০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ২৪ পৌষ ১৪৩১, ৭ রজব ১৪৪৬
`

বাঙালির জীবনধারায় সুফিপ্রভাব

উৎসের উচ্চারণ
-


সুফি সাধকরা বাঙালি মুসলমানের জীবনে আবশ্যক ও অন্তর্নিহিত চালকের জায়গায় নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যে বিপুল সৃষ্টিশীলতা ও নির্ণায়ক ভূমিকার মাধ্যমে তারা এটি করেন, তার প্রতি দৃষ্টিপাতের বহু দিক রয়েছে। সভ্যতা-সংস্কৃতির গঠনে মৌলিক উপাদানগুলোতে তাদের ভূমিকা আমরা যদি পরখ করি, তা হলে দেখব, সত্তাগত রুহানিয়াত ও তার প্রকাশপ্রকরণে সৃষ্টিশীলতা নিয়ে তারা কিভাবে আমাদেরকে সম্পন্নতার দিকে এগিয়ে এনেছেন। কয়েকটি দিকের প্রতি তাকানো যাক।
ক. ইসলাম এখানকার পুরো জনপদের মানুষের খাদ্য, পোশাক, ভাষা, জীবনযাত্রা ইত্যাদিকে ব্যাহত বা বিচলিত করল না। সেকালে বাংলায় বেশির ভাগ পোশাক ছিল লজ্জা নিবারণ ও শীত-গ্রীষ্মসহ বিভিন্ন আবহাওয়ার প্রতিকূলতা থেকে সুরক্ষার ন্যূনতম আয়োজন মাত্র। নারী-পুরুষের পোশাকে খুব একটা পার্থক্য ছিল না। নারী ও পুরুষ উভয়ই পরতেন একটিমাত্র বস্ত্র; শাড়ি অথবা ধুতি। সেলাইবিহীন থাকত পোশাকগুলো। ইসলাম পোশাকের গুরুত্ব তুলে ধরল। পোশাকে সেলাই যুক্ত করল। যদিও একে উচ্চবর্ণের চোখে অপবিত্র মনে করা হতো। ধুতির বদলে এলো লুঙ্গি-পাজামা, জামা-জুব্বা। দর্জি পেশার সূচনা হলো।
অভিজাত পুরুষরা হাঁটুর নিচ অবধি ধুতি পরলেও সাধারণ পুরুষরা অত্যন্ত খাটো ধুতি পরতেন। নারী ও পুরুষেরা ঊর্ধ্বাঙ্গে অলঙ্কার ছাড়া আর কিছু পরতেন না। ওড়না ব্যবহারের নজির ছিল খুব কম। ইসলাম পোশাকের মাত্রা ও পরিসর প্রসারিত করল। আরব, তুর্কি বা আফগানি পোশাক শুরুতে দরবারে ছিল। সুফিরা সতর ঢাকার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন। সম্ভ্রমের ওপর ছিল তাদের গুরুত্ব। খুব ধীরগতিতে পোশাকের নতুন রুচি সমাজে স্থিতি লাভ করে। এক প্রস্থ কাপড় থেকে পুরুষরা তিনটি বস্ত্র ধারণ করতে থাকেন। ঊর্ধ্বাঙ্গে, নিম্নাঙ্গে ও মাথায়। নারীরা সাধারণত শাড়ি পরতেন। মুসলমানি পোশাক দরবার ছাড়িয়ে সাধারণ মানুষ এমনকি অন্য ধর্মের মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।

মুকুন্দরাম তার ‘কবিকঙ্কণ চণ্ডী’তে পাগড়ির উল্লেখ করেছেন। শেখ জৈনুদ্দিনের ছবিতে স্পষ্ট, অভিজাতরা তো বটেই, চাকর-বাকররাও মাথায় পাগড়ি পরে আছে। সুলতানি আমলে পরিবর্তনগুলো সমাজ-সংস্কৃতির মর্মমূলে প্রবেশ করে। মোগল আমলে শাসকদের রুচি ও স্টাইল হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মাবলম্বীর পোশাকের ধরন গঠন করে। সমাচার দর্পণ পত্রিকায় ১৮৩৫ সালেও দেখা যায়, বাবু, জমিদার, সেরেস্তাদার ও উকিল ইত্যাদি মহাশয়রা জামা, নিমা, কাবা, কোর্তা ইত্যাদি পোশাক পরতেন। রামমোহন রায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুরদের ছবি তাদেরকে এমনতরো পোশাকে হাজির করে। অভিজাতদের পোশাক ছিল এগুলো। রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দসহ সেকালের অভিজাতগণ তখনো মাথায় পাগড়ি পরতেন।
খ. কৃষি ও নদীপ্রধান বাংলার প্রধান খাদ্য ভাত, মাছ। প্রাকৃত পৈঙ্গলে উত্তম খাবার পরিবেশনকারী নারীর প্রশংসা পাই। খাবারগুলো হচ্ছে- কলাপাতায় গরম ভাত, ঘি, মৌরলা মাছ এবং নলিতা অর্থাৎ পাটশাক।

‘চর্যাপদে’র একটি বৌদ্ধ গানে দেখা যায়, বাড়িতে অতিথি এসেছে। অন্যদিকে হাঁড়িতে নেই ভাত। তাই কবি বিপদে পড়ে দুঃখ করছেন। কৃষ্ণদাশ কবিরাজের ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ জানায়, কলাপাতায় গরম গরম ঘি আর ভাতের কথা। কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ ভাতের সাথে আরো কিছু খাবারের খবর দেয়। যেমন-
‘নটে রাঙা তোলে শাক পালঙ্গ নলিতা
তিক্ত ফল তাঁর শাক কলতা পলতা
সাঁজতা বনতা বন পুঁই ভদ্র পলা
নটুয়া বেথুয়া তোলে ফিরে ক্ষেতে ক্ষেতে
মহুরি শুলকা ধন্যা ক্ষীর পাই বেটে।’

বিভিন্ন দেশীয় শাকপাতাও ভাতের সাথে খাওয়া হতো। কখনো ভর্তা, কখনো ঝোল-তরকারি। সবজির মধ্যে কচু, বেগুন, লাউ, কুমড়ো, পটোল, উচ্ছে, ঝিঙে, শিম, কাঁঠালবীচি, নিম, কাঁচকলা ইত্যাদি নিরামিষ পদ বাঙালির খাবারের তালিকায় ছিল।
এই খাদ্যরুচিতে মুসলিমরা কোনো বদল আনলেন না। তারা এখানে আনেন নতুন মাত্রা, বৈচিত্র্য ও ঋদ্ধি। ডাল মুসলিম আমলের আগে বাঙালির খাদ্য তালিকায় ছিল না। মুসলিমরা ডাল নিয়ে আসেন। চিনাবাদাম, মটরশুঁটি, মুগ, কলাই, মাষকলাই নিয়ে আসেন মুসলিমরা। গো-মাংসের ব্যবহার করেন বিচিত্র ধরনের খাদ্যে। বহু ধরনের শরবত, মিষ্টি ও মশলাজাত খাবারের যোগ ঘটান। চিনি, পোলাও, বিরিয়ানি, কাবাব, জিলাপি, নিমকি, পরোটা, বাকরখানি, আলুর চপ, মোরগ মোসাল্লাম, ডাল মাখানি, আলু গোশত, তন্দুরি, টিক্কা, কোফতা, কোরমা, রোস্ট, রেজালা, নিহারি, তন্দুর, নান ও রুমালি রুটি, ম্যারিনেশন, সুগন্ধি শরবত, ফিরনি, কফি ইত্যাদি বাঙালির খাদ্যসূচিতে যুক্ত হয় মুসলিমদের হাত ধরে। বেদ, উপনিষদ কোথাও পেঁয়াজের উল্লেখ নেই। কারণ পেঁয়াজ ছিল ‘যবন ও ম্লেচ্ছদের খাবার’। পেঁয়াজযুক্ত খাবার জনপ্রিয় করেন মুসলমানরা। সমুচা ও তার বাঙালি সংস্করণ শিঙ্গাড়া প্রাথমিক মুসলিম আমল থেকে আমাদের খাদ্য তালিকায় জায়গা পায়।

গ. এখানকার জীবনযাত্রায় মুসলিম সংস্কৃতি কোনো চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হয়নি; বরং সহায়তা ও কল্যাণের বাতাবরণ তৈরি করে নিজের অলঙ্ঘনীয় অবস্থান নিশ্চিত করেছে। বাংলা বরাবরই ছিল গ্রামপ্রধান। প্রাচীন বাংলার গ্রামমাত্রই ছিল কৃষিনির্ভর। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু শিল্প ছিল এর সাথে। প্রচুর ভূমি ছিল কিন্তু চাষের জরুরত খুব ছিল না। কৃষিভূমিকে আশ্রয় করে গড়ে উঠত বসতি। কৃষি আর পানি রক্ত ও হৃৎপিণ্ডের মতো। ফলে যেখানে নদী-নালা, খাল-বিল, সেখানে কৃষিক্ষেত, পানি যেখানে সহজলভ্য, সেখানে গ্রাম। শহর তৈরি হতো নদীর প্রশ্রয়ে। যোগাযোগের সুবিধা তৈরি করত নদী।
বসতি ও যাতায়াতের পথের ওপর ভর করে গড়ে উঠত হাটবাজার। এগুলোও নদীর তীরে অথবা যাতায়াতের রাজসড়কের পাশে বিকশিত হতো। সৈন্য পরিচালনা এবং সামরিক কার্যক্রম, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও শিল্পের প্রয়োজনে শহরের বিকাশ ঘটত। এতে স্থলপথ, নৌপথ উভয়েরই ভূমিকা থাকত। প্রাথমিক মুসলিম সুফিরা স্থলপথ ব্যবহার করলেও প্রধানত নৌপথ কাজে লাগাতেন।

শাহ সুলতান মাহিসওয়ার রহ. নদীবাহিত দাওয়াতি ধারার উজ্জ্বল উদাহরণ। বগুড়া জেলার মহাস্থানে রয়েছে তার মাজার। বলখের এই রাজপুত্র দরবেশী গ্রহণ করে দামেস্কের দরবেশ শেখ তৌফিকের আদেশে বাংলায় আসেন। সমুদ্রপথে যাত্রা করে গঙ্গা নদীর মোহনায় অবস্থিত সন্দ্বীপে পেঁৗছেন। সেখান থেকে তিনি হরিরামনগরে আসেন। জায়গাটি সম্ভবত সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত ছিল এবং কালি উপাসক বলরাম স্থানটি শাসন করছিলেন। রাজা শাহ সুলতানকে ইসলাম প্রচারে বাধা দেন। সংঘর্ষে রাজা মারা যান এবং তার মন্ত্রী ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর শাহ সুলতান মহাস্থানের দিকে অগ্রসর হন। স্থানীয় রাজা পরশুরাম ও তার বোন শিলাদেবী শাহ সুলতানকে বাধা দেন। ফলে দু’পক্ষে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে রাজা নিহত হন এবং শিলাদেবী করতোয়া নদীতে প্রাণ বিসর্জন দেন। তিনি মাহিসওয়ার (মাছের পিঠে আরোহী) নামে সমধিক পরিচিত। সম্ভবত তিনি মাছ আকৃতির নৌকায় এসেছিলেন বলে সাধারণের কাছে মাহিসওয়ার হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
কিন্তু বাংলায় মাহিসওয়ার দরবেশ তিনি একা নন। মাছের পিঠে সওয়ার দরবেশদের সংখ্যা যেমন প্রচুর, তেমনি তাদের জনপ্রিয়তাও বেশি। সমুদ্র ও নদীর অভিভাবক হিসেবে জনমনে স্থান করে নেন বহু সুফি। ইসলামে এমন কোনো ধারণার স্বীকৃতি না থাকলেও হিন্দু, বৌদ্ধসহ নানা ধর্মের মানুষ বহু সুফিকে পানির প্রভু বলে জ্ঞান করতেন। চট্টগ্রামের বদর পীর তার নমুনা। বৌদ্ধ, হিন্দু ও চৈনিকরা বদর আউলিয়াকে পরমেশ্বর অথবা আত্মার অধস্তন হিসেবে ভক্তি করে। সমুদ্র উপকূলীয় জীবনে তিনি রক্ষাকর্তার জায়গা পান। দক্ষিণ উপকূল ধরে সুদূর মালয় উপদ্বীপও ছাড়িয়ে যায় তার ইমেজ। চট্টগ্রামে তিনি বদর শাহ, মিয়ানমারের টেনাসেরিমে তিনি মাদরা, আকিয়াবে তিনি বুদ্ধ পীর। মুখ্যত মুসলমানরা এই ইমেজ তৈরি করেননি; বরং প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী একে নিজের মন দিয়ে রাঙিয়েছেন। আরাকানের মধ্যযুগীয় বৌদ্ধ রাজারা বদর পীরের সমাধির জন্য কয়েকটি গ্রাম ওয়াক্ফ করে দেন এবং তারা তীর্থযাত্রী হিসেবে মাজারে আসতেন ও মাজারে দান করতেন।

পাঁচ পীরের বন্দনাও মূলত নদীবাহিত। পূর্ববাংলার মাঝিরা একে প্রতিষ্ঠা দেন। শ্রেণীবহিভূর্ত হিন্দু সমাজে গৃহদেবতা হিসেবে পাঁচ পীরের বন্দনা বেদি তৈরি হতো। সেটি হতো গৃহস্থের বাড়ির কোনো ঘরের উত্তর-পশ্চিম কোণে কাদামাটি দিয়ে উঁচু করে। ধীরে ধীরে মুসলিম সমাজের একটি অংশে এই চল তৈরি হয়। পাঁচ পীরের দরগাহ নামে সোনারগাঁয়ে একটি দরগাহ আছে।
প্রাথমিক ইসলাম সমুদ্র ও নদীপথে এখানে আসে। প্রধানত আরব ব্যবসায়ীরা একে বহন করে আনেন। অচিরেই সড়কপথও যুক্ত হয়। স্থলপথে সুফিদের আগমন ও ভূমিকা উদযাপনের নজিরও বিস্তর। জীবনকালে তাদের খানকাহ ও আস্তানা ঘিরে জনপদ, হাটবাজার তৈরি হয়। বহু শহরের প্রাথমিক গঠন হয়েছে তাদের প্রভাবে ও হাত ধরে। তাদের ঘিরে তৈরি হয় তীর্থস্থান, শিক্ষাকেন্দ্র, সাংস্কৃতিককেন্দ্র। দরবেশদের কাছে কৃষি ও ব্যবসায় বিশেষ গুরুত্ব পেত। কারণ গ্রামসভ্যতা হচ্ছে কৃষিনির্ভর আর নগর সভ্যতা হচ্ছে ব্যবসায়-বাণিজ্যনির্ভর। তারা সভ্যতার উভয় বিকাশধারায় সহায়তা করেন।
কৃষিনির্ভর ভূম্যধিকারী, কৃষক, শ্রমিক, ভূমিহীন কৃষি শ্রমিকরাই ছিলেন তাদের প্রধান ভক্তকুল।

ঙ. বাংলায় ইসলামের উদয়কালে ছোট ছোট গ্রামকে বলা হতো বাটক বা পাটক বা পাড়া। গ্রামের মধ্যেও কম গুরুত্বপূর্ণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে পার্থক্য ছিল। সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতো এমন গ্রাম, যেখানে উচ্চবর্ণের বা শাসক শ্রেণীর বসবাস। সমস্ত সুবিধা এই সব এলাকায় কেন্দ্রীভূত থাকত। সুফিরা গ্রামজীবনে নতুন ধারণা বিস্তার করেন। যেখানে শিক্ষা-সংস্কৃতি, জীবনোপকরণ এবং ধর্ম-কর্ম বেশি বিকশিত, সেই গ্রাম অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। তারা গ্রামজীবনে সুযোগ-সুবিধা স¤প্রসারণ করেন। বহু সুফি ব্রাত্য জনপদগুলোতে ঘাঁটি গাড়েন। ফলে সুবিধাবঞ্চিত গ্রাম ও সুবিধাপ্রাপ্ত গ্রামের ব্যবধান কমতে থাকে। নতুন কেন্দ্র গড়ে ওঠে।
সুফিদের যোগসূত্র ছিল ব্যবসায়-বাণিজ্যের মানুষদের সাথে, শিল্পোৎপাদনের সম্ভাবনার সাথে এবং শাসক শ্রেণীর মানুষদের সাথে। আগে গ্রামকে তাদের কাছে যেতে হতো। এখন বহু সুফির গ্রামকেন্দ্রিকতার ফলে শাসনকাজে নিয়োজিতদের গ্রামে আসতে হচ্ছে। কারণ সুফিদের অবস্থান তার খানকা ও মাদরাসাকে শিক্ষা, সংস্কৃতি বা ধর্মকর্মের কেন্দ্রভূমি হিসেবে পরিচিতি দিত।
বাংলার গ্রামীণ সমাজ বহুলাংশে অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদিবাসীদের উত্তরাধিকার নিয়ে সুফিদের সাথে যুক্ত হয়। নাগরিক সভ্যতা দ্রাবিড় ভাষাভাষী মানুষের উত্তরাধিকার বহন করে। ইসলাম আসার আগে বাংলায় ধর্মকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে বহু নগর। ইসলামের প্রভাবেও ঘটে একই ব্যাপার। পুরনো শহরগুলো বিস্তৃত ও বিচিত্র বিকাশ লাভ করে। দেওকোট, বিক্রমপুর, লাখনৌতি, পাণ্ডুয়া, সোনারগাঁ, চট্টগ্রাম ইত্যাদি নগরী আন্তর্জাতিক আবেদনে আত্মপ্রকাশ করে।
বাংলায় তখন উচ্চপেশা ও নিম্নপেশার বিচারে মানুষের মূল্য ও অধিকার নিরূপিত হতো। আবার পেশা নিরূপিত হতো বর্ণের বিচারে। ইসলাম এই বাস্তবতাকে চ্যালেঞ্জ করে।

সেকালে নাগরিক ছিলেন মূলত শ্রেষ্ঠী, শিল্পী, বণিক, নগরবাসী রাজা ও মহারাজা সম্প্রদায়ের রাষ্ট্রপ্রধান এবং বিত্তবান ব্রাহ্মণরা। এরাই ছিলেন শহরের আসল হর্তাকর্তা। শহর ছিল তৎকালে সম্পদ বণ্টনের প্রধান কেন্দ্র। গ্রাম ছিল কৃষি ও গৃহশিল্প সম্পদ উৎপাদনের উৎস, শহর মূলত ঐশ্বর্য ও ভোগ-বিলাসের কেন্দ্র। শহর ও গ্রামে ব্যবধান ছিল উত্তম বনাম ইতরের। কিন্তু শহরের ভেতরেও ছিল সেই উত্তম-ইতর। খুব অল্পসংখ্যক সুবিধাভোগী উত্তমের বর্গে, বাকিদের জীবন ছিল মানবেতর। রামচরিত, পবনদূত কিংবা সদুক্তিকর্নামৃতের নানা পঙক্তি এই বাস্তবতার ঘোষণা দেয়। সমসাময়িক লিপিগুলোতেও বিস্তর প্রমাণ আছে।
ইসলাম বাংলার গ্রামজীবনের কোনো উপাদানের সাথে অসহযোগিতা করেনি; বরং এর বহুমাত্রিক বিকাশ ও সহজীকরণের পথ প্রস্তাব করেছে। গ্রামীণ নানা শিল্পের কেন্দ্র গঠনে সুফি আস্তানাগুলো ভূমিকা রাখে। গৃহনির্মাণশিল্পে যোগ করেন নতুন রুচি ও আভিজাত্য। ফলে গ্রামের মুসলিম ঘরগুলো বাঁশের কঞ্চিতেও অঁাকত বিচিত্র আল্পনা, যেখানে ব্যবহার করা হতো রঙ ও প্রকৃতিকে। প্রতিবেশী সমাজেও এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। বাগানের বিস্তার, বাড়িতে বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব, বাড়ির সামনে বেড়া ও পর্দা, দরোজা-জানালায় পর্দার ব্যবহার, পাকাঘরে খিলানের ব্যবহার ইত্যাদির প্রচলন ঘটে। বাথরুম ও হাম্মামের প্রচলন ছিল গুরুত্বপূর্ণ দান। কৃষিজ যন্ত্রপাতি ও স্থানীয় উপকরণের উৎপাদন ও ব্যবহারে সুফিরা আনুকূল্য দেন।
লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল