স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান
- ড. আবদুল আলীম তালুকদার
- ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
১৯৭১-এর মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীনতার মহান ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবদান প্রাতঃস্মরণীয়। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণার প্রতীক, স্বপ্নের দিশারি ও এক অদম্য সাহসী যোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার শহীদ জিয়া আজকের দিনে জন্মগ্রহণ করেন।
গণতন্ত্রের প্রাণপুরুষ শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার গাবতলী থানার বাগবাড়ী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে জিয়াউর রহমান ছিলেন দ্বিতীয়। তার শৈশব কেটেছে আংশিক কলকাতায় এবং আংশিক বগুড়ার গ্রামাঞ্চলে।
জিয়াউর রহমান ১৯৫২ সালে করাচির স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৩ সালে তিনি কাকুলে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৫৫ সালে সামরিক বাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। করাচিতে দুই বছর চাকরি করার পর ১৯৫৭ সালে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন। এ ছাড়া তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে খেমকারান সেক্টরে অসীম সাহসিকতার সাথে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দ্বিতীয় কাশ্মির যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে একজন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যার জন্য তিনি বীরত্বসূচক ‘হিলাল-ই-জুররাত’ খেতাব লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি মেজর পদে পদোন্নতি পেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি পশ্চিম জার্মানি থেকেও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী গভীর রাতে পূর্ব পাকিস্তানের ঘুমন্ত, নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর বর্বর হামলা চালিয়ে হত্যা ও মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে এক ভীতিকর পরিস্থিতি শুরু করলে মুক্তিযোদ্ধা জিয়া দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সে সময় নিজের পাকিস্তানি অধিনায়ককে বন্দী করে একটি অমিত সাহসিকতার পরিচয় দেন।
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ক্ষণজন্মা রাষ্ট্রনায়ক। নানা কারণে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে স্থান করে নিয়েছেন। তার সততা, নিষ্ঠা, গভীর দেশপ্রেম, ইস্পাত কঠিন কর্মস্পৃহা, ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বগুণ এ দেশের গণমানুষের হৃদয় স্পর্শ করেছিল। তিনি একজন পেশাদার সৈনিক হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল আকাশচুম্বী। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ জনগণ যখন চরম ভীতি ও হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল তেমনি এক কঠিন সময়ে ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তার ‘আমি মেজর জিয়া বলছি’ ঘোষণার মধ্য দিয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও আশান্বিত করে তোলে।
মুক্তিযুদ্ধে ১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তিনি ছিলেন বীরত্ব ও সাহসিকতার মূর্তপ্রতীক। মুক্তিযুদ্ধে তার আত্মত্যাগ, নেতৃত্ব এবং দেশপ্রেমের বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক সম্মাননা ও জীবিত সেনা কর্মকর্তাদের জন্য সর্বোচ্চ ‘বীর উত্তম’ পুরস্কারে ভূষিত হন।
দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হলে লাল পতাকায় শোভিত স্বাধীন দেশে তিনি পুনরায় সেনাবাহিনীতে ফিরে যান এবং ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে তিনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সংঘটিত নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের পর দেশী-বিদেশী চক্রান্তের ফলে যে প্রতিবিপ্লবের সূচনা হয়, তার ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারান্তরীণ হন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ৩ নভেম্বর শুধু জিয়াউর রহমান কারান্তরীণ হননি, শৃঙ্খলিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। ৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের এক বাঁক বদলের উপাখ্যান। কেননা, ৩ নভেম্বর যেমন ছিল স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হরণের দিন। তেমনি ৭ নভেম্বর ছিল শৃঙ্খল মুক্তির এক শুভক্ষণ। এই মহান দিনে আধুনিক ও জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশের জনক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মুক্তির ভেতর দিয়ে মুক্ত হয় বাংলাদেশ। আর এই মুক্তির নেপথ্যে কারিগর ছিল বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের অন্তর্গত স্পৃহা ও বীর সেনানীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। যার দরুন ৭ নভেম্বরের বিপ্লব ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে চিরভাস্বর হয়ে আছে সিপাহি-জনতার বিপ্লব নামে।
সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রশ্নাতীত জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা তাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পাদপীঠে আসীন করে। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পরে ১৯৭৮ সালের ২৩ জুন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য সমমনা জোট সমর্থিত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানই জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। জনগণের ওপর বাকশালীয় প্রথা চাপিয়ে দেয়া তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকার গণমাধ্যমের ওপর নানান মনগড়া কালাকানুন চাপিয়ে দেয়। তিনিই এসব কালাকানুন প্রত্যাহার করে মুক্ত স্বাধীন গণমাধ্যম চালু করেন। একটি রাজনৈতিক সরকার যেখানে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে গণতন্ত্রকে সঙ্কুচিত করেছিল তখন জাতির প্রয়োজনে সামরিক বাহিনী থেকে আসা একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী সৈনিক স্বাধীনতার অন্যতম মূলস্তম্ভ বহুদলীয় গণতন্ত্র জাতিকে উপহার দিয়ে মুক্ত গণতান্ত্রিক চর্চার পথকে সুগম করেছিলেন। তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন এবং বলতেন, ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়; দেশপ্রেম সবার ঊর্ধ্বে।’
তিনি ১৯৮১ সালে ১৯৭৫ সালের মর্মন্তুদ ঘটনায় নিহত শেখ মুজিবুর রহমানের নির্বাসিত কন্যা শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরে আসার অনুমতি দেন।
শহীদ জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন জুনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও তিনি তার যোগ্যতা, দক্ষতা, মেধা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা দিয়ে সবার মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি তার জীবদ্দশায় দেশের প্রায় প্রতিটি ক্রান্তিকালে অসামান্য অবদান রেখেছেন। সততার প্রশ্নে তিনি ছিলেন অনন্য। তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই দেশের চলমান অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করেন। গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা সচল করার জন্য ১৯৭৫ সালের শেষের দিকে যশোরের উলশী গ্রাম থেকে স্বনির্ভর আন্দোলন কর্মসূচির সূচনা করে গ্রামীণ জনপদের প্রতিটি মানুষকে স্বনির্ভর হতে উদ্বুদ্ধ করেন। খাদ্যে স্বাবলম্বী হওয়ার বিষয়টিকে জিয়াউর রহমান তার জাতীয় নীতি হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
বহির্বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে শহীদ জিয়ার গ্রহণযোগ্যতা ছিল তুঙ্গে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক ঐক্য সৃষ্টির জন্য দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব তিনিই করেছিলেন। তার এই ধীসম্পন্ন ও সুদূরপ্রসারী প্রস্তাবটি ১৯৮৫ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সভাপতিত্বে ঢাকায় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার প্রথম বৈঠকে বাস্তবায়িত হয় এবং সার্ক গঠিত হয়। তিনিই সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা।
শহীদ জিয়া তার সাহসী, চৌকস ও দূরদর্শী পররাষ্ট্রনীতির কারণে মুসলিম বিশ্বের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। স্বল্প সময়ের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকালে ইরান-ইরাক যুদ্ধে একক মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা পালন, জায়নবাদীদের কবল থেকে ফিলিস্তিন মুক্ত করার আন্দোলন আল কুদস কমিটির সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়া, ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি অবিচল সমর্থন এবং ওআইসিকে একটি কার্যকর সংগঠনে পরিণত করার ক্ষেত্রে শহীদ জিয়ার ভূমিকা মুসলিম বিশ্ব আজো শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।
আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি জিয়াউর রহমান। তিনি বাংলাদেশ পাট ও ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট চালু করেন। একটি উচ্চাভিলাষী গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচি চালু করেন, গ্রামের মানুষের অধিকতর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ১৯৭৬ সালে ভিডিপি বা গ্রাম প্রতিরক্ষা দল গঠন করেন, শিশুদের মেধা বিকাশের জন্য শিশু একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন, টিভিতে নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতা চালু করেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার হাত ধরেই গড়ে ওঠা সে দিনের নবজাতক গার্মেন্ট শিল্প আজ দেশের অন্যতম প্রধান রফতানি খাত।
বিজ্ঞান শিক্ষার প্রচার ও প্রসার এবং বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনে তিনিই প্রথম দেশে পৃথক একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। সাধারণ শিক্ষার সাথে মাদরাসা তথা ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয় সাধন করে নৈতিকতাসম্পন্ন সুনাগরিক গড়ে তোলার লক্ষ্যে স্বাধীন দেশে সর্বপ্রথম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।
তার সাহসিকতা আর দেশপ্রেম আজো আমাদের পথ দেখায়, মনে করিয়ে দেয় স্বাধীনতার জন্য তার সেই আত্মত্যাগের কথা।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক,
শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ, শেরপুর
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা