০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ২৪ পৌষ ১৪৩১, ৭ রজব ১৪৪৬
`

পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলায় উন্নয়ন

-


পূর্ব বাংলা যদি পাকিস্তানের অংশ না হতো তাহলে কী দাঁড়াত। আমরা জম্মু কাশ্মির, হায়দরাবাদ, পূর্ব পাঞ্জাব, পশ্চিম বঙ্গ, মিজোরাম, সিকিমের মতো একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত হতাম। ভারতের সেভেন সিস্টারস খ্যাত রাজ্যগুলোর বাসিন্দাদের যেমন দরিদ্রপীড়িত জীবনযাপন করতে হচ্ছে, ঠিক তেমনি আমাদেরও হতদরিদ্র থাকতে হতো।

পূর্ব পাকিস্তানে ২৩ বছরে যে উন্নতি হয়েছে; বাংলাদেশের ৫৩ বছরে কতটুকু উন্নয়ন হয়েছে? সোনার বাংলা শ্মশান কেন। আট আনার চাল ছয় আনার কাগজের দিস্তা- এই সে­াগান যারা দিয়েছিলেন তারা তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি; বরং তাদের শাসনামলে জিনিসপত্রের দাম আট থেকে ১০ গুণ বেড়ে যায়। চুহাত্তরে দেশব্যাপী ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তাতে কয়েক লাখ মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় মারা যান। আগে পাকিস্তান শোষণ করেছে, এখন আমরা নিজেরা নিজেদের শোষণ করছি। শোষণের টাকা দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে পাচার করছি। বিলাসী জীবনযাপনে বেছে নিয়েছি কানাডার বেগমপাড়া, নিউ ইয়র্কের সাহেব বাজার, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম আর দুবাইতে আয়েসি জীবন। উল্লিখিত জায়গাগুলোতে বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করছি।
বছরের পর বছর এসব কাজ করায় রিজার্ভের অর্থ ১৪ বিলিয়ন ডলারে (২০২৪ জুন) এসে দাঁড়ায়। শেয়ারবাজার থেকে সাধারণ মানুষের টাকা লোপাট করে নেয় ২০১০ সালে মাফিয়া সরকারের দোসররা।

যাই হোক, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে ২৩ বছরে উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি দেয়া দরকার। আমাদের বৃহৎ দুই শহর ঢাকা এবং চট্টগ্রামের দিকে তাকালে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবন ও শেরে বাংলা নগরে বিশাল প্রশস্থ সড়ক নির্মিত হয়েছে। কমলাপুর রেলস্টেশন নির্মিত হয়েছে এই সময়ে। নবাবপুর রোড ও তৎসংলগ্ন নান্দনিক ব্যবসায়িক কেন্দ্র গড়ে উঠেছে একই সময়ে। ঢাকায় ১২টি সেক্টর করপোরেশন পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশাল আয়তনে জেনারেল পোস্ট অফিস, ডিআইটি, রাজউক, ঢাকা স্টেডিয়াম, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট এবং বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৫ সালে। ১৯৬৭ সালে জাতীয় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। বুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয় ১৯৬২ সালে, জাহানঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদ তীতুমির কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ- এ ছাড়া ঢাকা সিটি কলেজ, সচিবালয়ের নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৬৯ সালে। বঙ্গভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৬৪ সালে। এসব পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একই সাথে ঢাকা শহরের বড় পরিসরের সব বাজার গড়ে তোলা হয় পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে।

ঢাকায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (তেজগাঁও) পাকিস্তান আমলে নির্মিত হয়। গুলশান, বনানী, গুলিস্তান ও মতিঝিল ঢাকার ডাউন টাউন হিসেবে পরিচিত ছিল তখন। তাই আমাদের তুলনা-প্রতিতুলনা করা দরকার ঢাকার উন্নয়ন পাকিস্তান আমলে কী হয়েছে। আর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কতটুকু এগিয়েছি আমরা।
বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান আদমজী জুট মিল নারায়ণগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান আমলে। প্রতিষ্ঠাতা অবাঙালি আবদুল ওয়াদিত আদমজী। জুট মিলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫০ সালে। বিলুপ্তিকাল ২০০২। জুট মিলটিতে ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছিল। তখন চটের ব্যবসায় ছিল জমজমাট। অথচ বাংলাদেশ আমলে আমরা পাটকে আর রক্ষা করা তো দূরের কথা, বরং আদমজী থেকে শুরু করে বাওয়ানিসহ প্রায় ১০০টি জুট মিল ক্রমান্বয়ে বন্ধ হয়ে গেল।
একাত্তরে স্বাধীনতার আগপর্যন্ত পূর্ববাংলায় জুট মিলের সংখ্যা ছিল ৭৫টি। মূলত মুজিব আমল থেকে পাটকল এবং পাটের গুদামে শ্রমিকদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আগুন দিয়ে পাটশিল্পের অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়া হয়। এর পেছনে সক্রিয় ছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ষড়যন্ত্র। স্মরণ করা যেতে পারে, যাদের ষড়যন্ত্রে আমাদের পাটশিল্প ধ্বংস হয়েছে; সেই ভারত আজ বিশ্বে পাটশিল্পে এক নম্বর। একাত্তরের আগে পূর্ব পাকিস্তান পাটশিল্প ছিল এক নম্বরে। দুর্ভাগ্য হলো, স্বাধীনের পর জাতির কোনো অর্থকরী ফসল রক্ষা করতে আমরা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছি।

বাবার কাছে শুনেছি, ১৯৪৭ সাল পাকিস্তান সৃষ্টির আগে পূর্ব বাংলার মানুষ ধুতি-গামছা পরতেন, সচ্ছল মানুষ পায়জামা-পাঞ্জাবি পরতেন। কিন্তু সংখ্যায় ছিল খুব কম। ছেলেরা হাফপ্যান্ট পরত। সেই সময় মুসলমানরা গরিব ছিলেন। অমুসলিমরা বিশেষ করে হিন্দুরা আর্থিকভাবে ছিলেন সচ্ছল। পাকিস্তান সৃষ্টির (১৯৪৭) পর পূর্ব বাংলার মানুষ প্যান্ট, ফুল শার্ট এবং লুঙ্গি পরার সুযোগ পান। পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলমানদের মধ্যে নবজাগরণ ঘটে।
পাকিস্তান আমলেই পূর্ব বাংলায় ট্রেন এবং নৌপথের যথেষ্ট উন্নতি হয়। সে সময় দূরপাল্লার ট্রেন এবং লোকাল ট্রেন- দুটো আরামদায়ক ছিল। মূল কথা, পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। ঠিক একইভাবে নৌপথে ঢাকা, চাঁদপুর, গোয়ালন্দ, বরিশাল ও খুলনা একাধিক স্টিমার এবং লঞ্চে যাওয়া-আসা উপভোগ্য ছিল। পাশাপাশি স্থলপথও বেগবান ছিল।
মূল কথায় ফিরে আসি। ঢাকার আরো কিছু উন্নয়ন যেমন- ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, পিজি হাসপাতাল, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল (আগস্ট ১৯৬১) প্রভৃতি। চা, পাট, লবণ, চিনি, রাবার ও কাগজশিল্প, নানা জাতের কুটির ও মৃৎশিল্পে পাকিস্তান আমলে ধস নামতে দেখা যায়নি।
একাত্তরের পর উন্নয়নের মধ্যে দেখেছি, ভূমি কেনাবেচা। বিদেশী পণ্য এনে বাজারজাতকরণের কোম্পানি, ইনডেন্টিং ফার্ম এবং শপিংমল নির্মিত হয়েছে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে। আর কিছু এনজিও। নিজস্ব মেধা ও প্রযুক্তি প্রয়োগ করে স্বাধীন বাংলাদেশে ভারী শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে পারিনি আমরা । অর্থাৎ সস্তা উপায়ে অধিক মুনাফা অর্জনের পথটি বেছে নিয়েছি। অথচ আমাদের এ কথা মনেই ছিল না যে, আমদানি-নির্ভর দেশ কখনো স্বনির্ভর হতে পারে না। এ কারণে দীর্ঘ ৫৩ বছরে যে জায়গায় দেশটির থাকার কথা ছিল, সেটি সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতাপূর্ব যেগুলো ছিল সেবা, এখন তা হয়েছে বাণিজ্য। যেমন- শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্যপণ্য ও আবাসন।

এবার চট্টগ্রামের দিকে একটু নজর দিই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ, ইতিহাস ও সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি উইমেন কলেজ, সরকারি ল’ কলেজ, চিটাগাং স্টিল মিলস, স্টিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের বড় লৌহ ও ইস্পাত শিল্প চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ ও ফৌজদারহাটে গড়ে উঠে। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ ও আধুনিক মানের গাড়ি কারখানা, পতেঙ্গা তেল শোধনাগার, পতেঙ্গা পোর্ট, চট্টগ্রাম স্টেডিয়াম, পুলিশ হেড কোয়ার্টার, জর্জ কোর্ট, চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ পাইকারি বাজার যেমন- আসাদগঞ্জ, খাতুনগঞ্জ, রিয়াজুদ্দিন বাজার, পাথরঘাটা, আন্দরকিল্লা, সিরাজদৌলা রোড ইত্যাদি বাজার পাকিস্তান আমলে গড়ে উঠে।
পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থানটি পরিষ্কার করা দরকার। কারণ বর্তমানে দেশের মানুষ বলেন, পাকিস্তান আমাদের শুধু শোষণ করেছে। শাসন ক্ষমতা দেয়নি, পূর্ব বাংলায় কোনো উন্নয়ন করেনি। সে বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা দরকার। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহর মৃত্যুর পর বাঙালি নেতা স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হিসেবে সফল হন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হন। প্রসঙ্গত, খাজা নাজিমুদ্দিন দুইবার বাংলার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮-৫৮ এই ১০ বছরে পূর্ব বাংলা থেকে চারজন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোরসহ আরো কয়েকটি জেলা শহরে সামরিক ক্যান্টমেন্ট নির্মাণ করা হয়। বিমান এবং নৌবাহিনীর আঞ্চলিক সদর দফতরও ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। রাজশাহী বিভাগে সারদা অঞ্চলে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়।
উপরে বর্ণিত দু’টি শহরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরেছি যাতে বাংলাদেশের নতুন জেনারেশন উপলব্ধি করতে পারে, পাকিস্তানের ২৩ বছরে পূর্ব বাংলায় কী ধরনের উন্নয়ন হয়েছে।
লেখক : গ্রন্থকার

 

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement
ঢাকা-১০ আসনের সাবেক এমপি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন আটক বিশ্বের ৩ সেরা খেলোয়াড়ের একজন হবেন সাইম আইয়ুব : ফখর সংস্কারের মাধ্যমে মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে : ভিপি নুর টিম কম্বিনেশনের জন্য দলের বাইরে ছিলাম : রিশাদ দিনাজপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ আশিকের লাশ উত্তোলন জুনে ব্রাজিলে প্রথমবারের মতো মেড ইন বাংলাদেশ প্রদর্শনী সিংড়ায় যুবলীগ নেতার বিচার দাবিতে মানববন্ধন গাড়ি চালিয়ে মাকে নিয়ে লন্ডন ক্লিনিকে তারেক রহমান সিরিয়ার উপর থেকে কিছু নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে পারে ইইউ এইচএমপিভি ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই : আইইডিসিআর ঢাকা জেলা দক্ষিণ ছাত্রদলের সভাপতি পাভেল, সম্পাদক নিরব

সকল