বাংলাদেশের প্রতি ভারতের বৈরিতা
- মো: হারুন-অর-রশিদ
- ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
একটি বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব মোকাবেলা করতে প্রস্তুত থাকতে হয়। প্রতিবিপ্লস্নবের খেলায় অংশগ্রহণ করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহল। তবে বিপ্লবে বিজয়ী শক্তির পক্ষে যদি জনভিত্তি মজবুত থাকে তাহলে প্রতিবিপ্লব রুখে দেয়া সহজ হয়। তবে পরাজিত শক্তি প্রতিবিপ্লবের পথ থেকে খুব সহজে সরে দাঁড়ায় না; বরং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে নিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে আক্রমণ করার সহজ পথ খঁুজতে থাকে। দেশে দেশে বারবার এমনটি ঘটেছে। কোথাও সফল, কোথাও বা ব্যর্থ হয়েছে। ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতিত ফ্যাসিস্ট হাসিনা ভারতে পালিয়ে গিয়ে একের পর এক ষড়যন্ত্র করে চলেছে। যদিও এর কোনোটি এখন পর্যন্ত সফল হয়নি। বিচারবিভাগীয় ক্যু থেকে শুরু করে বিনা সুদে এক লাখ টাকার ঋণ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে রাজধানীতে লোক সমাগম করার মতো পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর সামনে এনেছে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ইস্যু।
ইসকনের বহিষ্কৃত নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের ব্যানারে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বাংলাদেশের পতাকা অবমাননা করে রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ করেছে এমন অভিযোগে করা একটি মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। এখানে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের পতাকা অপমান করেছে এবং এটি রাষ্ট্রদ্রোহীমূলক কাজ, এ কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সে দিকটি সামনে না এনে ভারত সংখ্যালঘু নির্যাতন সামনে আনে। ভারত হাসিনার পতন মেনে নিতে না পেরে খেঁাড়া অজুহাত হিসেবে এমন চিন্ময়ের মতো এমন একটি ঘটনা দিয়ে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা করে।
বাংলাদেশের সব নাগরিকের একটি পরিচয় থাকা দরকার আর তা হলো, ‘বাংলাদেশী’। কিন্তু শেখ হাসিনা এ দেশের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি এবং বিপক্ষের শক্তি আবার সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু তকমা দিয়ে জাতিকে বহুধা বিভক্ত করেন। সংখ্যালঘু ট্রাম কার্ড অপব্যবহার করে ভারত অনেক মিথ্যা তথ্য সামনে এনে বাংলাদেশের ওপর রাগ ছাড়ছে। কিন্তু ভারত নিজের চেহারা কখনো আয়নায় দেখে না। দেশটিতে ধর্মীয়-সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো বিশেষ করে মুসলমানরা প্রায়ই উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সহিংস হামলার শিকার হচ্ছেন, যা অনেকটা রাষ্ট্র-অনুমোদিত কার্যক্রমের আকার নিয়েছে। শুধু তাই নয়; ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের যেকোনো সংখ্যালঘু এবং দলিত সম্প্রদায়ের ওপর যে নিপীড়ন চালানো হয় তার জন্য দিল্লির লজ্জিত হওয়া উচিত।
বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান এবং উপজাতিরা যতটা শান্তিতে আছে, তা পৃথিবীর অনেক দেশে সংখ্যালঘুদের জীবনে বিরল। যদিও শেখ হাসিনার শাসনামলে রাজনৈতিক কূটচালের অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগের লোকজন হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ করে, তাদের বাড়িঘর দখল করে, মূর্তি-মন্দির ভাঙচুর করে- এ দেশের ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর দায় চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে ভারতের কাছে হিন্দুদের রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করেছে। আসকের তথ্য অনুযায়ী, হাসিনার শাসনামলের ২০১৩ থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আট বছর ৯ মাসে হিন্দুদের ওপর তিন হাজার ৬৭৯টি হামলা হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৫৫৯টি বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে হিন্দুদের ৪৪২টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেয়া হয়েছে। প্রতিমা, পূজামণ্ডপ, মন্দিরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৬৭৮টি, যার প্রতিটি ঘটনার সাথে আওয়ামী লীগের লোকজন জড়িত ছিল বলে প্রমাণিত হয়েছে। হাসিনার আমলে আওয়ামী লীগের লোকদের দ্বারা হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর এত অত্যাচারের প্রতিবাদ ভারত সরকার কেন করেনি? প্রতিবাদ করেনি কারণ, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশকে ভারতের তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করেন। যার কারণে তিনি বলেছিলেন, ভারতকে যা দিয়েছি ভারত তা চিরদিন মনে রাখবে।
ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে পুনর্বাসন করতে ভারত বাংলাদেশকে বিপদে ফেলতে বহুবিধ ষড়যন্ত্র বিস্তৃতের অপচেষ্টা করছে। পতিত রাজনৈতিক শক্তিও নানা রকম ঝামেলা বাধিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলার অপচেষ্টা করছে, যাতে করে ড. ইউনূস সরকার বহির্বিশ্বে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এভাবে পতিত শক্তি রাজনৈতিকসহ নানা ইস্যুতে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে নিজেরা ক্ষমতা দখলের পথ তৈরি করতে চায়। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ এখন পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তি এবং ভারতীয় ষড়যন্ত্রের ঝুঁকিতে রয়েছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারত আমাদের সাহায্য করেছে, এ অজুহাতে বাংলাদেশকে কলোনি হিসেবে রাখতে চায়। যুদ্ধকালীন সাহায্য করেছে এটি সত্য; কিন্তু এ সাহায্যের উছিলায় ৫৪ বছরে বাংলাদেশের বহু সম্পদ দিল্লি লুটে নিয়ে গেছে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে এ দেশকে তাঁবেদার রাষ্ট্র করে রাখতে চেয়েছিল দিল্লি।
আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনের দফতর ভাঙচুর করে ভারত প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশের জনগণের সাথে কোন ধরনের বন্ধুত্ব রাখতে চায় দিল্লি। হাসিনাই তাদের একমাত্র পরীক্ষিত বন্ধু, যিনি বাংলাদেশকে ভারতের তাঁবেদার রাষ্ট্র করেছিলেন।
হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের একের পর এক আগ্রাসী মনোভাব প্রমাণ করে, ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান এবং হাসিনার পতন অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী সি রিট মিলের একটি উদ্ধৃতি এখানে প্রাসঙ্গিক হতে পারে।
তিনি বলেছেন, ‘প্রতিবিপ্লব প্রমাণ করে, বিপ্লব দরকারি হয়ে পড়েছিল এবং সমাজে যে আসলে বিপ্লব ঘটেছে, তা নিশ্চিত করে।’ ৫ আগস্ট না ঘটলে এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভারতের কাছে বন্দী হয়ে পড়ত। ভারতের এ মনোবাসনা পূরণ না হওয়ায় বাংলাদেশ এখন ৫ আগস্টের পরিবর্তন-পরবর্তী দেশের পতিত সরকারের দোসর এবং ভারতের আগ্রাসী ষড়যন্ত্রমূলক প্রতিবিপ্লবের ঝুঁকির পর্ব পার করছে। এর সাথে নতুন বিপদ যুক্ত হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থান বা বিপ্লব-পরবর্তী অস্থিরতা। এ পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করতে জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই।
পরিশেষে যে কথাটি বলতে চাই তা হলো, মোদির চরম হিন্দুত্ববাদী আচরণ এবং সব প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে প্রভুত্বমূলক আচরণের কারণে কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে ভারতের সম্পর্ক ভালো নেই। হাসিনার ওপর যে প্রভুত্ব অর্জন করেছিল তা হাসিনা পতনের মধ্য দিয়ে বিলীন হওয়ার শোকে ভারত সরকার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র করতে চাইছে তা কোনো কাজে আসবে না। কারণ, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেমের রক্ত বইছে। তারা রক্ত দিতে শিখেছে।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনীতিক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা