১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫ মাঘ ১৪৩১, ১৮ রজব ১৪৪৬
`

শহীদ জিয়ার অনুসৃত আদর্শ এবং অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত

দেশ জাতি রাষ্ট্র
-


‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ।’ বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত এ সঙ্গীত। এটি ছিল শহীদ জিয়ার প্রিয় সঙ্গীত। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি এর দলীয়সঙ্গীত হিসেবে এটি গৃহীত। কোনো অনুষ্ঠানে সঙ্গীতটি যখন বেজে উঠত তখন জিয়াউর রহমান নিজে কণ্ঠ মেলাতেন এর শব্দে শব্দে ও কলিতে কলিতে। সঙ্গীতটি শুধু সঙ্গীত নয়; এটি হয়ে উঠেছিল শহীদ জিয়ার জীবনসঙ্গীত। বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের বিগত অর্ধশতাব্দীর ইতিহাসে এমন কোনো রাষ্ট্রনায়কের সন্ধান পাওয়া যাবে না, যিনি তার শ্রম, সময়, মন-মনন তথা জীবন দিয়ে বাংলাদেশকে ভালোবেসেছেন। তার সততা ও দেশপ্রেম বন্দনার ভাষা নয়; বরং তার জীবনের পলে পলে প্রতিষ্ঠিত সত্য। সততা যদি হয় সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা তিনি তার জীবন ও কর্মের মাধ্যমে তা প্রমাণ করেছেন। দেশপ্রেম যদি হয় দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করা, জীবন দিয়ে তিনি তার সাক্ষ্য রেখেছেন। দেশপ্রেমের আরো অর্থ হয় যদি রাষ্ট্র ও জাতি নির্মাণ তাহলে তিনি তার স্বল্প সময়ের শাসনব্যবস্থায় সেই স্বাক্ষর রেখেছেন।

১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি তার জন্মকাল ধরে হিসাব করলে তিনি যদি বেঁচে থাকতেন তার বয়স হতো ৮৯ বছর। হয়তো বা এ দুর্ভাগ্যবান জাতি তার দীর্ঘ জীবনধারা দিয়ে শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারত। এটি কোনো ভক্তের অতি উচ্চারণ নয়, তার নেতৃত্ব ও কর্মধারা সম্পর্কে অতি বাস্তব উদাহরণ।
জিয়াউর রহমান উত্তরাধিকার সূত্রে নেতা ছিলেন না, ক্ষমতার দাপটে মহত্ত্ব তার প্রতি আরোপিত হয়নি। তিনি নেতৃত্ব ও মহত্ত্ব অর্জন করেছিলেন নিজ কর্তব্যগুণে। তার অবদান, ব্যক্তিত্ব, চরিত্র তাকে মহত্ত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। পৃথিবীর ইতিহাস প্রমাণ করে কোনো কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতিতে একজন মহৎ মানুষ, একজন বীরযোদ্ধা অথবা একজন ত্রাণকর্তা বেরিয়ে আসেন, যিনি দেশ জাতি রাষ্ট্রকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মুহূর্তে এবং পঁচাত্তরের এক সঙ্কটময় অধ্যায়ে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব জাতিকে দিয়েছে অনিবার্য নির্দেশনা এবং কাক্সিক্ষত স্থিতি।
মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক নেতৃত্ব পূর্ববাংলার শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সঙ্কট উত্তরণের কৌশলে রেখে বিভ্রান্ত করে। অন্য দিকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী পূর্ববাংলার নেতৃত্ব জাতির জন্য সামরিক রণকৌশল, গণযুদ্ধ বা গেরিলা যুদ্ধের পরিকল্পনা ছাড়াই আত্মসমর্পণ করেন। নেতৃত্বের অপরাপর অংশ ভারতে পালিয়ে যান।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন ২৫ মার্চ এবং তৎপরবর্তী সময়ে পূর্ববাংলার নিরস্ত্র, নিরীহ মানুষের ওপর গণহত্যা শুরু করে তখন স্বাধীনতাকামী মানুষ অভিভাবকহীন, নেতৃত্বহীন, সিদ্ধান্তহীনভাবে চরম অসহায়ত্ব, অনিশ্চয়তা, হতাশা এবং ভীতির মধ্যে নিপতিত হয়। এ সঙ্কটময় সময়ে একটি কণ্ঠ একটি বীরোচিত ঘোষণা দেন: ‘আমি মেজর জিয়া বলছি’ এতে গোটা জাতি আন্দোলিত হয়। মেজর জিয়ার এ অকুতোভয় ঘোষণা গোটা দেশে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। সেই সাথে অনিশ্চিততার অবসান ঘটায়। ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ।
রাজনৈতিক নেতৃত্ব ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে অস্থায়ী সরকার গঠন না করা পর্যন্ত কার্যত জিয়াই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক। জিয়া শুধু ঘোষণা দিয়ে ক্ষান্ত হননি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তিনি প্রথম সূচনাকারী। জিয়া চট্টগ্রামে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তা ও সৈনিকদের উদ্দেশে ভাষণ দেন এবং সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার নির্দেশ দেন। জিয়া বললেন, ‘আমরা স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করলাম।’ জিয়ার নেতৃত্বে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিহত করে। পরে তারা ভারতে প্রবেশ করেন। ৭ জুলাই ১৯৭১ গঠিত হয় জিয়ার নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে ‘জেড’ ফোর্স। তিনি হন সেক্টর কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধে জেড ফোর্স বিশেষ অবদান রাখে। ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার নেতৃত্বে সংঘটিত চট্টগ্রামের প্রতিরোধ যুদ্ধকে স্টালিনগ্রাদের যুদ্ধের সাথে তুলনা করেন। পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য তিনি বীরোত্তম উপাধিতে ভূষিত হন।

একসাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা শিগগির রাজনৈতিক নিপীড়ন, অর্থনৈতিক সঙ্কট, সামাজিক উত্তেজনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। (হাবিব জাফরুল্লাহ : ১৯৯৬ : এ) ১৯৭৫ এর মধ্য আগস্টের ঘটনাবলি জাতিকে রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে সামরিক সঙ্কটে নিপতিত করে। অভ্যুত্থান, প্রতি অভ্যুত্থান, ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চক্রে পঁচাত্তরের ৩-৭ নভেম্বর জাতি এক অনিশ্চিত সময় অতিক্রম করে। এ সময়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান গৃহবন্দী হন। পাল্টা অভ্যুত্থানের নেতারা পরাক্রমশালী প্রতিবেশীর তাঁবেদার বলে প্রতিভাত হওয়ায় সংঘটিত হয় এক অচিন্তনীয় ঘটনা। সাধারণ সৈনিকরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসেন। ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি উচ্চারণ করে বেরিয়ে আসা সৈনিকদের স্বাগত জানান দেশের সাধারণ মানুষ। রচিত হয় সৈনিক জনতার এক অপূর্ব মেলবন্ধন। ব্যক্ত হয় স্বাধীনতার ঘোষক জিয়ার প্রতি সৈনিক ও সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন। মুক্ত হন ‘গৃহবন্দিত্ব’ থেকে। তাকে সেনানিবাসে আনা হয়। তিনি হৃত সেনাপ্রধানের পদে অধিষ্ঠিত হন। ঘটনা পরম্পরা অবশেষে জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করে। হি ওয়াজ প্লেসড টু দ্য পাওয়ার (এমাজউদ্দীন : ২০০০)। বাম ধারার বিপ্লবীদের পক্ষ থেকে স্লোগান উচ্চারিত হয়, ‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই’। লিফলেট বিতরণ করা হয়। সৈনিকদের আবারো ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসতে বলা হয়। সর্বাত্মক অরাজকতা সৃষ্টি হয় প্রায় সব সেনানিবাসে। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব, কঠোর পরিশ্রম, নির্দেশনা, ব্যবস্থাপনা, অফিসারদের প্রণোদনায় অবশেষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়। সুতরাং যৌক্তিকভাবে বলা যায়- He (Zia) saved Bangladesh military from an impending doom (Marcus Franda : 1982 : 258)

পরবর্তী পাঁচ বছরে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনেন। এসব কিছুকে আদর্শ বা নীতিগত, কাঠামোগত, আইনগত, উন্নয়নগত ও প্রথাগত পরিবর্তন বলে চিহ্নিত করা যায়। বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-অনুভূতি-বিশ্বাস ও জীবনবোধের নিরিখে তিনি সংবিধান সংশোধন করেন। ‘বিসমিল্লাহ’ সংযোজন করেন। ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে আল্লাহর প্রতি গভীর আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সূচনা করেন। সংবিধান ও উন্নয়ন কৌশলে সমাজতান্ত্রিক ধারা (তথাকথিত অধনতান্ত্রিক পথ) পরিহার করেন, মুক্ত অর্থনীতি, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি, রাজনীতিতে উগ্র বাম ও উগ্র ডানের সমদূরত্বে মধ্যপন্থা অনুসরণ করেন। বাকশালের মাধ্যমে নিষিদ্ধ বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন করেন। সর্বাত্মক এ পরিবর্তনের নিরিখে সমাজতাত্ত্বিকরা তাকে আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি বলে অভিহিত করেছেন। Zia imprinted and indelible mark in Bangladesh’s history a mark that will continue to influence its political and economic domains for a long time to come. (Habib Jafrullah : 2000 : A)

সমসাময়িক পৃথিবীর ইতিহাসে শহীদ জিয়া সততার এক উত্তম উদাহরণ। একজন মানুষের জীবনচক্রে যে ধাপগুলো রয়েছে তা ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামষ্টিক জীবন। এ ত্রিবিধ পর্যায়ে জিয়াউর রহমান সততা স্থাপন করে গেছেন। ব্যক্তিগত পর্যায়ে তিনি সহজ সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করেছেন। অর্থ, বিত্ত ও সম্পদের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল না। বিস্ময়কর উদাহরণ হলো প্রেসিডেন্ট পদে থাকা অবস্থায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হাউজিং সোসাইটিতে নেয়া তার প্লটের কিস্তি দিতে অপারগ হন তিনি। অবশেষে প্লটটি ছেড়ে দেন। তিনি সেনানিবাসের যে বাড়িতে থাকতেন সেখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে অস্বীকার করেন। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠান কিংবা বিদেশ ভ্রমণে কৃচ্ছ্রতা দেখিয়েছেন। একজন প্রেসিডেন্ট সফর শেষে বেঁচে যাওয়া ডলার ফেরত দিয়েছেন এরকম উদাহরণ বিরল। আরাম-আয়েশ, বিলাস-ব্যসন পরিত্যাগ করে তিনি বস্তুত সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। তিনি নেতাকর্মীদের খাই খাই রবকে ভর্ৎসনা করেছেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতীয় সঙ্কট উত্তরণে এবং জনগণের অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধির জন্য জিয়াউর রহমানের অবদান অম্লান, ভাস্বর, স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ভারতের প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডির ভাষায়- your position is already assured in the annals of history of your country as a brave fighter who was the first to declare the independence of Bangladesh. Since you took over the reins of government in your country, you have earned wide respect both in Bangladesh and abroad as a leader truly dedicated to the progress of your country and wellbeing of your people.

বাংলাদেশী জাতির এক সঙ্কট-সন্ধিক্ষণে আমরা জিয়াউর রহমানের ৮৯তম জন্মবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছি। প্রথিতযশা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জিল্লুর আর খান বাংলাদেশ জাতি রাষ্ট্রের ইতিহাসকে ক্রাইসিস টু ক্রাইসিস বলে বর্ণনা করেছেন। ২০২৪ সালের গণবিপ্লবের পর যে সময়টি স্বস্তির সাথে অতিক্রান্ত হওয়ার কথা সেখানে আমরা এখনো একটি অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা ও অপারগতার পর্যায় অতিক্রম করছি। জুলাই বিপ্লবের রক্তস্রোতের মাধ্যমে যে জাতীয় অটুট ঐক্য অর্জিত হয়েছিল তা যেন আজ ম্লান হয়ে আসছে। সর্বত্র ক্ষমতা ধারণ ও আরোহণের অদৃশ্য-অনাকাক্সিক্ষত দৃশ্য অনুভূত হচ্ছে। অথচ এ দেশ-জাতি-রাষ্ট্র জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে অপেক্ষমাণ। সবাই বলেন ও বোঝেন যে, শুধু একটি জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে চলমান সঙ্কটের সমাধান সম্ভব। বাংলাদেশের ইতিহাসে শহীদ জিয়াউর রহমান তত্ত্ব ও বাস্তবতায় এ জাতিকে সেই প্রত্যাশিত ঐক্য উপহার দিয়েছিলেন। জাতীয় জীবনের এই সঙ্কট সন্ধিক্ষণে জিয়াউর রহমানের প্রদর্শিত পথে নিহিত রয়েছে এই জাতির মুক্তি।
আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের। প্রয়োজন তার সঠিক দিকনির্দেশনা ও দেশপ্রেমের। তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রকৃষ্ট পন্থা হলো, তিনি যেভাবে এবং যে প্রক্রিয়ায় স্বল্প সময়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের চেহারা পাল্টে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন, সেসব গুণপনার অনুশীলন এবং তার সততা ও দেশপ্রেমের আদর্শকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন।
(লেখাটি জিয়াউর রহমানের ৮৯তম জন্মবার্ষিকী পালন উপলক্ষে প্রেস ক্লাবে ‘মুক্ত চিন্তা বাংলাদেশ’ আয়োজিত আলোচনা সভার সূচনা বক্তব্য)
লেখক : প্রফেসর (অব:) সরকার ও রাজনীতি বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল : [email protected]

 


আরো সংবাদ



premium cement