১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫ মাঘ ১৪৩১, ১৮ রজব ১৪৪৬
`

মাথাটা যার ব্যথাটাও তার

-


সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না, অতি পুরনো কথা: বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক কারণে এর পুনরুক্তি করছি। সময়ের বিধান এমনই যে, এই মুহূর্তটি ঠিক পরবর্তী মুহূর্তে পৌঁছলেই নতুন দ্যোতনা নতুন অনুভব-অনুভূতি এবং নতুন প্রয়োজন অনুভূত হয়। সে জন্য বোদ্ধাদের অভিমত, সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। সবারই জীবন একটা সেটি ঘণ্টা, মিনিট ও সেকেন্ডে বাঁধা। ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সরকার কারো পক্ষে এ ধারা অতিক্রম করা অসম্ভব। বাংলাদেশে গত ৫২ বছরে সময়ের কি কোনো মূল্য ছিল। সময়কে ধারণ করার কোনো অনুশীলন কি ছিল। ছিল না বলে গত ৫২ বছরে সময়ের কাজ সময়ে করা হয়নি। ফলে হাজারো প্রয়োজন, সঙ্কট-সমস্যা স্তূপ হয়ে এখন সমস্যার পাহাড় হয়েছে। জঞ্জাল আর আবর্জনা জমে এ জনপদ এখন বসবাসের উপযোগিতা হারিয়ে ফেলেছে। গত ৫২ বছরে যত সরকার দায়িত্বে ছিল তাদের এ জন্য কি ন্যূনতম কোনো অনুতাপ ছিল, না আছে। কারো কাছে কেউ কোনো জবাবদিহি করেছে, এমন দৃষ্টান্ত কি আছে। উত্তর, না। এমন নিরঙ্কুশ ‘স্বাধীনতাই’ স্বেচ্ছাচার তথা স্বৈরাচারের জন্ম দেয়।

সময়ের এক ফোঁড়ে যে কাজ হতে পারত এখন দশ ফোঁড়েও সম্ভব নয়। এর দায় কাদের? গত ৫২ বছরে রাষ্ট্রযন্ত্র যাদের হাতে ছিল কমবেশি সবাইকে এর দায় নিতে হবে। এই বাংলাদেশে গত ৫২ বছরে কেউ নির্বাচিত রাজনৈতিক শাসক, কেউ অনির্বাচিত শক্তিধর কর্তৃপক্ষ আবার কেউ নির্বাচনী খেলতামাশা করে ক্ষমতা কব্জা করেছেন। সম্প্রতি পতিত লীগ কয়েক দফায় সব চেয়ে দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রশাসন করেছে (দায়িত্ব পালন নয়)। তা ছাড়া ২০১৪ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত লীগ জনগণের ম্যান্ডেট গ্রহণ ছাড়াই একটানা ১৫ বছর রাষ্ট্রযন্ত্র দখলে নিয়ে ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছে। তারা লুটপাট করেছে, গণতন্ত্রের মুখোশ পরে বাংলাদেশে চোরতন্ত্র কায়েম করেছিল। চোরতন্ত্রে যা হয়, সেটিই হয়েছে। জাতীয় সম্পদ গ্রাস, পাচার আর অপচয় করেছে। বাংলাদেশ এখন এক বিরান জনপদের নাম। এর দায়ভার ১৬ আনার ১০ আনা লীগ সরকারের; বাকি ছয় আনা অন্যসব শাসকের। তবে ভারতের কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়ার প্রতিযোগিতায় লীগের ‘অবদান’ ছিল অভাবনীয়। ভারত কিছু চাওয়া মাত্র শেখ হাসিনা সে প্রয়োজন পূরণ করতেন। তিনি গর্বের সাথে বলতেন, ভারতকে আমি কী দেইনি। তবে ভবিষ্যতে এটাই নেমেসিস, এমন ভাগবাঁটোয়ারা করায় লীগের ও জাপার পরিণতি নিয়ে আজকে সবার শতবার চিন্তাভাবনা করতে হবে। দুর্ভাগ্য এ জাতির, ইতোমধ্যে কারো কারো বিরুদ্ধে আওয়ামী ও ভারতপ্রীতির, তাদের শৈলী অনুসরণের অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে।

ইদানীং কেউ কেউ কণ্ঠে কিছুটা বিষাদের সুর নিয়ে প্রশ্ন করতে চান, আওয়ামী লীগ দেশের এমন কী ক্ষতি করেছে যে, তাদের প্রতি কিছুটা নমনীয় হওয়া যাবে না। তবে সাথে সাথে আবার ক্ষুব্ধতা মিশিয়ে অনেকে প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন, পতিত লীগ এই জনপদের কোন ক্ষতিটা করতে বাদ রেখেছে। সেটিই বরং এখন পরিমাপ করা যেতে পারে তাদের কুকীর্তির যত খতিয়ান। প্রথমত, রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান উপাদান হচ্ছে সার্বভৌমত্ব, যা শুধু ভৌগোলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করে না। এর সাথে জাতির অস্তিত্বের সম্পর্ক। সেই সার্বভৌমত্ব ইজারা দেয়ার সব বন্দোবস্ত প্রায় সম্পন্ন করেছিল লীগ সরকার। বাংলাদেশকে বিকিয়ে দেয়ার এমন অভিব্যক্তি বহু আগে ব্যক্ত করেছিলেন শেখ হাসিনা। সে পথে দ্রুত অগ্রসর হতে এ জনপদের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করেছিলেন হাসিনা। যাতে কেউ তার দুরভিসন্ধি ও দুরাচারের প্রতিবাদ করতে না পারেন। লীগ নেত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো ধ্বংস করে স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় জবরদস্তি ঢুকিয়ে দিয়েছিল। গত ১৫ বছরে লীগ দেশের কোনো সাংবিধানিক, রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের আদলে বা আদর্শে গড়ে উঠতে দেয়া হয়নি। কেননা, লীগ নেত্রীর চিন্তাচেতনা ও স্বপ্নই ছিল ‘মহাভারতের’ ভারত সলিলে এ দেশের সব কিছু লীন করে দেয়া। পতিত নেত্রীর স্বপ্নসাধ পূরণ হলে জনপদের অধিবাসীদের স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য বিবেচনাবোধ, নীতি-নৈতিকতার সব বৈশিষ্ট্য আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যেত না।

বাংলাদেশে মানুষের সবচেয়ে মনোবেদনার কারণ ছিল, রাষ্ট্রের মৌলিক তিন স্তম্ভ ভেঙে ফেলার পর চতুর্থ স্তম্ভে ফাটল ধরিয়ে দেয়া। এ চতুর্থ স্তম্ভ তথা সংবাদমাধ্যমকে গোটা বিশ্বে ‘ওয়াচডগ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ ‘ওয়াচডগের’ ভূমিকা হলো সমাজ-রাষ্ট্র আর ব্যক্তির কারো আচরণে এতটুকু ব্যত্যয় ঘটছে কি না তা খেয়াল রাখা। তেমনটি ঘটলে তারা শোরগোল তোলে, হাঁকডাক করে দেশে-বিদেশে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যাতে সবাই সতর্ক হয়। এই ওয়াচডগদের পোষ মানানো গেলে সব প্রতিকার-প্রতিরোধের বিরুদ্ধে এক প্রাচীর গড়ে তোলা যাবে। দিন শেষে দেখা গেল, সেই চতুর্থ স্তম্ভের অধিবাসীরা লীগ নেত্রীর পদলেহী হওয়ার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন। গোটা বিশ্বে যেখানে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ থাকে আপসহীন এবং শাসকের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে এতটুকু দ্বিধা করে না, সেখানে বাংলাদেশের মিডিয়ার ভূমিকা ছিল আওয়ামী লীগ নেত্রীর ‘ফুটানিকা ডাব্বা’ (রূপচর্চার বাক্স) বয়ে বেড়ানোর। যারা এমন কুকর্মের বাইরে থাকতেন তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা হয়েছিল। লীগ নেত্রীর পদসেবকদের ভাগ্যে উপঢৌকন ঘটেনি তা কিন্তু না।

শেখ হাসিনা যে রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন তার জের জনগণের জন্য কতটা ভয়ঙ্কর ও দুঃসহ ছিল, সেই অভিজ্ঞতা জনগণ অর্জন করেছিল।
অতীতের মতো কোনো ব্যবস্থা আবারো কায়েমের কোনো চেষ্টা আর বরদাশত করবে না এ দেশের মানুষ। সে জন্য ভবিষ্যতে কোনো ব্যক্তি বা দলের ভেতর, শেখ বা তার দলের কোনো অপছায়া এবং পতিত যুগের সব শৈলীকে এখনই ধ্বংস করতে হবে। তা না হলে মানুষের ১৫ বছরের অন্তর্জ্বালা কিছুতেই জুড়াবে না। সম্মুখে সব রিকাস্ট করতে অর্থাৎ পুরো ‘খোলনলচে’ বদলাতে হবে। যাকে পরিশীলিত ভাষায় বলা হচ্ছে সংস্কার। এটি শুধু জরুরি নয়, বর্তমান সময়ে প্রথম অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রয়োজনীয় সংস্কার না হলে, পুরনো ব্যবস্থা নিয়ে চললে জনগণ নিকট অতীতের মতোই প্রতারিত হবে। সবাই দেখছে, সংস্কার নিয়ে অনেকের মনে কত শঙ্কা। সংস্কার চিন্তা এক পাশে সরিয়ে রেখে তারা দ্রুত নির্বাচনী তরীতে উঠে তীরে উঠতে চায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের অধিবাসীদের অনেকে গতানুগতিক পথে চলতে চলতে এতটা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন যে, তাদের নতুনের প্রতি কোনো আগ্রহ উৎসাহ নেই। এ পশ্চাৎপদতা বা রক্ষণশীলতা কখনো রাষ্ট্র বিনির্মাণের অনুকূলে যায় না। অনেকে বর্তমান সংবিধান নিয়ে সংবেদনশীল হয়ে উঠেছেন। কিন্তু তারা সংবিধান নিয়ে অতীতে কোথায় ছিলেন সেটিও প্রশ্ন। এ নিয়ে অগ্রসর হলে অনেকের ‘গলার কাঁটা’ হয়ে ফুটবে। যার ভিন্নমত জানাচ্ছেন তাদের অনেকের সংবিধান নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা আছে কি-না, সে প্রশ্ন অনেকে তুলছেন। তবে লিগ্যাল এক্সপার্টদের মতামত কেমন সেটি জানা দরকার। সম্প্রতি এক আলোচনায়, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান তার অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন, পৃথিবীর সব দেশে বিপ্লবের পর বিপ্লবী পরিষদ হয়। ক্ষমতা নেয় একটি প্রক্লেমেশনের মাধ্যমে। বিপ্লব কিন্তু সংবিধান মেনে হয় না।

পৃথিবীতে যত বিপ্লব হয়েছে, সেগুলো একটি নতুন লিগ্যাল অর্ডার তৈরি করেছে। সেই লিগ্যাল অর্ডারের যে ভিত্তিভূমি, তা সমূলে গ্রহণ করতে হয়। প্রক্লেমেশন সেই বিপ্লবী পরিষদকে ক্ষমতা দেয়। সেই প্রক্লেমেশনের পক্ষে থাকে সব জনগণ। এখনো সেটি হয়নি, না করায় বিপদ হবে। এটি খেয়াল করা হচ্ছে না কেন। বর্তমান সংবিধান নিয়ে যারা চলছেন, আপনাদের এ সংবিধানের এখন কোনো অস্তিত্ব নেই। যদি তাই হয় তবে নির্বাচনসহ অনেক ব্যাপারেই কথা বলার অবকাশ আছে। যা-ই হোক, গত ৫২ বছরে বিদ্যমান সংবিধান কে কতটা অনুসরণ করেছে তার একটি মাত্র উদাহরণ পেশ করা হলো। সংবিধানের ১৮(ক) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ জলাভূমি বন সংরক্ষণ করবেন। অথচ বাংলাদেশ এখন পরিবেশগত সমস্যা নিয়ে চরম দুর্ভোগে রয়েছে। খোদ রাজধানী ঢাকা এখন ‘বিষাক্ত এক গ্যাস চেম্বারে’ রূপ নিয়েছে। ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা ভয়াবহ। বায়ুদূষণে মানুষের গড় আয়ু দুই বছর কমেছে, নানা অসুখ-বিসুখ সৃষ্টি হচ্ছে। অপর দিকে, সারা দেশে বন-বনানী উজাড় হচ্ছে, জলাভূমি ভরাট করা হচ্ছে, পাহাড়-পর্বত কাটা হচ্ছে, নদীদূষণ ভয়াবহ। অতীতে দেশের পরিবেশ নিয়ে সব সরকারই যেন গভীর নিদ্রায় বিভোর ছিল।

নির্বাচন প্রসঙ্গে কিছু বলা অনিবার্য হয়ে ওঠে। জার্নি টু ইলেকশন নিয়ে প্রচুর কথাবার্তা হচ্ছে। কেউ কেউ একে অতিকথন বলে মনে করছে। এ নিয়ে তর্কবিতর্ক না করে সংলাপ-সমঝোতায় পৌঁছাই ভালো। যাই হোক, নির্বাচন-সংক্রান্ত বিষয়টি একান্ত বাংলাদেশের, তাই এ নিয়ে মাথা ব্যথাটা বাংলাদেশীদের হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক সেটিই যদি এ দেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের কারো মাথাব্যথা শুরু হয়। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত বীণা সিক্রি সম্প্রতি সে দেশের সোশ্যাল মিডিয়ায় বলেছেন, বাংলাদেশে এখন সংস্কারের আগে নির্বাচন অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। বাংলাদেশের মানুষের প্রথম চয়েস কোনটি হবে আর দ্বিতীয়টি কী হবে তা নিয়ে শ্রীমতি সিক্রির অযাচিত পরামর্শ তো এ দেশের কেউ ‘সিক’ করেনি। আপনি তো অতীতে এ দেশে নির্বাচন নিয়ে শুধু চাপ, তাপ ও জবরদস্তি করেছেন। যা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অভিযাত্রাকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছে। বাংলাদেশ এখন সেলফ হেল্পে বিশ্বাসী। আমাদের প্রায়োরিটি আমাদেরকেই বুঝতে দিন। অন্যের মাথা না ঘামালেও চলবে।
[email protected]

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement