ভারত ভাগের প্রাক্কালে চট্টগ্রাম
- ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
- ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের প্রাক্কালে ভারতের কোন্ কোন্ অঞ্চল কার ভাগে পড়বে বা বণ্টিত হবে এ নিয়ে যে দরকষাকষি তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভেদবুদ্ধি ও সুদূরপ্রসারী দুরভিসন্ধির দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। যার ফলে স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীর ভাগ্যে ভারত ভাগের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা শেষমেশ ভয়াবহতম দাঙ্গা, মানবিক বিপর্যয় ও সহস্র্র বছরের সম্প্রীতি সৌহার্দ্য-সম্পর্ক বিনষ্টের হেতুতে পরিণত হয়েছিল। বলাবাহুল্য এখনো তা সংক্রামক ব্যাধির মতো বিভিন্ন আঙ্গিক অবয়বে বিদ্যমান। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ‘নিজেরাই নিজেদের শত্রু’ সেজে বিশ্বাসঘাতকতার বলয়ে যেভাবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল ১৯০ বছর পর ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে প্রায় একই আত্মকলহের ক্যানভাসে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়েছিল। সুদূর লন্ডনে বসে প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল (১৮৭৪-১৯৬৫) ভারত ভাগের নীলনকশা এঁকেছিলেন। ভারতবর্ষের প্রতি তার ছিল নিদারুণ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী। কলোনির প্রজাবিদ্বেষী, মানবতাবিরোধী চার্চিলকে নোবেল পুরস্কার দেয়া নিয়ে প্রশ্ন দিন দিন জোরালো হচ্ছে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে তিনি যে ফন্দি এঁটেছিলেন তার ভেতরেই নিহিত ছিল ভারতবাসীর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি বাদ-বিসংবাদ দ্বন্দ্ব-কলহ সৃষ্টির উপাদান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-৪৫) ব্রিটিশরাজের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বল ক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে ভারতের ক্ষমতা দ্রুত হস্তান্তরের টার্গেট নিয়ে ক্রিপস মিশন এবং র্যাডক্লিফ আসেন সেই ব্লু প্রিন্ট অনুসারে বাউন্ডারি বিভাজনে। ভারতবর্ষের সবচেয়ে উর্বর, ফলনশীল (শুধু খাদ্যশস্যে নয়, মেধা, মানবসম্পদ, নেতা, যোদ্ধা, সাহিত্য সংস্কৃতিতেও) দুই অঞ্চলকে (বাংলা ও পাঞ্জাব) দু’ভাগ করে ডিভাইড অ্যান্ড রুল তত্ত্বে সৃষ্ট চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা এবং ভূস্বর্গ কাশ্মিরকে উভয়ের মাঝখানে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার হিসেবে রেখে দেয়া।
সে বিভাজনে এমন আন্তঃকোন্দলের বীজ রোপিত ছিল, যা এখনো বিষবৃক্ষের ফল ভক্ষণের মতো প্রায় ২০০ কোটি মানুষের জীবন যেন স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’র পরিস্থিতিতে বিদ্যমান। যার জন্য পাকিস্তানের সংসার ২৪ বছরের বেশি টেকেনি, যার জন্য ইতিহাসের ভয়াবহতম গণহত্যার কবলে পড়ে লাখো মানুষের জীবনপাত ঘটেছে পাকিস্তানের সংসার থেকে বাংলাদেশকে বেরিয়ে আসতে এবং যাদের সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে এমন এক প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে স্বাধীন হতে হয়েছে যে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও সম্মান সমীহের সমীকরণে সমমর্যাদা ও স্বার্থ উদ্ধারে, স্বনির্ভর চেতনা ও আত্মমর্যাদাবোধের ভূরাজনৈতিক স্পর্শকাতরতায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। যে পরিস্থিতি আগেভাগে এড়িয়ে চলতে সক্ষম হয়েছিলেন সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান (১৯২৩-২০১৫) আর মালয়েশিয়ার টেঙ্কু আবদুর রহমান (১৯০৩-১৯৯০), তারা সংলাপ ও সমঝোতার ভিত্তিতে বিনা রক্তপাতে ৯ আগস্ট ১৯৬৫ সালে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াকে সমমর্যাদায় আলাদা বা স্বাধীন করতে পেরেছিলেন।
ভারতবর্ষের ভূরাজনীতি ও রাজনৈতিক অর্থনীতির মাঠে এমন একটি আত্মদহনের হতাশাজনক অবস্থার বীজ বপন করা হয়েছিল, তার ফলে এখনো এখানে সেখানে স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন দেখা থেকে নিষ্কৃতি মিলছে না। ভারত ভাগের সময় রাজনৈতিক উৎকোচ, বিভ্রান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক স্বার্থের রশি টানাটানির উপাখ্যান Alex Von Tunzelmann এর ‘INDIAN SUMMER’ the Secret History of the End of An Empire (পিকাডর, নিউ ইয়র্ক, ২০০৭), যেখানে ভারত ভাগ নাটকের গুরুত্বপূর্ণ পর্ব গোপনীয় ও ক্লাসিফাইড তথ্য-উপাত্ত পরীক্ষা পর্যালোচনা করা হয়েছে। তুনজেলম্যানের পড়াশোনা অক্সফোর্ডে, বাস করেন লন্ডনে। ‘ইন্ডিয়ান সামার’ তার প্রথম বই। বইটিতে তার দীর্ঘ দিনের নির্মোহ গবেষণার ভিত্তিতে ভারতে ব্রিটিশ শাসন অবসানে নাটকের নেপথ্য উন্মোচনের প্রয়াস লক্ষ করা যায়। বইটির Rainbow in the Sky অধ্যায়ের ২৪১-৪২ ও ২৫৭ পৃষ্ঠায় চট্টগ্রামকে তদানীন্তন পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) অন্তর্ভুক্তি নিয়ে যে দরকষাকষি হয়েছিল তার তথ্য ও উপাত্তভিত্তিক বিবরণ রয়েছে। আগেই বলেছি, ভারত ত্যাগের প্রাক্কালে ভারত ভাগের সময় সমৃদ্ধ পাঞ্জাব এবং সম্পদশালী বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করাই ছিল ব্রিটিশরাজের প্রধান কূটকৌশল। ব্রিটিশের ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি-দর্শনের আলোকে ধর্মাবলম্বীর প্রাধান্যের বিচার বিবেচনায় বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। গণভোট নিয়ে সাব্যস্ত হয় সিলেট কোন অংশে যাবে।
একসময়ের রাজধানী শিল্পনগরী কলকাতা পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতভুক্ত হওয়ার প্রস্তাব ও দাবির প্রেক্ষাপটে পূর্ববঙ্গ বড্ড বেমানান পরিস্থিতিতে পড়ে, কেননা কৃষিপ্রধান পূর্ববঙ্গের কাঁচামাল সহায়-সম্পদ দিয়ে কলকাতা নগরীর পত্তন, সেই কলকাতাকে কংগ্রেস ভারতভুক্তকরণে অটল থাকায় পাকিস্তান, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গ ব্যর্থ রাষ্ট্র বা পঙ্গুত্ব বরণ করে টিকবে না (at least one half of Pakistan was set up to fail) এ আশঙ্কা প্রবল হয়। ২৬ এপ্রিল ১৯৪৭ ডি মাউন্ট ব্যাটেন (১৯০০-৭৯) মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে (১৮৭৬-১৯৪৮) এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জিন্নাহ চটজলদি জবাব দেন, কলকাতা ছাড়া পূর্ব পাকিস্তান প্রাপ্তির পক্ষপাতী তিনি নন; বরং মনে করেন, দুই বাংলা একত্রে একটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হলে ভালো হবে (নিকোলাস ও অন্যান্য সম্পাদিত দ্য ট্রান্সফার অব পাওয়ার ১৯৪২-৪৭, দশম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৫২)। শরৎচন্দ্র বসু (১৮৮৯-১৯৫০) এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (১৮৯২-১৯৬৩) যুক্ত বাংলার প্রস্তাব তুললে কংগ্রেসের চোখ রাঙানিতে তা উবে যায়। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-৭৫) স্মরণ করেন, ‘শরৎ বাবু কংগ্রেসের নেতাদের সাথে দেখা করতে গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছিলেন। কারণ, সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল (১৮৭৫-১৯৫০) তাকে বলেছিলেন, শরৎ বাবু পাগলামি ছাড়েন, কলকাতা আমাদের চাই-’...মিস্টার প্যাটেল শরৎ বাবুকে খুব কঠিন কথা বলে বিদায় দিয়েছিলেন। কলকাতা ফিরে এসে শরৎ বসু খবরের কাগজে বিবৃতির মাধ্যমে এ কথা বলেছিলেন এবং জিন্নাহ যে রাজি হয়েছিলেন এ কথা স্বীকার করেছিলেন’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ইউপিএল, অষ্টম মুদ্রণ,জানুয়ারি ২০২২, পৃষ্ঠা-৭৪)।
সোহরাওয়ার্দী সাহেব এমন প্রস্তাবও দেন, কলকাতা ভারত ও পাকিস্তানের যৌথ নিয়ন্ত্রণে অন্তত ছয় মাস ‘ফ্রি সিটি’ হিসেবে থাকুক। প্যাটেল মুখের ওপর বলে দিলেন ‘not even for six hours’ (হডসন, এইসভি, দ্য গ্রেট ডিভাইড : ব্রিটেন-ইন্ডিয়া-পাকিস্তান, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৫, পৃষ্ঠা-২৭৬-৭৭)।
ঠিক এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে চট্টগ্রাম দেয়ার পরিকল্পনাতেও কংগ্রেস বাদ সাধল- চট্টগ্রামও ভারতের চাই- যুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যার বেশির ভাগ অ-মুসলিম। অ-মুসলমান প্রধান অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তানে থাকতে পারে না। ভারত চট্টগ্রামও পাবে। এ প্রেক্ষিতে মাউন্টব্যাটেন দেখলেন বঙ্গভঙ্গের সময়ও আসামসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম পূর্ববঙ্গের সাথে ছিল, আজ দার্জিলিং হাতছাড়া পাকিস্তানের, উত্তরবঙ্গের সাথে করিডোর রেখে ভুটান ও নেপালে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হচ্ছে। গভর্নর ফ্রেডারিক বারোজ ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, ‘সে ক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গ স্রেফ পল্লী বস্তিতে (rural slum) পরিণত হবে’। সবার কাছে প্রতীয়মান হলো- পূর্ব পাকিস্তান যাতে টিকতে না পারে তার জন্য এ ব্যবস্থা।
ভারত ভাগের ঠিক দু’দিন আগে সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল মাউন্টব্যাটেনকে লেখা পত্রে জোর দাবি তুললেন, চট্টগ্রাম ভারতের চাই, পাকিস্তানকে এটা দেয়া হবে চরম অন্যায় (manifestly unjust) (মাউন্টব্যাটেন পেপারস, এম বি ১/ডি ৮৫)। মাউন্টব্যাটেন প্যাটেলের এ পত্রে ক্ষেপে গেলেন প্যাটেলের ওপর এবং লিখলেন তার ব্যক্তিগত প্রতিবেদনে- the one man I had regarded as a real statesman with both feet firmly on the ground, and a man of honour whose word was his bond, had turned out to be as hysterical as the rest. (ভাইসরয়ের পার্সোনাল রিপোর্ট নং ১৭, ১৬ আগস্ট ১৯৪৭, দ্য ট্রান্সফার অব পাওয়ার, প্রাগুক্ত, ১২তম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৬১)। প্যাটেলের এই পত্রের প্রেক্ষিতে মাউন্টব্যাটেনের মনে হলো, কলকাতা বঞ্চিত পূর্ববঙ্গে যাতে নিজেই নিজের দুর্ভোগের শিকার হয় (to fail on its demerits) এবং পূর্ববঙ্গ যাতে নিজেই নিজেকে গড়ে তুলতে অক্ষম হয় এমন একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র নির্মাণের (a nation deliberately designed to be incapable) ফন্দি আটা হয়েছে।
শেষ মুহূর্তে চট্টগ্রাম নিয়ে কংগ্রেসের এহেন আপত্তির প্রেক্ষাপটে মাউন্টব্যাটেন প্রমাদ গুনলেন, কিভাবে ফিরোজপুর ভারতকে দেয়ার প্রতিদান হিসেবে পাকিস্তানকে চট্টগ্রাম প্রাপ্তি নিশ্চিত করা যায় তার পথ খুঁজতে গিয়ে, তিনি র্যাডক্লিফের বাটোয়ারা ম্যাপ (রোয়েদাদ) জারি পেছানোর পথ পেয়ে গেলেন। তিনি যত তাড়াতাড়ি নির্বিঘেœ ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায় তত মঙ্গল মনে করলেন। ১৪ ও ১৫ আগস্ট পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণার পর ১৭ আগস্ট র্যাডক্লিফের বাটোয়ারা ম্যাপ জারির দিন সাব্যস্ত হলো। ‘আগে আমি করাচি ও দিল্লির ক্ষমতা হস্তান্তর কাজ নির্বিঘ্নে শেষ করি তারপর ১৭ তারিখ এটি জারি করলে দাঙ্গা ও হাঙ্গামা থেকে আগাম রেহাই মিলবে।’ হলোও তাই। ১৭ তারিখ ম্যাপ দেখে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ হতভম্ব, যুগপৎ খুশি আবার অখুশিও। দ্বিখণ্ডিত পাঞ্জাব ও বাংলা চরম দাঙ্গার মধ্যে পড়ে গেল। দেখা গেল প্রথম তিন দিন (১৪-১৬ আগস্ট) সীমান্তবর্তী জেলা হিন্দুপ্রধান খুলনায় ভারতীয় পতাকা উড়লেও খুলনা পাকিস্তানের এবং মুসলমান প্রধান মালদহে পাকিস্তানি পতাকা উড়লেও মালদহ ভারতের ভাগে পড়েছে। ভূরাজনীতি বিশ্লেষকদের অভিমত হিন্দুপ্রধান খুলনা ভারতের হবে সম্ভবত এ হিসেবে তারা মংলা বন্দরসহ (যদিও তখন চালনা বা মংলায় বন্দর চালু হয়নি) খুলনাকে পাওয়ার দাবিতে আগেভাগে সোচ্চার হয়নি।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান নেতা মহাত্মা করম চাঁদ গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮) ভারত ভাগ ও হস্তান্তরের মধ্যে থাকলেন না; বরং ভারত ভাগের অব্যবহিত পরে যে ভয়াবহ দাঙ্গা বাধে সেখানে তিনি সংখ্যালঘুদের পক্ষ নিতে কলকাতায় অবস্থান নিলেন। ভারত ভাগের মাত্র সাড়ে পাঁচ মাসের মাথায় নাথুরাম গডসের গুলিতে নিহত হন তিনি। সে আরেক প্রসঙ্গ।
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা