০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ২৫ পৌষ ১৪৩১, ৮ রজব ১৪৪৬
`

শিক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করণীয়

-

নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রতিটি সেক্টরে সংস্কারের ঢেউ লেগেছে। এর শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে শিক্ষা সংস্কার। শিক্ষাব্যবস্থা একটি জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের ভিত্তি। কিন্তু বাংলাদেশে এই ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে বহুমুখী সমস্যার ভারে জর্জরিত।
এখানে একই সাথে রয়েছে সাধারণ শিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা এবং ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা। যদিও সাধারণ ও মাদরাসা শিক্ষা জাতীয় শিক্ষাক্রমের আওতায় পরিচালিত, বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এখনো কওমি মাদরাসা বা ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে, যা জাতীয় শিক্ষানীতির বাইরে রয়ে গেছে। এর ফলে তৈরি হচ্ছে একটি অসম প্রতিযোগিতা। শুধু বিভক্তিই নয়, শিক্ষার পদ্ধতিগত সঙ্কটও বেশ প্রকট। শিক্ষকদের আধুনিক শিক্ষার সাথে খাপ খাওয়ানোর দক্ষতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এক ধরনের ঘাটতি রয়েছে। পাশাপাশি, শিক্ষাসামগ্রীর অপ্রতুলতা শিক্ষার গুণগত মানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এই অবস্থায় সমন্বিত শিক্ষা পরিকল্পনার জন্য শুরুতেই দরকার সব শিক্ষাকার্যক্রমের জাতীয় শিক্ষাক্রমের আওতায় নিয়ে আসা এবং ধারাবাহিকভাবে পারস্পরিক সহযোগিতা, সাদৃশ্য বৃদ্ধি করা। জাতীয় সমন্বিত শিক্ষাকার্যক্রম প্রচলনের জন্য সর্বপ্রথম দরকার জাতীয় ঐকমত্য।
শিক্ষাকার্যক্রম জাতীয়করণ করার সাথে সাথেই উঠে আসবে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধনের কথা। কেননা, কওমি প্রতিষ্ঠানসমূহ অধিকাংশই ব্যক্তি অনুদানে পরিচালিত হয়। সেক্ষেত্রে তাদের অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা অনেক। সমন্বিত শিক্ষাকার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসার জন্য অবশ্যই ওইসব প্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিকভাবে যথাযথ শিক্ষা-উপকরণ বণ্টন, আধুনিক সুযোগসুবিধা, ল্যাব, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সাধন অত্যাবশ্যক। শুধু কওমি প্রতিষ্ঠানই নয়, আলিয়া মাদরাসা এবং অনেক সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও বিজ্ঞানাগার, প্রযুক্তিগত সুযোগসুবিধার অপ্রতুলতা রয়েছে। শিক্ষায় সমন্বয় বা একমুখী করতে হলে সরকারের পক্ষ থেকে বিপুল বিনিয়োগ দরকার হবে।
পাঠকার্যক্রমে ব্যাপক বৈসাদৃশ্য রয়েছে। একে একমুখী করা মহা এক কর্মযজ্ঞ হবে। এজন্য বড়দাগে দরকার হবে শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং নিয়োগ প্রদান। যেমন, কওমি মাদরাসায় প্রযুক্তি শিক্ষা কার্যতই অনুপস্থিত। আবার, ইংলিশ মিডিয়ামে ধর্মীয় শিক্ষক অনুপস্থিত। সাধারণ শিক্ষায় ও বর্তমানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, ইংরেজি এবং আরবি ভাষা শিক্ষক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। অবশ্যই প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষকগণের আন্তঃপরিবর্তন বা স্থানান্তর এবং প্রয়োজনে নিয়োগ প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষক ঘাটতি দূর করা আবশ্যক।
জাতীয় সমন্বিত শিক্ষাকার্যক্রমের আওতায়, প্রতিষ্ঠানসমূহে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা-উপকরণের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে একটা আদর্শ শিক্ষা পরিবেশ গড়ে এখনো এক দূর কল্পনা। ইংরেজি শিক্ষার শিক্ষার্থীদেরকে দেশীয় সংস্কৃতিতে উৎসাহিত করাটা যেমন চ্যালেঞ্জ, তেমনি কওমি ঘরানার শিক্ষার্থীদের আধুনিক শিক্ষায় মানিয়ে নেয়াও চ্যালেঞ্জ। তবে ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব।
শিক্ষাপাঠ্যক্রমে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ দিকের প্রতি গভীর মনোযোগ দিতে হবে- একটি হলো জ্ঞান এবং অপরটি হলো দক্ষতা। জ্ঞান মূলত দু’টি ভাগে বিভক্ত : ঐশ্বরিক নাজিলকৃত জ্ঞান এবং অর্জিত জ্ঞান, যা বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং দার্শনিক চিন্তার ফলস্বরূপ। ঐশ্বরিক জ্ঞানও দু’টি দিক নিয়ে আসে: ব্যক্তিগত আবশ্যকতা এবং সামগ্রিকভাবে আবশ্যকতা। দক্ষতাও বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।
মৌলিক দক্ষতার মধ্যে রয়েছে ভাষাগত দক্ষতা, কর্মদক্ষতা এবং মৌলিক গণিত। উচ্চতর চিন্তা দক্ষতার মধ্যে আমরা অন্তর্ভুক্ত করতে পারি সমস্যা সমাধান, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সৃজনশীলতা এবং শিক্ষণ দক্ষতা। সংবেদনশীল দক্ষতাগুলোর মধ্যে রয়েছে নির্ভরশীলতা, দায়িত্বশীলতা, ইতিবাচক মনোভাব, সময়নিষ্ঠা, সচেতনতা, আন্তর্ব্যক্তিক দক্ষতা, সহযোগিতা মনোভাব, আত্মনির্ভরশীলতা, অভিযোজন ক্ষমতা, নিয়মতান্ত্রিকতা, আত্মপরিচালনা এবং সততা।
পাশ্চাত্য ও ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে একটি সমন্বয় সাধন করতে হবে, যেখানে শিক্ষক ও গবেষকদের একটি টিম গঠন করা হবে। সমন্বিত শিক্ষণপদ্ধতি এর অনুশীলন শুরু করতে হবে। এটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলোর মধ্যে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, যেখানে ধারাবাহিকভাবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আধুনিকায়ন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে, ল্যাব, ক্লাসরুম এবং কনফারেন্স রুম প্রতিষ্ঠা করা এবং সমন্বিত শিক্ষা পরিচালনার জন্য একটি নতুন শিক্ষা সমন্বয়ক অধিদফতর গঠন করা প্রয়োজন। এই অধিদফতরটি সকল স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে সহায়তা করবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষাবিদ, ক্যারিয়ার বিশেষজ্ঞ এবং ধর্মীয় নেতা থাকতে হবে, যাদের মাধ্যমে শিক্ষার মান এবং ব্যবস্থাপনা উন্নত করা যাবে।
শিক্ষাব্যবস্থার সব দিক শিক্ষানীতি, পাঠ্যক্রম, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা এবং শিক্ষণপদ্ধতির মধ্যে নৈতিকতা, কর্মদক্ষতা এবং দায়বদ্ধতার মূল্যবোধের বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য বিশেষ কর্মকৌশল অবলম্বন করা হবে, যা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত করবে।
এ ছাড়া, দেশের বাজার অর্থনীতি এবং চাকরির বাজার বিশ্লেষণ করে, তরুণদের জন্য উপযুক্ত ক্যারিয়ার গাইডলাইন তৈরি করা যেতে পারে। একইভাবে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এবং তাদের উন্নতি সম্পর্কে গবেষণা করে, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, যা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ তৈরি করবে।
পাঠ্যবই, রেফারেন্স বই এবং শিক্ষার উপকরণ পুনর্লিখন করা উচিত। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরি এবং রিসার্চ সেন্টার স্থাপন করা এবং প্রায়োগিক ও বিশ্লেষণমূলক গবেষণাকে উৎসাহিত করা দরকার। দেশে এবং বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে যৌথ উদ্যোগে সেমিনার ও কনফারেন্স আয়োজন করা যেতে পারে, যাতে নতুন গবেষণার পথ তৈরি হয়।
নৈতিক শিক্ষার প্রসারে, জাতীয় পাঠ্যক্রমে ধর্মীয় বিষয়গুলো বাধ্যতামূলক করা উচিত। তবে অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে নৈতিক নির্দেশনাও দেয়া যেতে পারে। যেমন: সমাজ পরিচিতি বইয়ে সমাজে নৈতিকতা, পৌরনীতি বইয়ে রাষ্ট্রে নৈতিকতা এবং তথ্যপ্রযুক্তি বইয়ে প্রাসঙ্গিক নৈতিক ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে। জাতীয় শিক্ষা মাধ্যম হিসেবে ইংরেজির পাশাপাশি আরবি ভাষার গুরুত্ব বাড়ানো প্রয়োজন, কারণ আমাদের দেশের অর্থনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যের রেমিট্যান্স বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
আলিয়া ও কওমি মাদরাসাগুলোকেও আধুনিকায়ন এবং সমন্বিত শিক্ষার দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বিশেষ করে, কারিগরি শিক্ষা সবার জন্য বাধ্যতামূলক করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কর্মস্পৃহা এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের জন্য দেশীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সাথে মিল রেখে আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় করা যেতে পারে, যাতে তারা বিশ্বব্যাপী উন্নতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক ও শিক্ষা-উদ্যোক্তা
ইমেল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
ভৈরবে চিহ্নিত ছিনতাইকারী গ্রেফতার যুদ্ধবিরতি ও বন্দীবিনিময় চুক্তির ‘খুব কাছাকাছি’ ইসরাইল-হামাস : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন ‘ঘটনাটি ইউক্রেনে হলে রাশিয়ার ওপর পরমাণু বোমা ফেলতো আমেরিকা’ সরকারকে সমর্থন দিয়েছি, কত দিন অব্যাহত থাকবে জানি না : ফারুক সাভারে দুর্ঘটনায় নিহত ৪ জনের পরিচয় মিলল চাদে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে হামলায় নিহত ১৯ দাবানল ছড়িয়ে পড়ায় বাইডেনের ইতালি সফর বাতিল গ্রিনল্যান্ড দখলের হুমকি নিয়ে ট্রাম্পকে সতর্ক করল জার্মানি-ফ্রান্স ২২৭৬ নেতাকর্মীকে ক্রসফায়ার, ১৫৩ জনকে গুমের অভিযোগ বিএনপির দিনাজপুরে শীতের তীব্রতা বেড়েই চলছে মাঠে আদালত স্থাপনের প্রতিবাদে স্থানীয় ও ঢাকা আলিয়ার শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ

সকল