০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩ পৌষ ১৪৩১, ৬ রজব ১৪৪৬
`
তৃতীয় নয়ন

সিরিয়ায় ক্ষমতার বদল

-

সিরিয়ায় পরাজিত ও পলাতক প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সমর্থকরা ঘুরে দাঁড়াতে চাচ্ছে। তবে ওরা কতটুকু সফল হয়, তা দেখার বিষয়। আসাদের অনুগতরা সম্প্রতি ১৪ জন পুলিশকে হত্যা করেছে।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, বাশার আল আসাদ রাশিয়ায় পালিয়ে গেলেও শেষ হয়ে যাননি। এর পরই সিরিয়ায় পুলিশ হত্যার ঘটনা ঘটে। ১৪ জন পুলিশ সদস্যকে অ্যামবুশ করে হত্যা করা হয়। পরাজিত সরকারের সমর্থক হত্যাকারীরা গ্রামাঞ্চলে সক্রিয়। গত ২৬ ডিসেম্বর অস্থায়ী সরকার এ হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে। অভ্যুত্থানের নেতা মোহাম্মদ শারা বলেছেন, ‘আমরা পাশ্চাত্য বা প্রতিবেশী কারো প্রতিমুখী নই। এ দিকে, মার্কিন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, তুরস্ক সিরিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান বলেছেন, ‘আমি সিরিয়ার কুর্দিদেরকে পুঁতে ফেলব।’
ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পরাজয়ের পর সিরিয়া একদিকে তুর্কিপন্থী কুর্দি অন্যদিকে বাশার আল আসাদের সমর্থক কুর্দিদের রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে, ইসরাইল প্রায় ৮০০ বার সিরিয়ার বিভিন্ন টার্গেটে হামলা চালিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও হামলার সুযোগ পেয়েছে সিরিয়ায়। রাশিয়া ও ইরানের এত সহায়তার পরও আসাদ ক্ষমতায় টিকতে পারেননি কেন, এটাই বড় প্রশ্ন।
এ দিকে, সিরিয়ায় অভ্যুত্থানের নেতা শারা সিরিয়ার নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দিতে প্রতিবেশীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী দেশ চালাচ্ছেন, তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম আসাদ হাসান।
ডিসেম্বরের পর সমর্থকদের বিক্ষোভ এবং তা দমনে সরকারের কারফিউ জারি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সিরিয়ার নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘১০ জন পুলিশকে আসাদ সরকার সমর্থকরা আহত করেছে তার্তুস এলাকায়। কিন্তু যারা সিরিয়ার নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে অথবা এর নাগরিকদের জীবন বিপন্ন করেছে, তাদেরকে ছাড়া হবে না।’ সিরিয়ার পুলিশ বাহিনী হোমস শহরে রাত্রিকালীন কারফিউ দেয়। রাষ্ট্রীয় মিডিয়া আরো জানায়, বাশার আল আসাদের আলাবি সম্প্রদায়ের লোক এবং শিয়া মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজন এই হামলা চালায়। ৮ ডিসেম্বরের অভ্যুত্থানে আসাদকে পরাজিত করার অর্থ সুন্নিদের ক্ষমতা দখল। এটা আলাবি সম্প্রদায় মেনে নিতে পারেনি। এরা সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সরকারকে চাপে রাখতে চাচ্ছে। এখন ক্ষমতায় আছে সাবেক আলকায়েদার সহযোগী হায়াত তাহরির আল শাম গ্রুপ, যারা ঐঞঝ নামে পরিচিত। তারা কারফিউ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। তবে রাষ্ট্রীয় মিডিয়া জানায়, ‘কারফিউ সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত চলে।’ সিরিয়ার নতুন সরকারের নেতারা সিরিয়ার সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সংখ্যালঘুরা আশঙ্কা করছে, বিজয়ীরা রক্ষণশীল সরকার গঠন করবে। আরবিতে সিরিয়াকে ‘সুরিয়া’ এবং ‘শাম’ নামে অভিহিত করা হয়।
মুসলমানদের পবিত্র কুরআন মাজিদের সূরা কুরাইশে শীতকাল বলতে সিরিয়াকে বোঝানো হয়েছে। ইসলামের প্রথম যুগেই মুসলমানদের দ্বারা সিরিয়া অধিকৃত হয়। রাজধানী দামেস্ক ছাড়াও সিরিয়ার প্রাচীন নগরী আলেপ্পো। আলেপ্পো থেকে ইরাকের মুসল শহর পর্যন্ত দীর্ঘ ৪০০ মাইল এলাকা ২০১৪ সালে আইএস দখল করেছিল। প্রাচীন নগরীর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য হচ্ছে হোমস, হামা আর দেইর আলজোর; বন্দরনগরীর মধ্যে তারতুস ও লাতাকিয়া প্রধান। রাসূল সা:-এর সময়ে মদিনা থেকে দামেস্ক পর্যন্ত বাণিজ্যপথ ছিল।
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সূচনা হয় ২০১১ সালের মাঝামাঝি। এক পর্যায়ে একাধিক দল গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। বাশার আল আসাদের পিতা হাফেজ আল আসাদ ১৯৮২ সালে অনেক সুন্নিকে হত্যা করেছিলেন, যাদের মধ্যে ‘ইখওয়ানুল-মুসলিমিন’ বা ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ প্রধান সংগঠন।
হাফিজ আল আসাদ দীর্ঘ ৩০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি নিষ্ঠুর হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেন এবং অনেক মুসলমানকে হত্যা করেন। তার মৃত্যুর পর ২০০০ সালে লন্ডন থেকে চিকিৎসক পুত্র বাশার আল আসাদের আগমন ঘটে। তার স্ত্রীও একজন ইংরেজ। আসাদরা নুসাইরি বা আলাবি গোত্রের লোক, যাদের সাধারণ মুসলমানরা ‘মুসলমান’ হিসেবে গণ্য করে না। এরা শিয়া হিসেবে হজরত আলীর প্রতি অতিরিক্ত ভক্তি দিয়ে থাকে। ইসলামী ইরান এদেরকে প্রথম থেকে সমর্থন দিয়ে আসছে। এ নিয়ে আমাদের দেশেও জনমনে ক্ষোভ রয়েছে। ইরান কখনও এ ব্যাপারে মুখ খোলেনি।
বাশার সরকারের পতনের পর নতুন সরকার প্রধান সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব ও সেখানকার জনগণের ইচ্ছার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য ইরানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ইরান এখনো নতুন সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। উল্লেখ্য, রাশিয়ার সাথে ইসলামী ইরানের সম্পর্ক ভালো।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে রাশিয়াতেই আশ্রয় নিয়েছেন। রাশিয়ায় গিয়ে এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ‘আমি পালাতে চাইনি। আমাকে বাধ্য করা হয়েছে।’ রাশিয়া তার প্রতি মূলত প্রতিদান দিয়েছে। আগে থেকেই ঠিকঠাক না থাকলে তিনি ওখানে আশ্রয় নিতে পারতেন না। ঠিক যেভাবে বাংলাদেশের পতিত সরকারের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক না থাকলে শেখ হাসিনা সে দেশে আশ্রয় নিতে পারতেন না।
ইসরাইল বাশার আল আসাদের পতনের সুযোগে সিরিয়ার প্রতিরক্ষা শক্তি দুর্বল করার প্রয়াস পেয়েছে। সে আসলে সিরিয়ার পারমাণবিক শক্তিকে ভয় পায়। ইসরাইলের নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী দখলকৃত গোলান মালভূমিতে মোতায়েন থাকবে। সেখানে তিনি আর কোনো বাহিনীকে পছন্দ করেন না। এর আগে তিনি বলেছিলেন, একটি সুনির্দিষ্ট বাহিনী দায়িত্ব না নেয়া পর্যন্ত ইসরাইলের সৈন্যরা থাকবে সেখানে। তখনই বোঝা গিয়েছিল তিনি সেখানে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মোতায়েন চান।


আরো সংবাদ



premium cement