১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ৩০ পৌষ ১৪৩১, ১৩ রজব ১৪৪৬
`
সুশাসন

সংবিধান না মানলে কেন সংশোধন বা পুনর্লিখন!

-

বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়। একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর হতে এটি কার্যকর হয়। ইতোপূর্বে ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নে পূর্ব পাকিস্তান হতে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্যরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সত্ত্বেও সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করায় এবং আলোচনা অব্যাহত থাকাবস্থায় যুদ্ধ ঘোষণা করায় বাধ্য হয়ে গণপরিষদ গঠনপূর্বক জন-অভিপ্রায়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেন। অতঃপর শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের পরদিন ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অনুবলে রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণপূর্বক বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান প্রণয়ন করেন।
বাংলাদেশের সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে- জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এ সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং সংবিধান মেনে চলা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। বাংলাদেশে যারা সাংবিধানিক পদধারী তাদের মধ্যে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যগণ, স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার, প্রধান বিচারপতি ও বিচারকগণ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারগণ, মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্মকমিশনের সদস্যদের শপথগ্রহণ করাকালীন অপরাপর বিষয়ের সাথে স্পষ্টরূপে ব্যক্ত করতে হয় যে, তারা সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন।

বাংলাদেশ অভ্যুদয়-পরবর্তী এ যাবৎকাল পর্যন্ত সংবিধানে ১৭টি সংশোধনী আনা হয়েছে। এসব সংশোধনীর মধ্যে তিনটি সংশোধনী যথা- একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ ব্যতীত অপরাপরগুলো জন-অভিপ্রায়ের চেয়ে রাজনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য চরিতার্থে কার্যকর করা হয়েছে, এমনটিই প্রতিভাত।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলসহ বাংলাদেশ পাঁচবার অসাংবিধানিক শাসনে পতিত হয়। ১৯৭৫ ও ১৯৮২ সালে পরবর্তী প্রথম ও দ্বিতীয় অসাংবিধানিক শাসন কার্যকরকালীন সংবিধান আংশিক স্থগিত করে রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালিত হয়। উভয় শাসনকালে সামরিক শাসকদ্বয় রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকাকালীন রাজনৈতিক দল গঠনপূর্বক নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়ে নিজ নিজ দলের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনপূর্বক পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনকরত নিজ নিজ শাসনকালকে সাংবিধানিক বৈধতাদানে সমর্থ হন। তারা উভয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান-পূর্ববর্তী গণভোটের আয়োজন করে তাদের প্রতি জনমানুষের সমর্থন আছে কি না বিষয়টি নিশ্চিতের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
১৯৯০ সালের শেষার্ধে তিন জোটের রূপরেখায় সংবিধান বহাল থাকাবস্থায় কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে তৃতীয় অসাংবিধানিক শাসনের আগমন ঘটে। অস্থায়ী সরকারের প্রধান তার আগেকার সামরিক শাসকদ্বয়ের মতো গণভোটের আয়োজন করে তার শাসনকাল বিষয়ে জনসমর্থন আছে কি না তা নিশ্চিতের প্রয়াস নেন। অস্থায়ী সরকার কর্তৃক আয়োজিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী ও বিজিত দল উভয়ে তাদের ইতোপূর্বে ঘোষিত রূপরেখার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সংবিধানের একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারের শাসনকালকে বৈধতা দান করেন।
অষ্টম সংসদের মেয়াদ অবসান-পরবর্তী কর্মরত রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় এটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন-বিষয়ক সব বিকল্প নিঃশেষিত না করে গঠিত হওয়ায় এটির সাংবিধানিক সিদ্ধতা ছিল না। এ কারণে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দ্বারা সরকারটি স্থলাভিষিক্ত হয়। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে পতিত প্রধানমন্ত্রী বিদেশ যাওয়ার সময় বিমানবন্দরে গর্বোক্তি করে বলেছিলেন- সরকারটি তার দলের আন্দোলনের ফসল। তিনি সরকারটির কার্যকালকে বৈধতা দান করবেন। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আয়োজিত নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশের অধিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও দলটির প্রধান সংসদ-নেতা হিসেবে চতুর্থ এ অংসাবিধানিক সরকারটির কার্যকলাপকে সাংবিধানিক বৈধতা দেয়ার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ফলে অদ্যাবধি সেনাসমর্থিত সরকারটি সংসদ কর্তৃক বৈধতা প্রাপ্ত নয়।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারটি সাংবিধানিক বৈধতা প্রাপ্ত না হওয়ায় সরকারটি যেমন অবৈধ একইভাবে এ সরকার কর্তৃক পরিচালিত নবম সংসদ নির্বাচনও অবৈধ। নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে কালানুক্রমিক ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ যে তিনটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এ নির্বাচনগুলো পূর্ববর্তী যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন তার ভিত অবৈধ হওয়ায় এসব নির্বাচনের সাংবিধানিক সিদ্ধতা প্রশ্নবিদ্ধ। তা ছাড়া বিদ্যমান সংবিধান এবং নির্বাচনবিষয়ক আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর বিধানাবলির আলোকে বিবেচনা করা হলে দেখা যায়, নির্বাচনগুলো উভয়ের সুস্পষ্ট বিধানের লঙ্ঘন। একই সাথে অবজ্ঞা ও উপেক্ষায় অনুষ্ঠিত হয়েছে।

নবম সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সংসদে তার তথাকথিত নিরেট সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে জনমতকে পদদলিত করে একতরফাভাবে সব রাজনৈতিক দলের সমর্থনে জন-আকাক্সক্ষায় সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন সংসদ বহাল থাকাবস্থায় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান প্রবর্তন করে।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ৭(ক) সন্নিবেশন করে বলা হয়- যদি কেউ শক্তি প্রদর্শন বা শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে এ সংবিধান বা এর কোনো বিধান রদ, রহিত, বাতিল বা স্থগিত করে অথবা এ সংবিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করে তবে তা রাষ্ট্রদ্রোহসম অপরাধ হবে এবং এর সাজা হবে প্রচলিত আইনে সর্বোচ্চ দণ্ডসম। একই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৭(খ) সন্নিবেশন করে সংবিধানের প্রস্তাব, প্রথম-ভাগের সব অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয়-ভাগের সব অনুচ্ছেদ, নবম ক-ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলি সাপেক্ষে তৃতীয়-ভাগের সব অনুচ্ছেদ এবং একাদশ-ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলি সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধন অযোগ্য করা হয়। কার্যত এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের তিন-চতুর্থাংশ সংশোধন অযোগ্য করা হয়। সেই সাথে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী-পরবর্তী যেমন একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল অনুরূপ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রয়াস নেয়া হয়।
সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদ ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি-বিষয়ক। এ অনুচ্ছেদটির বিধানাবলির আলোকে ইতোপূর্বে সংবিধানের পঞ্চম, সপ্তম ও একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অসাংবিধানিক শাসনকালকে চতুর্থ তফসিলে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বৈধতাদান করা হয়েছিল। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ক্রান্তিকাল ও অস্থায়ী বিধানাবলির স্থায়িত্ব কালকে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে এ সংবিধান প্রবর্তনকালীন সময় অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর অবধি সীমিত করায় এ সময়কালবহির্ভূত কোনো সময়কালকে সাংবিধানিক বৈধতা দেয়ার পথ রুদ্ধ হয়। যেকোনো সংবিধানে এ ধরনের অনুচ্ছেদের সন্নিবেশন জন-অভিপ্রায়ের পরিপন্থী। তা ছাড়া এ ধরনের বিধান প্রণয়ন করে একটি সংসদ ভবিষ্যতের যেকোনো সংসদের আইন প্রণয়ন কার্যক্রম রুদ্ধ করতে পারে না।
পতিত সরকার নবম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে অসাংবিধানিকভাবে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করে অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন ছিল। পতিত সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধ পন্থায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে জনমতের প্রতিফলনে সরকার পরিবর্তনের পথ রুদ্ধ করা হয়। এ কারণে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই সরকারের অবসান ব্যতীত অপর কোনো বিকল্প ছিল না। যে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতিত সরকারের বিদায় ঘটেছিল তা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং তাতে দেশের সব শ্রেণিপেশার মানুষের নিরঙ্কুশ সমর্থন ছিল।

পতিত সরকার সংসদ একতরফাভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের বিষয়টিকে আদালতের রায়ের উপলক্ষ হিসেবে ব্যবহার করে, যদিও পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণার আগে সংসদ কর্তৃক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল-বিষয়ক আপিলের সংক্ষিপ্ত রায়ে উল্লেখ ছিল- আগামী দু’টি সংসদ নির্বাচন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি অথবা আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকবহির্ভূত ব্যক্তি সমন্বয়ে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দ্বারা পরিচালিত হওয়ার বিধান প্রবর্তনের দায়িত্ব সংসদের ওপর ন্যস্ত থাকবে। পরবর্তীতে সংক্ষিপ্ত রায় প্রদানকালীন প্রধান বিচারপতি অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন যা সংক্ষিপ্ত রায়ের সাথে সাংঘর্ষিক। অবসরে যাওয়ার পর এ ধরনের রায় প্রদান আইনের দৃষ্টিতে বেআইনি ও অকার্যকর। তা ছাড়া সংক্ষিপ্ত রায় ও পূর্ণাঙ্গ রায়ের আদেশে ভিন্নতা বিচারিক অসততা যা অমার্জনীয় অপরাধ।
বাহাত্তরে সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের সব ধরনের প্রলোভনের ঊর্ধ্বে রাখতে কর্মে বহাল থাকাকালীন এবং কর্ম হতে অবসর নেয়ার পর তাদের জন্য সংবিধানে বর্ণিত নির্ধারিত সাংবিধানিক দায়িত্ব ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের কর্মে অপর কোনো ধরনের দায়িত্ব পালন বারিত করা হয়। অতঃপর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অবসর-পরবর্তী প্রজাতন্ত্রের লাভজনক বিচারিক ও আধা-বিচারিক পদে নিয়োগে যোগ্য করা হয়। এ ছাড়া হাইকোর্ট বিভাগ থেকে অবসর-পরবর্তী আপিল বিভাগে ওকালতি করার যোগ্য করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করা হলেও পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অবসর-পরবর্তী চাকরি ও ওকালতির যে বিধান করা হয় তা অক্ষুণœ থাকে।
যে প্রধান বিচারপতির মুখ্য ভূমিকায় সুপ্রিম কোর্টের বিতর্কিত রায়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়। পতিত সরকার তাকে তার অবৈধ কাজের পুরস্কারস্বরূপ সংবিধান লঙ্ঘনপূর্বক নজিরবিহীনভাবে পরপর তিন মেয়াদে ৯ বছরের বেশি সময় আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে বহাল রাখে। আইন কমিশন একটি গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান। আইন কমিশনের কাজের সাথে বিচারিক বা আধা-বিচারিক কাজ সম্পর্কহীন। এ বাস্তবতায় আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি অথবা সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত কোনো বিচারককে নিয়োগ দেয়া হলে তাতে সুস্পষ্টরূপে সংবিধানের লঙ্ঘন ঘটে।
সংবিধানে সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ রয়েছে, প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারকরা কেবল ওই বিভাগে এবং হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকরা কেবল হাইকোর্ট বিভাগে আসন গ্রহণ করবেন। সংবিধানে উল্লিখিত দায়িত্ব ব্যতীত সংবিধান সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত বিচারকদের অপর কোনো ধরনের দায়িত্ব পালন অনুমোদন করে না। পতিত সরকারের শাসনকালে দেখা গেছে, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের কর্মরত বিচারক সমন্বয়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক বিচারকার্য পরিচালনা করে কথিত যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেয়া হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে এরূপ ট্রাইব্যুনাল গঠন অসাংবিধানিক হয়ে থাকলে এরূপ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত সাজা বেআইনি ও অকার্যকর।
পতিত সরকার নির্বাহী আদেশে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক সমন্বয়ে গঠিত একাদশ ও দ্বাদশ নির্বাচন কমিশনের সার্চ কমিটি এবং অনুরূপভাবে আইনের মাধ্যমে গঠিত ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশনের সার্চ কমিটির মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নামের সুপারিশ রাষ্ট্রপতির বরাবর প্রেরণের ব্যবস্থা করে নিয়োগকার্য সম্পন্ন করে। একই ধারাবাহিকতায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক সমন্বয়ে গঠিত বিতর্কিত দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের অধীন গঠিত সার্চ কমিটির মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের নামের সুপারিশ রাষ্ট্রপতির বরাবর প্রেরণ করে। সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত কোনো বিচারককে এরূপ দায়িত্ব দেয়া হলে তা তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং স্বপঠিত শপথের সাথে সাংঘর্ষিক বিধায় উচ্চাদালতের একজন বিচারকের এরূপ দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সরকার তার অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থের প্রয়াস নেয়।

পতিত সরকারের সময় উচ্চাদালতের বিচারক নিয়োগে রাজনৈতিক মতাদর্শের বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সংবিধানের বিধান অনুযায়ী আইনজীবী ও বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তা হতে সমানুপাতিকভাবে নিয়োগের পরিবর্তে প্রতিটি নিয়োগে বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়েছে। আইনজীবী ও অধস্তন বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়োগে মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও জ্যেষ্ঠতার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের দলীয় রাজনীতির প্রতি আনুগত্যের বিষয়টি অধিক বিবেচিত হয়েছে।
বিচারপ্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের পদটি প্রশাসনিক ও শিক্ষাবিষয়ক। পদটির কাজের সাথে বিচারিক বা আধা-বিচারিক কাজের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই। পতিত সরকারের শীর্ষ ব্যক্তি এ পদটিতে তার জেলার সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে দীর্ঘ দিন যাবৎ সংবিধান লঙ্ঘনপূর্বক নিয়োগ দিয়ে রেখেছিলেন। এ বিচারক ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যখন ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, জনতা ও চাকরিজীবী মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে দেশকে মুক্ত করার কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত তখন তিনি অধস্তন বিচার বিভাগের প্রারম্ভিক মুন্সেফ পদে যোগদান করে মুক্তিসংগ্রামের বিপক্ষে তার অবস্থান ব্যক্ত করেন।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে এমন এক ব্যক্তির ঠাঁই মিলেছে যিনি সাংবিধানিকভাবে উপদেষ্টা পদে আসীন হওয়ার অযোগ্য। এ ব্যক্তির ক্ষেত্রে সংবিধানের যে বিধান প্রযোজ্য তাতে সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ রয়েছে- নির্বাচন কমিশনার পদে দায়িত্ব পালন-পরবর্তী প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের কর্মে অপর কোনো লাভজনক পদে আসীন বারিত। সংবিধান লঙ্ঘন করে এমন ব্যক্তিকে উপদেষ্টা নিয়োগের দায় ব্যক্তিটির একার নয়; বরং সামগ্রিকভাবে উপদেষ্টা পরিষদের সবার।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের আয়োজন করে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সরকার পরিচালনার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হলেও তারা সে পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে নানামুখী সংস্কারের পথে এগিয়ে চলেছে। যদিও নির্বাচন-পরবর্তী যারা ক্ষমতাসীন হবেন তারা যদি এ ধরনের সংস্কার কার্যক্রম অনুমোদন না করেন সে ক্ষেত্রে এ সংস্কারের সামগ্রিক কার্যক্রম পণ্ডশ্রম বৈ কিছু নয়।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
ই-মেল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement