আমার বাবা ব্যারিস্টার এ আর ইউসুফ
- ব্যারিস্টার রিজওয়ানা ইউসুফ
- ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
আমার বাবা মরহুম ব্যারিস্টার এ আর ইউসুফ (১ জানুয়ারি ১৯৩২- ১১ জানুয়ারি ২০০২) ছিলেন দেশের স্বনামধন্য আইনজীবী। ছাত্ররাজনীতি থেকে শুরু করে ৭০ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী/উপদেষ্টা এবং সর্বোপরি একজন সফল আইনজীবী হিসাবে অসংখ্য বন্ধু, সহকর্মী ও শুভাকাক্সক্ষীর প্রিয় ‘ইউসুফ ভাই’ নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন।
১৯৩২ সালের ১ জানুয়ারি, দিল্লিতে আমার বাবার জন্ম। দাদা কে আর খাদেম ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতে ঢাকার এসডিও। তবে আমরা মূলত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার খড়মপুর গ্রামের খাদেম পরিবারের সদস্য। আমার বাবা ১৯৪৮ সালে এসএসসি ও ১৯৫০ সালে এইচএসসি পাস করেন। ছাত্রজীবনে তিনি এটিএম তাহা ও ফরমানুল্লাহ খানসহ ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফ্রন্ট (এনএসএফ) প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খান এনএসএফের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলে তিনি দল থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করে এলএলবি ডিগ্রি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তিনি ১৯৬৫ সালে ব্যারিস্টারি পাস করেন।
একজন খ্যাতনামা আইনজীবী : ১৯৯১ সালের সম্ভবত ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযমকে দলের আমির ঘোষণা করে। সে সময় অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব ছিল না। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, যে মানুষটির জন্ম বাংলাদেশে তার কেন নাগরিকত্ব থাকবে না? নাগরিকত্ব না থাকার কারণে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আদেশের ৩ ধারা অনুযায়ী ১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিল একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে তার নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়।
অধ্যাপক গোলাম আযমকে জামায়াতের আমির ঘোষণা করার পর ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক করে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করা হয়। দেশে তখন এই নিয়ে চলছে রাজনৈতিক যুদ্ধ। ১৯৯২ সালের ২৪ মার্চ মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে ১৬ মাস কারাগারে রাখা হয়। কারণ দেখানো হয় যে, ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও তিনি অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন।
মরহুম গোলাম আযম বন্দী অবস্থায় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চেয়ে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন। তখন দেশে অনেক বিজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবী মরহুম আযমের পাশে দাঁড়াতে চাননি। তখন আমার বাবা ব্যারিস্টার এ আর ইউসুফ এই মামলার আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালনে সম্মত হন। আব্বার সাথে ছিলেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। যতটুকু মনে পড়ে সে সময় বাবা ও রাজ্জাক আঙ্কেলের সাথে সবচেয়ে বেশি কষ্ট করেছিলেন শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। মামলা চলার সময় প্রতিদিনই মুজাহিদ সাহেব সকালে আমার বাবা ও ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের সাথে কোর্টে যেতেন। বিকেল পর্যন্ত থেকে এক সাথে ফিরতেন। আবার প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাবার চেম্বারে আসতেন। আব্বার ইন্তেকালের পর জামায়াত থেকে জনাব মুজাহিদকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আমাদের পরিবারের দেখাশোনা করার। তিনি গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সে দায়িত্ব পালন করেন।
হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলা চলে প্রায় দুই বছর। সেই সময় অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আমিনুল হক। তিনি অত্যন্ত পরিপক্বভাবে মামলার যুক্তিতর্ক সাজিয়েছিলেন। তার সাথে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে ছিলেন উপদেষ্টা হাসান আরিফ। আমিনুল হক স্যার তার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লড়াইটি লড়েছিলেন সরকারের পক্ষে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে। কিন্তু মামলার যুক্তিতর্ক ও আইনের বিভিন্ন ব্যাখ্যায় সে মামলায় সরকার হেরে যায়।
অধ্যাপক গোলাম আযম ও জামায়াতে ইসলামীকে আল্লাহর মেহেরবানিতে ঐতিহাসিক জয় এনে দেন আমার বাবা ব্যারিস্টার ইউসুফ। রায়ে অধ্যাপক গোলাম আযম নাগরিকত্ব ফিরে পান। ফলে জামায়াতের আমির পদে তার দায়িত্ব পালন বৈধতা পায়। তার প্রকাশ্যে রাজনীতি করার পথ উন্মুক্ত হয়।
এই মামলার রায় ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অর্জন। পুরো মামলা চলাকালীন আমার বাবা আর কোনো মামলা হাতে নেননি। তাকে গাড়িতে দু’জনের মাঝে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। যে রাস্তা দিয়ে তাকে নেয়া হতো, বাড়ি ফিরতেন ভিন্ন রাস্তা দিয়ে। আমাদের বাসা অনেক বছর জামায়াতে ইসলামী তাদের নিজস্ব লোক দিয়ে পাহারাও দিয়েছে। কারণ সে সময়ে আমার বাবাকে ফোনে ও লোক মারফত প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়।
১৯৮৪ সালে যখন আমার বাবা তার আইন পেশায় খ্যাতির উচ্চ পর্যায়ে তখন তিনি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের বিশেষ সহকারী পদে যোগ দেন। পরে তিনি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী এবং তথ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি সৎ মানুষ ছিলেন। তাই মন্ত্রিত্বের বেতন দিয়ে জীবনযাত্রার ব্যয় মেটানো কঠিন হচ্ছিল। এ কারণে তিনি মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে আইন পেশায় ফিরে আসেন।
মন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি প্রটোকল নিয়ে চলতেন না। অধ্যাপক গোলাম আযম ছাড়াও বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনীতিবিদ যেমন হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার সাথে তার সম্মানজনক সম্পর্ক ছিল। মন্ত্রী থাকাকালে অনেক কিংবদন্তি নেতা যেমন ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, ভারতের রাজিব গান্ধী, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, পাকিস্তানের জিয়াউল হক, শ্রীলঙ্কার জে আর জয়াবর্ধনে, ভুটানের রাজা জিগমে সিংগে ওয়াং চুকসহ অনেকের সাথে তার পরিচয় হয়েছিল।
বাবা ২০০২ সালের ১১ জানুয়ারি শুক্রবার মাগরিব বাদ মহান আল্লাহ্ পাকের ডাকে সাড়া দিয়ে চিরবিদায় নেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা