২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩ মাঘ ১৪৩১, ২৫ রজব ১৪৪৬
`

আত্মমর্যাদাবোধ ও বিশ্বাস

আত্মমর্যাদাবোধ ও বিশ্বাস -

বাংলাদেশে বসবাসকারী সাধারণ মানুষের আজন্ম লালিত স্বপ্ন ও সাধ, আত্মমর্যাদা বিকাশের অধিকার লাভের উদ্দেশে নিয়োজিত সুদীর্ঘ সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে এদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, অনন্য ঐক্য গঠনের মাধ্যমে আপন অধিকার প্রতিষ্ঠা, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, স্বাধীন আশায় পথ চলা এবং আপন বুদ্ধিমতে চলার ক্ষমতা লাভ করেছে ।
স্বাধীনতা ও মুক্তি লাভের প্রত্যাশা মানুষের জন্মগত অধিকার। কিন্তু এ অধিকার কেউ কাউকে এমনিতে দেয় না, কিংবা ছেলের হাতের মোয়ার মতো নয় তা সহজপ্রাপ্যও, একে অর্জন করতে হয়, আদায় করে নিতে হয়। আবার অর্জন করার মতো সেই স্বাধীনতা ও মুক্তির মূল্যবোধ রক্ষা করাও কঠিন। কেননা, স্বাধীনতার শত্র“র অভাব নেই। স্বাধীনতা হীনতায় বাঁচতে কে চায়? আবার সুযোগ পেলে অন্যকে নিজের অধীনে রাখতে চায় না কে? বেশি দামে কেনা স্বাধীনতা কম দামে বিক্রির নজির ঘরে বাইরে যে নেই তা তো নয়।
আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের জনগণ শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে, পরাধীনতার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসার সংগ্রামের মাধ্যমে ইতিহাসের বহু পটপরিবর্তনে চড়াই উতরাই পেরিয়ে অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জন করে তাদের আজন্ম লালিত স্বাধীনতার স্বপ্নসাধ। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশে অশেষ আত্মত্যাগের বিনিময়ে বিজয় অর্জন তার প্রত্যাশিত পণ পূরণ এবং যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব না হলে স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগের যৌক্তিকতা ভিন্ন অর্থে পর্যবসিত হতে পারে। কিংবা প্রকারান্তরে বলা যায় ভিন্ন ব্যাখ্যার অবয়বে সেই সাফল্যে অন্যেরাও ভাগ বসাতে আসতে পারে।
বেশি দিন আগের কথা নয় ব্যবসায়-বাণিজ্য ব্যাপদেশে এ দেশে আগমন ঘটে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছত্রছায়ায় সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড় থেকে আসা ইংরেজদের। তাদের আগে মগ ও পর্তুগিজরাও অবশ্য এসেছিল এ দেশে। প্রতিদ্বন্দ্বী বিবেচনায় এরা পরস্পরের শত্র“ভাবাপন্ন হয়ে ওঠে। অত্যাচারী মগ ও পর্তুগিজদের দমনে ব্যর্থপ্রায় সমকালীন শাসকদের সাহায্যে এগিয়ে আসে নৌযুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী ইংরেজ বণিক। ক্রমে তারা অনুগ্রহভাজন হয়ে ওঠে সমকালীন বিলাসপ্রিয় উদাসীন শাসকদের। আর সেই উদাসীনতার সুযোগে রাজপ্রাসাদ-অভ্যন্তরে কূটনৈতিক প্রবেশ লাভ ঘটে ইংরেজদের। প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁকে হাত করে তারা ক্ষমতাচ্যুত করে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে। পরে সে ক্ষমতার হাতবদল হয় বাংলা বিহার উড়িষ্যার এবং ক্রমে ক্রমে ভারতবর্ষের প্রায় গোটা অঞ্চল। ঈসা খাঁ, মীর কাসিম খান, টিপু সুলতান প্রমুখ সমকালীন স্বাধীনচেতা রাজন্যবর্গ স্থানীয়ভাবে তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে চাঙ্গা করেও ব্যর্থ হন। বিদেশ বিভূঁইয়ে সাহায্য ও সহানুভূতি পেতে সম্প্রদায়গত বিভাজন সৃষ্টি করতে আনুকূল্য প্রদর্শনার্থে ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস প্রবর্তন করেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এই নীতির ফলে এ দেশীয় স্বাধীনতাকামী জনগণের মধ্যে পৃথক পৃথক অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত হয়। ব্রিটিশ শাসকের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসিতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে বৃহৎ দু’টি সম্প্রদায়। হিন্দু জমিদাররা ইংরেজদের আনুগত্য পেতে থাকে, পক্ষান্তরে রাজ্য হারিয়ে মনমরা মুসলমান সম্প্রদায় (যার অধিকাংশ পরিণত হয় রায়ত কৃষকে) দিন দিন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে থাকে।
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহেও ইংরেজদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি বেশ কাজ করে, আরো দ্বিধাবিভক্তিতে আচ্ছন্ন হয় উভয় সম্প্রদায়। এরপর স্যার সৈয়দ আহমদ, নবাব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমির আলী, খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ , নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী প্রমুখের শিক্ষা ও সমাজসংস্কারবাদী কর্মপ্রচেষ্টায় মুসলিম সম্প্রদায় ধীরে ধীরে আধুনিক শিক্ষার আলো পেয়ে ক্রমান্বয়ে চক্ষুষ্মান হতে থাকে।
১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস এবং তার ২১ বছর পর ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মুসলিম লীগ’ নামের রাজনৈতিক সংগঠন। বৃহৎ ভারতবর্ষের ব্যাপারে না গিয়ে শুধু এ বাংলাদেশ বিষয়ে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পেছনে যে প্রধান ঘটনা স্থপতি হিসেবে কাজ করেছে তা হলো ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম এমন দ্বিধাবিভক্তির প্রেক্ষাপটে প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাব থেকে ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে পূর্ববাংলার নেতা শেরেবাংলা ‘উপমহাদেশের মুসলিমপ্রধান অঞ্চলগুলো নিয়ে ’রাষ্ট্রসমূহ’ গঠনের প্রস্তাব করেন। মুসলিমপ্রধান পূর্ব বাংলাবাসী ওই প্রস্তাব মতে একটি পৃথক রাষ্ট্রগঠনের দাবিদার। ১৯৩০ সালে চৌধুরী রহমত আলী ‘পাকিস্তান’ শব্দটির উৎপত্তি ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা যখন প্রথম প্রকাশ করেন; তখন তাতে বাংলা নামের কোনো শব্দ বা বর্ণ ছিল না, এমনকি ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের দার্শনিক ভাবনির্মাতা স্যার মুহাম্মদ ইকবাল পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে কল্পনা ব্যক্ত করেন; তাতে বাংলাকে অন্তর্ভুক্তির কোনো কথা ছিল না। এতদসত্ত্বেও ১৯৪০ সালের লাহোর অধিবেশনে ‘রাষ্ট্রসমূহ গঠনের প্রস্তাবকে’ উপচিয়ে, পূর্ব বঙ্গবাসীর পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ভারতবর্ষের পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত সহস্রাধিক মাইল ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাথে একীভূত হয়।
পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হিসেবে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এটা যে পূর্ববঙ্গের প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা প্রাপ্তি ছিল না; তা ক্রমে পূর্ব বঙ্গবাসীর উপলব্ধি আছে। এটা বোঝা গিয়েছিল এ নব্য উপনিবেশবাদে বাংলাদেশীদের নিজেদের আত্মমর্যাদা ও আত্মপরিচয় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে তাদের সচেতনতার পরিচয় দেয় ১৯৫৪-এর নির্বাচনে, ১৯৬২-এর ছাত্র আন্দোলনে, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে এবং ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে। এত দিনে পশ্চিম পাকিস্তানি সামন্তবাদী চক্রের আসল মুখোশ উন্মোচিত হয়। পূর্বপাকিস্তানকে এক সময় তারা ব্যবহার করেছিল ইংরেজ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের স্বার্থে, সেই আন্দোলনের অন্যতম উদগাতা ছিল পূর্ববঙ্গবাসী। একইভাবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি বৈষম্যের বিরোধও তেমনি তাদের প্রথমে স্বাধিকার এবং পরে স্বাধীনতার আন্দোলনে উজ্জীবিত করে।
প্রখ্যাত লেখক হুমায়ূন কবীর তার ‘বাংলার কাব্যে’ লিখেছেন, ‘বাংলার পূর্বাঞ্চলের প্রকৃতি ভিন্নধর্মী। পূর্ব বাংলার নিসর্গ হৃদয় তাকে ভাবুক করেছে বটে কিন্তু উদাসী করেনি। দিগন্তপ্রসারী প্রান্তরের অভাব সেখানে নেই কিন্তু সে প্রান্তরেও রয়েছে অহরহ বিস্ময়ের চঞ্চল লীলা। পদ্মা যমুনা মেঘনার অবিরাম স্রোতধারার নতুন জগতের সৃষ্টি ও পুরাতনের ধ্বংস।’ পূর্ব বাংলায় নিসর্গ নন্দনকাননেই শুধু পরিণত করেনি তাদের (বাংলাদেশের জনগণকে) করেছে পরিশ্রমী, সাহসী-শান্ত-সুজন, আত্মবিশ্বাসী, ভাবুক, চিন্তাশীল, আবেগময় ও ঔৎসুক্যপ্রবণ। তাদের রয়েছে নিজস্ব নামে দেশ সৃষ্টির ইতিহাস, ঐতিহ্য, চলন-বলন, শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য ইত্যাদি। দৈহিক গড়ন গঠনে আবেগ অনুভূতিতে, রগে রক্তে তারা পৃথিবীর অন্যান্য জাতি ও সম্প্রদায় হতে আলাদা। ভৌগোলিক কারণেও তারা পৃথক ভিন্ন প্রকৃতির। জাতিগত ভাবাদর্শে, রাষ্ট্রীয় আনুগত্য প্রকাশে জাতীয়তাবোধে অন্যান্য রাষ্ট্র ও অঞ্চলে বসবাসকারী স্বধর্মী ও স্বভাষীদের থেকেও তারা স্বতন্ত্র প্রকৃতির। বাংলাদেশের জনগণ শান্তিপ্রিয়। তারা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিজেরা অর্জন করতে জানে এবং নিয়ন্ত্রণ করে। একাত্তরের মতো চব্বিশের ৩৬ জুলাইয়ের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় জনগণের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক সত্যের আত্মপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সচেতনতা জাতিসত্তার মৌলিক পরিচয়ে সমুন্নত করেছেন।
স্বাধীনতা লাভে বাংলাবাসীর জাতীয় জীবনে যে নবদিগন্তের সূচনা তাতে সীমাহীন শোষণ ও সুদীর্ঘকালের অবজ্ঞায় নিষ্পেষিত ঔপনিবেশিক জীবনযাত্রা থেকে মুক্তি পাওয়ার এবং নিজেদের নিয়মে চলার, নিজে পায়ে নিজের দাঁড়াবার, বাঁচবার এবং বিকশিত হওয়ার অধিকার অর্জন। বাংলাদেশীদের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রায়, সাংস্কৃতিক সঙ্কীর্তায়নে নতুন দিগন্ত উন্মচিত হয়েছে। নতুন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরুর ক্ষেত্রে বাংলাদেশীরা আমরা নিজেরা নিজেদের প্রশাসনের সুযোগ লাভ এবং নিজেরা নিজেদের উন্নতি ও অবনতির নিয়ন্তা এবং এর সফলতা ও ব্যর্থতার দাবিদার।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে দেশ সমাজ রাজনীতি ও অর্থনীতি কিভাবে নিজের পায়ে নিজেরা দাঁড়াব, দীর্ঘদিনের অবহেলা আর অবজ্ঞায় ধ্বংসপ্রায় অর্থনৈতিক জীবন কিভাবে চাঙ্গা করে তোলা যাবে, কিভাবে সমাজজীবন থেকে বন্ধ্যানীতি কুসংস্কার আর অপয়া ভাবধারা অপসারিত করে জাতিসত্তার বিকাশ ঘটিয়ে জাগ্রত জাতি সভায় বাংলাদেশের অবস্থান ও গৌরব আরো ঐশ্বর্যমণ্ডিত করার সে চেতনা জাগৃতিতে জাতীয় ইতিহাস চর্র্চাও ঘটনা পরিক্রমা এ প্রতীতি জাগাতে পারে যে, এ দেশ ও সমাজ গণতান্ত্রিকমনা, এখানে সবাই সবার উন্নয়ন লক্ষ্যে একাগ্র, সবাই কর্তব্য পালনে নিরলস এবং অনন্য ঐক্যে বিশ্বাসী ও ধাতস্থ। সুতরাং আত্মত্যাগের সুমহান সঙ্কল্পে সবার আত্মমর্যাদা বোধ যেন জাগ্রত থাকে এবং কোনো প্রকার বিভ্রান্তিতে জড়িয়ে, দায়িত্বহীনতায়, অলসতায়, একে অন্যের দোষারোপের অবয়বে নিজেদের আত্মমর্যাদা ও আত্মশক্তির অপচয় অপব্যবহারের অবকাশ সৃষ্টি না হওয়াই বাঞ্ছনীয় ।
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান


আরো সংবাদ



premium cement
মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা বিতর্কের অবসান হোক হাসিনার সামরিক উপদেষ্টাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণ ও কিছু মানুষের স্বপ্নভঙ্গ প্রস্তাবিত ‘দেবোত্তর সম্পত্তি অধ্যাদেশ’ নিয়ে কিছু কথা নোয়াখালীতে ট্রাকচাপায় তরুণ নিহত কোরআনের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালিত হলে কোথাও বৈষম্য থাকবে না দিল্লীকে ‘বাংলাদেশী’ মুক্ত করার ঘোষণা দিলেন অমিত শাহ নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের ভিজিবিলিটি বাড়াতে হবে : উপদেষ্টা রিজওয়ানা রাজশাহীতে দুই মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে দু’জন নিহত ন্যায় বিচারের স্বার্থে ভারত হাসিনাকে ফেরত পাঠাবে, আশা ক্যাডম্যানের নোয়াখালীতে নিখোঁজের ৭ দিন পর শিশুর লাশ উদ্ধার

সকল