জাতীয় বীরদের স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধা জানাব কিভাবে
- প্রফেসর ড. শাহজাহান খান মুকুল
- ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
বিশে^র সব জাতিই তার বীর সন্তানদের গভীরভাবে শ্রদ্ধা করে ও সর্বোচ্চ সম্মান জানায়। যারা দেশ ও জনগণের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে তাদের শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানো নৈতিক ও মানবীয় কর্তব্য। যে জাতি তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্মান করতে জানে না সে জাতি কখনো আত্মমর্যাদায় বলীয়ান হতে পারে না।
জাতীয় বীরদের সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর বিভিন্ন পদ্ধতি দেশে দেশে চালু রয়েছে। তাদের বিভিন্নভাবে আর্থিক ও নৈতিক সহযোগিতা করা বা তাদের অবদান আন্তরিকভাবে স্মরণ করা বা তাদের জীবন স্মরণীয় করে রাখার জন্য নানা স্থাপনা তৈরি করা। এ ছাড়া পাঠ্যপুস্তকে তাদের বীরত্বগাথা তুলে ধরে ভবিষ্যৎ বংশধরদের তাদের ত্যাগের ইতিহাস জানানোর ব্যবস্থা করা হয়।
জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যেভাবেই স্মরণ করা হোক না কেন, সেটা অবশ্যই আন্তরিক এবং টেকসই হওয়া প্রয়োজন। কোনো রকম মেকি বা লোক দেখানো শ্রদ্ধা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি অবমাননা ছাড়া কিছু নয়। বরং এটা নিন্দনীয়। চাপিয়ে দিয়ে বা কোনো রকম জোর জবরদস্তি করে কারো প্রতি শ্রদ্ধা বা সম্মান আদায় করাও বাস্তবে সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের মানুষ বিভিন্ন সময়ে তাদের অধিকার এবং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে। কখনো এসব সংগ্রাম আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। কখনো সশস্ত্র প্রতিরোধ বা যুদ্ধের রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এসব সংগ্রামে অনেক মানুষ জীবন দিয়েছে, অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে।
বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে বিদেশীদের হাতে নানাভাবে অত্যাচারিত ও নিপীড়িত হয়েছে। দখলদার বিদেশীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে বিতাড়িত করেছে। আবার প্রয়োজনে দেশীয় অত্যাচারী শাসক এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। এসব সংগ্রামে অনেক নিরপরাধ মানুষ সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর মাধ্যমে গুমের শিকার হয়েছে যারা আর কোনো দিন পরিবারের কাছে ফিরে আসবে না।
অত্যাচারী সরকার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য নিরপরাধ প্রতিবাদী মানুষের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছে। মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে। জীবন হারিয়েছে হাজার হাজার মানুষ। আহত হয়েছে অগণিত মানুষ যাদের অনেকেই দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে চিরদিনের জন্য অন্ধত্ব বরণ করেছে। শত শত যুবক নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষের কাছে এখন একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, যারা স্বৈরাচারী সরকারের পতনের আন্দোলনে জীবন দিয়েছে, যারা ১৯৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাণ দিয়েছে, আর যারা ভাষা আন্দোলনসহ অন্যান্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জীবন দিয়েছেন তাদের আমরা কিভাবে স্মরণ করব, কিভাবে সম্মান দেখাব।
আমরা কি বিগত সরকারের মতো রাস্তার মোড়ে মোড়ে মূর্তি নির্মাণ করে শহীদদের স্মরণ করব? নাকি ভিন্ন কোনোভাবে? এটা তো প্রমাণিত যে, মূর্তি ক্ষণস্থায়ী এবং এটি কোনো এক সময় শহীদদের সম্মানের পরিবর্তে তাদের অবমাননার উপকরণ হয়ে উঠতে পারে। আমরা শহীদদের প্রকৃত অর্থে সম্মান করার জন্য আমরা একটা বিকল্প চিন্তা করতে পারি। আমরা এমন একটা পদ্ধতিতে শহীদদের স্মরণ ও সম্মান জানাতে পারি যার জন্য কোনো আর্থিক বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে না। আমরা এমন পদ্ধতিতে শহীদের স্মরণ করব যাতে শহীদরা প্রতিদিন আমাদের অন্তরে জাগ্রত থাকবে এবং তাদের প্রতি আমাদের সম্মান ও শ্রদ্ধা আবহমানকাল অব্যাহত থাকবে।
আমরা আমাদের শহীদের নামে অবশ্যই বিভিন্ন স্থাপনা রাস্তাঘাট, পার্ক বা অন্যান্য স্থানের নামকরণ করতে পারি। আমরা বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি ভবনকে শহীদদের নামে নামকরণ করতে পারি। আমরা পাঠ্যপুস্তকে শহীদদের ত্যাগ এবং বিজয়ের কথা কোমলমতি ছাত্রদের কাছে তুলে ধরতে পারি। এসবই আমাদের করা দরকার। কিন্তু এর সাথে আমরা আর একটা পদ্ধতিতে আমাদের জাতীয় বীরদের অবদান প্রতিদিনের স্মরণের বিষয় বানাতে পারি।
আমরা আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সরকারি অফিস আদালতে, বেসরকারি ও ব্যক্তি মালিকানার প্রতিষ্ঠানে প্রতিটি সভা-সমিতি ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করতে পারি, তাদের পরকালের জীবন সফল করার জন্য দোয়া করতে পারি।
অস্ট্রেলিয়ায় দেখেছি, প্রতিটি অনুষ্ঠানের শুরুতে ওই দেশের আদিবাসীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের সাথে সাথে তাদেরকে দেশ ও দেশের মাটি ও পানির মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আদিবাসী মুরব্বিদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ওই দেশের মূল মালিক হিসেবে আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেয়া হয়। যারা বিদেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে এসে অস্ট্রেলিয়ায় বসতি স্থাপন করেছে তাদের পক্ষ থেকে আদিবাসীদেরকে ওই দেশের মূল মালিক হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার এই রীতি খুবই অর্থবহ।
অস্ট্রেলিয়ার সব বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মসজিদ, গির্জা, সরকারি ও বেসরকারি অফিসের যেকোনো অনুষ্ঠানের শুরুতে আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানদের প্রতি স্বীকৃতি ও সম্মান জানানো হয়। এ জন্য কোথাও কোনো মূর্তি নির্মাণ করতে হয়নি বা কোনো বিশেষ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির প্রয়োজন পড়েনি।
সে দেশে প্রতিটি সরকারি বা বেসরকারি অনুষ্ঠানের শুরুতে নিম্নোক্ত অ্যাকনলেজমেন্ট অব কান্ট্রি বা দেশের স্বীকৃতি পাঠ করা হয়।
Acknowledgement of Country: I acknowledge the Traditional Owners of Country throughout Australia and recognize the continuing connection to lands, waters and communities. We pay our respect to Aboriginal and Torres Strait Islander cultures; and to their Elders past, present and emerging.
বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় : দেশের স্বীকৃতি : আমি অস্ট্রেলিয়াজুড়ে দেশের ঐতিহ্যবাহী আদিবাসী মালিকদের স্বীকৃতি দিই এবং ভূমি, জল এবং সম্প্রদায়ের সাথে অবিরত সংযোগকে স্বীকৃতি দিই। আমরা আদিবাসী এবং টরেস স্ট্রেইট দ্বীপের সংস্কৃতির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানাই; এবং তাদের অতীত, বর্তমান এবং আগামীর প্রবীণদের প্রতি সম্মান জানাই।
অস্ট্রেলিয়ার অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং সম্মান প্রদর্শনের জন্য নিম্নোক্ত বাক্যগুলো আমরা প্রতিটি অনুষ্ঠানের শুরুতে পাঠ করতে পারি। এতে আনুমানিক এক মিনিট সময় লাগতে পারে।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।
আবহমানকাল থেকে বাংলাদেশের জনগণের অধিকার এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যারা বিভিন্ন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং অংশগ্রহণ করেছেন তাদের সবার প্রতি আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। আমরা বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি তাদের, যাদের সংগ্রামের ফলে বিদেশী শক্তি ও স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে এবং সেই পুণ্যভূমিতে আমরা বসবাস করছি এবং জীবনযাপন করছি।
লেখক : উপাচার্য, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা