০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ২৪ পৌষ ১৪৩১, ৭ রজব ১৪৪৬
`
প্রধান উপদেষ্টার প্রতি খোলা চিঠি

সংস্কার ছাড়া নির্বাচন মূল্যহীন

-

মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা

গত ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে প্রথম ভাষণে আপনি দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেছিলেন, ‘বিপ্লবী ছাত্র-জনতা আমাকে জাতির এক সঙ্কটময় মুহূর্তে এক মহান দায়িত্ব অর্পণ করেছে। তারা একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে। নতুন প্রজন্মের এই গভীর আকাক্সক্ষা বাস্তবায়িত করতে, আমি তাদের সাথে সহযোদ্ধা হিসেবে যুক্ত হয়েছি।’
আপনার এ কথা আশা জাগিয়েছে এবং পরিবর্তনের সম্ভাবনা উজ্জ্বল করেছে। কিন্তু ১১ নভেম্বর, ২০২৪ দ্য ডেইলি স্টারের মাহফুজ আনামের সাথে আপনার কথোপকথনে শোনা গেল ভিন্ন সুর। যখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি বলেছেন যে, আপনি জনগণের রায় অনুযায়ী কাজ করবেন।’ এর উত্তরে আপনি বললেন, ‘যদি সব রাজনৈতিক দল আজ সিদ্ধান্ত নেয় যে সংস্কার প্রয়োজনীয় নয় এবং শুধু নির্বাচন চায়, তাহলে আমি কে যে এই সংস্কারগুলো কার্যকর করব?’
আমরা মনে করি, জনগণের চোখে আপনি হলেন একজন সংস্কারক, একজন নতুন বাংলাদেশের নির্মাতা। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে, জাতি আপনার কাছ থেকে সংস্কারের প্রতি অঙ্গীকার ও দূরদর্শিতা প্রত্যাশা করছে, যা অবিলম্বে নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এ মুহূর্তে নির্বাচন জাতির প্রধান অগ্রাধিকার নয়। অপরিকল্পিত ও অপর্যাপ্ত সংস্কারের মাধ্যমে যদি নির্বাচন করা হয়, তাহলে দেশ আবারো সেই অকার্যকরতা এবং দুর্নীতির চক্রে আটকে যাবে। জনগণ তাদের ভোট আগের মতো দেবেন- একটি ভালো ভবিষ্যৎ বেছে নিতে নয়; বরং কম ক্ষতিকর বিকল্প বেছে নিতে। এটি জাতির জন্য প্রকৃত কোনো বিকল্প নয়; এটি হবে চাপিয়ে দেয়া অবস্থান।

গত জুলাইয়ে দেশব্যাপী আন্দোলনে জনগণের ম্যান্ডেট অত্যন্ত স্পষ্ট। তাদের আত্মত্যাগ ছিল গভীর- মাত্র এক মাসে হাজারও প্রাণ বিসর্জন, হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে। এ আত্মত্যাগ শুধু প্রতীকী পরিবর্তনের জন্য নয়। এটি একটি বাস্তব রূপান্তরের জন্য- একটি নতুন বাংলাদেশের জন্য যেখানে থাকবে ন্যায়বিচার ও সুশাসন।
জনগণের এ আকাক্সক্ষা অগ্রাহ্য করা কোনোভাবেই ঠিক হবে না।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর ধরে বাংলাদেশ অসংখ্য পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে। বারবার দেশের মানুষ পরিবর্তন চেয়েছে, অথচ ক্ষমতাসীনদের দ্বিচারিতায় জন-আকাক্সক্ষা অপূর্ণ রয়ে গেছে। এ অবস্থা আর চলতে দেয়া যায় না।
মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা
ইতিহাস আপনাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড় করিয়েছে। জাতির দীর্ঘ প্রতীক্ষিত মুক্তি এবং স্বশাসনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দায়িত্ব এখন আপনার কাঁধে। এ মুহূর্তকে এমন একটি সময়ে পরিণত করুন, যখন বাংলাদেশ তার সঠিক পথ- ন্যায়বিচার, সংস্কার ও প্রকৃত গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হতে পারে।
নির্বাচনের দাবিটি শুধু রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে আসে, দুঃখ-কষ্টে থাকা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নয়, যারা একটি নতুন ব্যবস্থা দেখতে চায় যা নির্বাচনের আগে তাদের বিশ্বাস ও আস্থা পুনরুদ্ধার করবে।

নিঃসন্দেহে যুব নেতৃত্ব জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করে। তারা হাসিনার শাসন উৎখাত করেছে এবং আপনাকে জাতিগঠনের দায়িত্বে নিয়োজিত করেছে।
কঠিন পরিস্থিতিতে অসাধারণ পদক্ষেপের প্রয়োজন হয়। এটি নিঃসন্দেহে একটি কঠিন সময়। প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়েছে এবং সিস্টেম সম্পূর্ণভাবে পচে গেছে, যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অন্তহীন বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু রয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে কখনো গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। ক্ষমতায় আসা প্রতিটি রাজনৈতিক দল অকার্যকর শাসনে অবদান রেখেছে, যা খারাপ থেকে আরো খারাপ হয়েছে। সব শেষে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন পুরো সিস্টেম ধ্বংসের কাজটি সম্পন্ন করেছে।
দেশ এখন এমন এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে, যেখান থেকে এটি অবাধ পতনের দিকে যেতে পারে, যদি না সংস্কার এবং একটি উন্নত ব্যবস্থার মাধ্যমে তা রক্ষা করা হয়। এ ব্যবস্থাই একমাত্র পথ যা ধীরে ধীরে পুরনো মানসিকতা এবং কাজ করার পদ্ধতি পরিষ্কার করতে সাহায্য করতে পারে। এটিই একমাত্র উপায় যাতে অতীতের পুনরাবৃত্তি করা বন্ধ করা সম্ভব।

তরুণদের সাহস এবং দৃঢ়সঙ্কল্প দেখে দেশের সব শ্রেণিপেশার মানুষ একযোগে জুলাই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রতিটি কোণ থেকে তারা এগিয়ে এসেছিলেন, যখন দেখলেন তারা ফ্যাসিবাদী সরকারের নৃশংস পুলিশ বাহিনীর বন্দুক থেকে পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি নিতেও প্রস্তুত ছিলেন এবং পিছিয়ে আসেননি।
এ ধরনের নজিরবিহীন সঙ্কল্প ও আত্মত্যাগ আমাদের যুবসমাজ থেকে আসে, যা অনেক কিছু বলে দেয়। নতুন চিন্তাধারা এবং নতুন কর্মসূচির মাধ্যমে জাতিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষমতা এবং শক্তি তাদের রয়েছে। তাদের সর্বতোভাবে সহায়তা করা উচিত। তাদেরকে আমাদের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করা উচিত।
২০০৯-এর আগে বিএনপি তিনবার বাংলাদেশ শাসন করেছে। যখন ২০০১ সালে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে- তখন গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক সংস্কার আনার একটি বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু তারা সফল হয়নি বরং বিদ্যমান পরিস্থিতি বজায় রাখার পথ বেছে নেয়।
অকার্যকর শাসন ও পুরনো ধারাবাহিকতার পথ ধরে এক-এগারোর ঘটনা ঘটে। সেই সাথে আওয়ামী লীগের জন্য আবারো ক্ষমতায় আসার সুযোগ তৈরি করে।
তাই আর দ্বিধা বা আত্মসংশয়ের কোনো জায়গা নেই। আপনি এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেন না। ইতিহাস এবং এই জাতি আপনাকেই দোষারোপ করবে।

নির্বাচিত এবং বিদেশী স্বার্থের পক্ষ থেকে প্রচণ্ড চাপ আসাটা স্বাভাবিক। তবে সেটি আপনার কাজের অংশ। আপনি যদি এই মিশনে সফল হন, জাতিও সফল হবে। এটিকে আপনার কখনো অবমূল্যায়ন করা ঠিক হবে না।
১৮ নভেম্বর বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে সাক্ষাৎকারে আপনি এমন কথা বলেছেন যা ১১ নভেম্বর ডেইলি স্টারকে দেয়া বক্তব্যের চেয়ে আলাদা। আপনি বলেন, ‘সংস্কার জাতির দীর্ঘমেয়াদি জীবনীশক্তি। সংস্কার জাতিকে, বিশেষত আমাদের যুবসমাজকে, একটি নতুন জগৎ সৃষ্টি করার সুযোগ দেবে। জাতিকে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবেন না।’ বক্তব্যটি জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন। সুতরাং, সেই আকাক্সক্ষার পাশে দাঁড়ান।
বাংলাদেশের জন্য একটি কার্যকর গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখা এবং বৈশ্বিক ভয়ঙ্কর ভূ-রাজনৈতিক চাপ সহ্য করতে একটি বহুদলীয় ব্যবস্থা এবং সংহত রাজনৈতিক কাঠামো অত্যন্ত প্রয়োজন। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ঐকমত্যভিত্তিক প্রক্রিয়া একমাত্র বিকল্প।

আপনি ডেইলি স্টারকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা শাসক নই, কেবল সুবিধাদাতা।’ একজন সুবিধাদাতা কখনো বিপর্যস্ত দেশ পুনর্গঠনের সংগ্রামে সহযোদ্ধা হতে পারেন না। আপনার সরকার দীর্ঘ সময়ের জন্য দেশ শাসনের দায়িত্ব পায়নি কিন্তু আপনার সরকার বৃহত্তর একটি উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল : প্রধানত একটি নতুন ব্যবস্থা ও মানসিকতার ভিত্তি স্থাপন করতে সহায়তা করা, যাতে দৃষ্টিভঙ্গির এ পরিবর্তন থেকে নতুন বাংলাদেশের উদ্ভব হতে পারে।
এ সঙ্কটময় সময়ে জাতির প্রয়োজন একজন সংস্কারকের। এ ধরনের সুযোগ খুব কম জাতির জীবনে আসে, যখন একটি বড় ধরনের পরিবর্তন সম্ভবপর হয়।
বাংলাদেশ বর্তমানে এক গভীর অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এটি একটি মুক্তিযুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ বা বিশাল বিদ্রোহের মতো যেখানে পুরনো, ভঙ্গুর ব্যবস্থা উৎখাত করে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করা হয়। জনগণ যখন পুরনো নিয়ম এবং পথ পরিহার করে নতুন শুরুর জন্য পরিবর্তন চায় তখন এটি এক জটিল সময়।
এ ধরনের পরিবর্তন অন্য সময়ে অত্যন্ত কঠিন। ক্ষমতাসীন কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে আরো বেশি কঠিন। অতীতের উদাহরণ যদি বিবেচনা করা হয়, রাজনৈতিক দলের নিজস্ব স্বার্থের দ্বন্দ্ব প্রায়শই পরিবর্তনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
ঠিক এ কারণে আপনার অরাজনৈতিক স্থানান্তরকালীন সরকারকে এ বিশেষ মুহূর্তে জাতির জন্য এ অসাধারণ পদক্ষেপটি নিতে হবে। সংশয় ও ভীরুতা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ জনগণের অনুমোদন আপনার সাথে রয়েছে।

ব্যবস্থাটি এমন হওয়া উচিত যাতে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরে সময়মতো নির্বাচন নিশ্চিত করা হয়, সঠিক চেক অ্যান্ড ব্যালান্স রাখা হয়, ক্ষমতার সঠিক বিভাজন ও সীমাবদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং একটি বিকেন্দ্রীকৃত ফেডারেল ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়। এটি একটি সরকারকে স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ ও দেশের কার্যকর ব্যবস্থাপনায় দক্ষ রাখতে বাধ্য করতে অত্যাবশ্যক এবং এটি সুশাসনের অংশ।
কার্যকর আইনের শাসন এবং একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থা ভবিষ্যতের অনেক নেতা এবং তরুণ রাজনীতিককে আইন মেনে চলার এবং একটি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে নিজের সম্ভাবনা অর্জনে রাজি করবে, যা নিয়ম ভেঙে ও বেপথু হয়ে ক্ষতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টিতে বিরত রাখবে। আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি তাদের প্রকৃত কারণ ও পরিণতি বুঝতে সাহায্য করবে, যা ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে।
এই মৌলিক পরিবর্তনগুলো এবং প্রজাতন্ত্রের একটি স্থায়ী কাঠামো প্রতিষ্ঠা, যা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ হবে, তা প্রয়োজনীয় এবং সঠিক পদক্ষেপ। তবে, তারা রাজনৈতিক অঙ্গনে যোগদানের অভিজ্ঞতা এবং সঠিক প্রশিক্ষণের অভাব বোধ করে। আপনার সরকার এবং সিভিল সোসাইটিকে এ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে হবে যাতে তারা নেতৃত্বের দক্ষতা অর্জন করে শিগগিরই বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য প্রস্তুত হতে পারে।
হ্যাঁ, একটি গণভোট আয়োজন করা কষ্টসাধ্য হবে। কিন্তু জাতির ইতিহাসের এ বিরল মুহূর্তে আমাদের উচিত এই পরিবর্তনগুলোর বৈধতা দিতে দায়িত্ব নেয়া এবং এগুলো নির্বাচনের আগে আমাদের স্থায়ী শাসন কাঠামোর অংশ বানানো।

এটি অর্জনে আমাদের সংবিধানের খসড়া প্রস্তাব অনুমোদন করতে একটি গণভোট আয়োজন করতে হবে।
দেশের জন্য যদি এ সঙ্কটময় সময়ে বুলডোজারের মতো কাজ করার প্রয়োজন হয়, তবে বুলডোজার হোন। কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত নিতে বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করুন, যেগুলো ধ্বংস ও নির্মূল করতে হবে, যেগুলো সংস্কার ও পুনরুদ্ধার করতে হবে এবং যেগুলো টেকসইভাবে নির্মাণ ও শক্তিশালী করতে হবে।
লক্ষ্যে পৌঁছাতে ইতিবাচক শক্তির সহায়তা প্রয়োজন, বিশেষত যুবকদের বিশাল সংখ্যা, যারা একদিন সক্রিয় কর্মী ও রাজনীতিক হতে চলেছে। ১৬ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যবর্তী তরুণ প্রজন্ম শিগগির জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক হয়ে যাবে। এমন সম্ভাবনা অবমূল্যায়ন করা হবে জাতির জন্য এক অবিচার ও বিরাট ভুল। তারা আমাদের আশা ও ভবিষ্যৎ।
লেখক : মানবাধিকারকর্মী; এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, মুসলিমস ফর পিস, জাস্টিস অ্যান্ড প্রগ্রেসিভ এবং উইমেন ফর গুড গভর্ন্যান্স

 

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement