রশাসন কার্যত ভেঙে পড়েছিল। র্যাবও অনেকখানি অকার্যকর ছিল। রাজারবাগে পুলিশের বিদ্রোহমূলক তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে আনতে না আনতে আনসার বিদ্রোহের সূত্রপাত করা হয়। বিদ্যুৎ শিল্প ও স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে নানা সংবেদনশীল খাতে অস্থিরতা তৈরি করা হয়। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার গত ছয় মাসে অনেকখানি সফল হয়েছে।
মুক্তভাবে কথা বলা বা সমাবেশের সুযোগে বিভিন্ন গ্রুপ স্বয়ংক্রিয়ভাবে এখন আন্দোলন করছে। আবার অনেক গ্রুপকে পরিকল্পিতভাবে মাঠে নামানো হচ্ছে। এ প্রবণতা অনেকখানি এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ কাজে প্রাথমিকভাবে সহযোগিতা পাওয়া যায় কেবলই সেনাবাহিনীর। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে এখনো সেনাবাহিনী মাঠে মোতায়েন রয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ বাহিনী ধীরে ধীরে সক্রিয় হচ্ছে। শূন্য পদগুলো পূরণ ও কিছু সংস্কার পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হলে আশা করা হচ্ছে অচিরেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ব্যাংক ও আর্থিক খাতসহ অর্থনীতিতে গতি আনা। জুলাই বিপ্লবের পরে অন্তর্বর্তী সরকার যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে তখন একটি ভঙ্গুর ব্যাংক খাত হাতে পায়, যেখানে নামে বেনামে ফ্যাসিবাদের অলিগার্করা ঋণ নিয়ে অধিকাংশ ব্যাংককে রেখে যায়। এখন গ্রাহকের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানো অনেক ব্যাংকের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শুধু একজন অলিগার্কের ১১টি ব্যাংক থেকে নামে বেনামে বের করে নেয়া অর্থের পরিমাণ হিসাব করা হয়েছে দুই লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। আরো ১০টি ব্যাংকের লেনদেন এর সাথে যুক্ত করা হলে এই অঙ্ক আরো বড় হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে সরকার কোনো ব্যাংককে অচল হতে না দিয়ে জন-আস্থা ধরে রাখার পদক্ষেপ নেয়। সে সাথে ব্যাংক থেকে নামে বেনামে ঋণ নিয়ে যারা লক্ষ কোটি টাকা পাচার করেছে তাদের চিত্র জনসমক্ষে প্রকাশ এবং এর প্রতিকার বিধানের পদক্ষেপ নেয়া হয়। এসব পদক্ষেপ আর্থিক খাতে সাময়িক বিপর্যয় প্রতিরোধ করেছে। তবে দীর্ঘমেয়াদি ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যাওয়া তহবিল ফেরত আনা এবং কাঠামোতে সংস্কার আনার বিকল্প নেই। এ সংক্রান্ত কমিশন এ নিয়ে কাজ করছে।
আন্তর্জাতিক সমর্থন
বিপ্লবোত্তর সরকারের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন হয় একটি মৌলিক আবশ্যকীয় বিষয়। পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা ক্ষমতা হারানোর পর প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। সেখান থেকে সংবেদনশীল ইস্যুতে রাজনৈতিক বক্তব্যও দিয়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে স্পষ্ট বার্তা আসে যে প্রতিবেশী দেশ ভারত নতুন সরকারের সাথে সম্পর্ক তৈরির চেয়েও পুরনো প্রভাবের ধারাবাহিকতাকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের অন্যান্য কূটনৈতিক অংশীদারদের সমর্থন অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিবেশী দেশের পক্ষ থেকে সংখ্যালঘু নির্যাতনসহ নানা ইস্যুতে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক প্রোপাগান্ডা চালানো হলেও ইউরোপ আমেরিকার মূল ধারার মিডিয়া এটাকে সত্য বলে গ্রহণ করেনি। অধিকন্তু প্রচারিত ভিডিও ও অডিও ফ্যাক্টচেকে ভুয়া প্রমাণ হওয়ার ফলে এই প্রচারাভিযান অকার্যকর হয়ে পড়ে। জাতিসঙ্ঘ ফোরাম এবং ইউরোপ-আমেরিকার সব দেশই অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় রাখছে।
আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ সঙ্কেত হলো কোনো সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থা ও সমর্থন থাকলে তখন সেসব দেশের বিনিয়োগকারীরা সরকার ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যোগাযোগ করে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের এবার ডাভোস সফরকালে বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
মুহাম্মদ বিন সালমানের সৌদি আরব মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল ও রিফাইনারি স্থাপন এবং মুহাম্মদ বিন জায়েদের সংযুক্ত আরব আমিরাত চট্টগ্রাম বন্দরে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এর বাইরেও বাংলাদেশে অনেক বিনিয়োগকারী এসে সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাৎ করছেন।
ডাভোসের সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী একজনের সাথে আলাপ করে জানা যায়, বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে আগামী দিনের ইন্দোনেশিয়া হিসাবে দেখছেন। এদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ ইন্দোনেশিয়ার মতো ভোটের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে বলে তারা আশা করছেন। তাদের ধারণা, এখানে দল নির্বিশেষে তারুণ্যের একটি জেনারেশন রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবে। উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদী ইসলামিস্ট নির্বিশেষে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের সহাবস্থান তৈরি হবে যা যে কোনো দীর্ঘ স্থায়ী বিনিয়োগকে নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেবে। ইন্দোনেশিয়ায় ঠিক এটিই হয়েছে।
ভারত ফ্যাক্টর
বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত ১৫ বছর ভারত ফ্যাক্টর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে আছে। জুলাই বিপ্লবের পর শেখ হাসিনার আতিথ্য করাকে একজন অত্যাচারী এবং একজন ঠাণ্ডা মাথার খুনি রাজনীতিবিদকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হিসাবে দেখা হচ্ছে, যিনি মাত্র ২০ দিনে ১,৫০০ বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছেন। আগে থেকে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য তিনি পরিচিতি পেয়েছেন।
বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের প্রতি ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কথা বলেছেন আবু রুশদ-জাকির খান ও সালমান চৌধুরী তাদের লেখা এক যৌথ প্রতিবেদনে। তারা বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের নিরাপত্তা বিভ্রম প্রসঙ্গে আমেরিকান এক সাময়িকীতে লিখেছেন, ‘ভারতের নাগরিকদের অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা উচিত তাদের সামনে আসল হুমকি কে? কে তাদের নিরাপত্তা ও গণতন্ত্রের জন্য সত্যিকারের হুমকি? এটি কি বাংলাদেশের একটি শান্তিপূর্ণ বিপ্লব যা গণতান্ত্রিক পুনরুত্থানকে অনুপ্রাণিত করে? নাকি মোদির শাসনব্যবস্থা, যা নাগরিকদের ওপর করপোরেট বন্ধুদের অগ্রাধিকার দেয়, রাজনৈতিক লাভের জন্য সম্প্রদায়কে বিভক্ত করে এবং বিদেশে নিপীড়ক শাসনের সাথে মিত্র করে?’
তারা মনে করেন, ‘বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লব ভারতের জন্য কোনো হুমকি নয়; বরং, এটি এমন একটি আয়না যা মানুষের সাহসকে প্রতিফলিত করে যারা অত্যাচারের কাছে মাথা নত করতে অস্বীকার করেছিল। যদি কিছু থাকে, তবে এটি ভারতীয়দের তাদের গণতান্ত্রিক আদর্শ পুনরুদ্ধার করতে অনুপ্রাণিত করবে। এই বিপ্লব ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভাজন পাশ কাটিয়ে মানুষকে একত্রিত করেছে। বিপরীতে, মোদির বিজেপি হিন্দু জাতীয়তাবাদী সমর্থনকে সুসংহত করার জন্য মুসলিম এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদেরকে ‘অন্য’ হিসাবে চিত্রিত করে মেরুকরণে হাওয়া দিচ্ছে। বিপ্লবের সাফল্য দেখায় যে, বিভাজন নয় ঐক্যই শক্তির আসল পথ। মোদির সরকার যখন গ্রেফতার ও অভিযানের মাধ্যমে ভিন্নমতকে নীরব করে, জুলাই বিপ্লব স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং ন্যায়বিচারের ওপর জোর দেয়।’
তারা উল্লেখ করেন, ‘ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার, অতীতের নির্যাতনের শিকারদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন এবং ন্যায়বিচারকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব কী অর্জন করতে পারে তার একটি শক্তিশালী উদাহরণ স্থাপন করেছে। জুলাই বিপ্লব দেখিয়েছে যে ভয় অজেয় নয় কারণ এটি নিয়মিত নাগরিকদের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা দিয়েছে।’
এর মধ্যে ট্রাম্প আমেরিকার ক্ষমতায় আসার পর ফ্যাসিবাদের অনেক সমর্থক আশায় বুক বেঁধেছেন। বিজেপিপন্থী হিসেবে পরিচিত ভারতীয় বিশ্লেষক ড. শ্রীরাধা দত্ত এই আশাবাদের গোড়ায় পানি ঢেলেছেন। তিনি সাউথ এশিয়া পারস্পেকটিভে লিখেছেন, ২০২৫ সালে ওয়াশিংটনে ফিরে আসার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী বিজয় শেখ হাসিনার ঢাকায় ফিরে আসার বিষয়ে সম্ভবত আওয়ামী লীগের অনুগতদের অনুমানকে উৎসাহিত করেছে। যদিও এটি একটি দূরবর্তী সম্ভাবনা, নাও হতে পারে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের অপ্রাসঙ্গিক ইস্যু নিয়ে প্রশ্নটি স্পষ্টতই বিভ্রান্তিকর এবং প্রকৃতপক্ষে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে সাহায্য করছে না।’
ট্রাম্প প্রশাসন হাসিনাকে আবার ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে এটি যে একটি ইলিউশন তা স্পষ্ট হয় মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রধান উপ-মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেলের বক্তব্যে। প্যাটেল বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, ২০২৫ সালের শেষের দিকে বা ২০২৬ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণাকে যুক্তরাষ্ট্র স্বাগত জানিয়েছে। বেদান্ত প্যাটেল গুমের তদন্তকারী একটি বাংলাদেশী তদন্ত কমিশনের ফলাফলের প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে হাসিনা এবং কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গুমের সাথে জড়িত ছিলেন।
প্যাটেল বলেন, ‘গত দুই দশকে শত শত বাংলাদেশীকে জোরপূর্বক নিখোঁজ করা হয়েছে এমন প্রতিবেদনে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হয়েছি।’ প্যাটেল অন্তর্বর্তী সরকারের তদন্তমূলক প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছেন এবং ‘ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবারের জন্য ন্যায়বিচার প্রদানের জন্য ন্যায্য ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনের বিষয়টি ভারতীয় নীতি প্রণেতাদের অজানা নয়। এ কারণে সাউথ ব্লক, একই সাথে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারের বক্তব্যেও নমনীয়তা এসেছে। শ্রী রাধাও মনে করেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বর্তমান অচলাবস্থা একটি অস্থায়ী পর্যায় হওয়া উচিত এবং পর্যায়টি আগে কাটিয়ে উঠলে উভয়পক্ষই পারস্পরিকভাবে লাভবান হবে। দ্বিপাক্ষিক সম্পৃক্ততার গুরুত্বকে অতিরিক্ত চাপ দেওয়া যাবে না এবং অন্তর্বর্তী সরকারের একটি আশ্বাস গুরুত্বপূর্ণ যে তারা ভারতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগ সম্পর্কে সচেতন এবং ভারতকে বোঝা দরকার যে বাংলাদেশ কেবল একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক প্রতিবেশীই নয়, তার বৃহত্তর আঞ্চলিক আকাক্সক্ষার জন্য একটি অপরিহার্য অংশীদারও। নিঃসন্দেহে ভারত এবং বাংলাদেশের ভাগ্য একে অপরের সাথে জড়িত, অন্য কোনো পথ অনুসরণ করা একটি বৃথা অনুশীলন হবে।’
সংস্কার ও নির্বাচন
বাংলাদেশের এখনকার দু’টি প্রধান ইস্যুও হলো সংস্কার ও নির্বাচন। যে দু’টি মৌলিক বোঝাপড়ার ওপর ভিত্তি করে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে তাতে সংস্কারে ঐকমত্য ছাড়া নির্বাচন হওয়া কঠিন। রাষ্ট্রে এখন যেহেতু সংবিধানের শাসন পুরোপুরি বিদ্যমান নেই, তাই সংস্কারের ব্যাপারে বিশেষত সাংবিধানিক সংস্কারের ব্যাপারে ঐকমত্য হলে নতুন সংসদ গঠনের পর তা বাস্তবায়ন হতে পারে। অথবা ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনের আগেই রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে তা কার্যকর এবং নতুন সংসদ আসার পর তা অনুমোদন করা যেতে পারে।
জুলাইয়ের বিপ্লবে যেসব ছাত্ররা নেতৃত্ব দিয়েছে এবং সেনাপ্রতিষ্ঠানের মতো যেসব প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব এতে সমর্থন দিয়েছে তারা সংবিধানের ৭ক/খ অনুচ্ছেদ কার্যকর থাকা অবস্থায় রাজনৈতিক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার ব্যবস্থায় সম্মত হয়ে মৃত্যু ঘটানোর মতো পরিস্থিতিকে স্বাগত জানাবে এমনটি রাজনৈতিক নেতৃত্বের আশা করা উচিত নয়। এ কারণে সংস্কারের বিষয়ে একটি সমঝোতায় রাজনৈতিক দলগুলোকে আসতেই হবে।
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূসের স্পষ্ট অঙ্গীকার অনুসারে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে যদি ন্যূনতম সংস্কার করে ভোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আর অধিক সংস্কার করে নির্বাচনে যেতে চাইলে তা পরবর্তী জুন পর্যন্ত সময় নিতে পারে। সরকারের উপদেষ্টাদের বক্তব্য এবং নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি দেখে মনে হয় ডিসেম্বর বা জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে কথা বলে আমি এ রকম ধারণাই পেয়েছি।
এবারের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে এক ধরনের বিতর্ক এর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। ছাত্র সমন্বয়করা চাইছেন গণহত্যার বিচার এবং সংস্কারের পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি চাচ্ছে অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে কালবিলম্ব না করে এ বছরের মধ্যে নির্বাচন। জামায়াতে ইসলামী চাচ্ছে যৌক্তিক সংস্কার করে যতটা সম্ভব দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠান। ছাত্র সমন্বয়করা জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে সেটাকে নির্বাচন ও সংস্কারের ভিত্তি করতে চাইছে। জামায়াত নীতিগতভাবে এটি সমর্থন করে। তবে বিএনপি এটিকে অপ্রয়োজনীয় ইস্যু মনে করে। স্বাভাবিকভাবে ধারণা করা যায় যে, এই ইস্যুতে একমত হওয়া কঠিন হতে পারে।
ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে এটি বড় কোনো বাধা হবে বলে মনে হয় না, যদি সংস্কারের অন্য কিছু বিষয় নিয়ে মৌলিকভাবে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ফ্যাসিবাদ কায়েমের অভিযোগে আওয়ামী লীগের দায়ীদের বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাখার ইস্যুটির একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান হতে পারে। এটি হতে পারে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে যারা সরাসরি গুম খুন গণহত্যার সাথে জড়িত হিসাবে মামলার প্রক্রিয়া চলছে তাদের রাজনৈতিক তৎপরতা ও নির্বাচনের বাইরে রাখা। অথবা ফ্যাসিবাদ কায়েমের জন্য অভিযুক্ত শেখ পরিবারের বাইরে অবিতর্কিত ব্যক্তিদের দল গঠনের সুযোগ দেয়া। এসবের কোনোটিই চূড়ান্ত কিছু নয়।
তবে ২৪-এর জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে সাইড লাইনে রেখে নির্বাচনে সাফল্য ঘরে তুলে সরকার গঠন কঠিন হতে পারে। বাংলাদেশে এখনো ফ্যাসিবাদের পুনরাবির্ভাব ঠেকানো এবং প্রতিবেশী দেশের আধিপত্যে রাষ্ট্র চালিত না হওয়ার বিষয়ে ব্যাপক ঐকমত্য রয়েছে। ফলে ফ্যাসিবাদী দলের সাথে যুক্ত কেউ রাজনীতিতে আসতে চাইলে তাকে অবশ্যই অতীতের কাজের জন্য অনুশোচনা করে ক্ষমা চাইতে হবে। সেই সাথে আধিপত্যবাদের সাথে আপস না করে ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনাকে স্বীকৃতি দিয়ে নির্বাচনের মাঠে অবতীর্ণ হতে হবে।
বাংলাদেশ ৫ আগস্ট রক্ত দিয়ে যে পর্ব পার হয়ে এসেছে সেখানে কোনোভাবেই রাষ্ট্রকে আর ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না।
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা