প্রশাসন সংস্কার : ফ্যাসিস্ট আমলাদের গাজ্বালা
- রিন্টু আনোয়ার
- ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
দুনিয়ার সব দেশেই আমলা আছে। আমলাদেরও কয়েকটি বিশেষ দেশ আছে। যার অন্যতম বাংলাদেশ। আমাদের সংবিধানে লেখা আছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ; কিন্তু তার পরও আমলাতন্ত্রের বিষয়টি নানাভাবে নানান সময়ে আলোচনায় এসেছে। আমলাতন্ত্র আমাদের দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য বিশেষ করে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে বড় এক সমস্যা হিসেবে জিইয়ে আছে। অনেক ক্ষেত্রেই বড় রকমের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে বিভাজনের দাগ ক্রমেই মোটা করে চলেছে। প্রজাতন্ত্রের মালিক যদি জনগণই হয়ে থাকেন, তাহলে আমলারা জনগণের স্বার্থ যেভাবে আমলে নেয়ার কথা সেভাবে নেন না কেন?
কারণ, বাংলাদেশের বাস্তবতায় আমলারাই মূলত অনেক কিছুর কারিগর। তারা শাসক-প্রশাসক। সাম্প্রতিক আলোচিত সংস্কার প্রশ্নে এসে তারা সেই হিম্মত আবারো দেখিয়ে দিচ্ছেন। কাজকর্মে শাসনের মনোভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তারা অন্যদের সংস্কার করতে চান। নিজেরা সংস্কার হতে চান না। তাদেরই একটা বিশেষ গ্রুপ বিগত স্বৈরাচারকে শক্তি জোগান দিয়েছে। দানবীয় ফ্যাসিস্ট করে তুলেছে। টানা দীর্ঘ সময় টিকিয়ে রেখেছে। শেষতক ছাত্র-গণআন্দোলনে চরম ধাক্কা খেয়েছে। সরকারটি বিদায় নিয়েছে। হাতেগোনা কিছু আমলাও পালিয়েছে বা আটক হয়েছে। বাকিরা নানান ছলকলায় এখনো টিকে আছে।
গুম, গায়েবি মামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে পুলিশ ও র্যাব ক্ষমা চাইলেও ভোট কারচুপিতে জড়িত আমলারা তা করেননি। আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য এবং আমলাদের ভাষ্য অনুযায়ী, রাতে ভোটের কারিগর এইচ টি ইমাম, সেই সময়কার নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ, পুলিশপ্রধান ড. জাবেদ পাটওয়ারী, সচিব কবির বিন আনোয়ার। এদের উপর সব দোষের দায়। বাস্তবে দেখা যায় সব আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তা তা বাস্তবায়ন করেন। কেউ প্রতিরোধের চেষ্টা করেননি। তৎকালীন সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদও সহায়তাকারী ছিলেন। এই বড়দের পরবর্তী অবস্থানে থাকা বাকিরা ঝিম মারার মতো আছেন। আর উসকানি দিচ্ছেন নতুন কোনো ভেজালের অপেক্ষায়।
বিচার বিভাগ, দুদক, এনবিআর, নির্বাচন কমিশন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি সেক্টরে এরা দ্রুততম সময়ে বাতাসদৃষ্টে এ সরকার ও স্বৈরাচার হটাও আন্দোলনকারীদের সাথে হলুদের মতো মিশে গেছে। এমন একটা ভান করছে, অপশাসনের রাজনৈতিক দমন-পীড়ন ও জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন, শোষণ-বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার নিজেরাও হয়েছে। অথচ ভোটাধিকার, মানবাধিকার হরণ, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাট ও পাচারে তাদের কারো কারো যারপরনাই ভূমিকা রয়েছে। আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা ও সরকারের একটি অংশ এদের চিহ্নিত করে পদক্ষেপ নিতে গিয়েও কুলিয়ে উঠতে পারছে না। সরকারকেই কাহিল করে তুলছে তারা। পদে পদে তৈরি করছে প্রতিবন্ধকতা। বিভিন্ন দাবি-দাওয়াতে নিজেরা আন্দোলন করছে। অন্যদেরও নানান বায়নায় মাঠে নামতে সহায়তা করছে। এসবের মাধ্যমে প্রশাসন সংস্কারকে ভণ্ডুল করার আয়োজন করছে। প্রশাসন সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশনপ্রধানের অপসারণের দাবি করে বসেছে। আলটিমেটাম দিতেও ছাড়েনি।
যে কোনো সরকারের মন-মগজ সবার আগে বোঝেন আমলারা। সবলতা-দুর্বলতাও ধরতে পারেন দ্রুত। এবার সংস্কারের ঢেউ নিজেদের ওপরও বর্তাচ্ছে তা উপলব্ধি করে যা করা দরকার সবই করার বিস্তর আয়োজন তাদের। সরকারকে পেয়ে বসেছে। বিগত সময়ে বঞ্চিত-অপমানিত, বাধ্যতামূলক চাকরিচ্যুত এবং সরকারের কয়েকজন বিষয়টা বুঝতে পেরেও কুলাতে পারছেন না। এক আলোচনায় সে দিন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেই ফেলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যাপক জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনিক অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমলাদের বক্তব্যে হুমকি শুনতে পাচ্ছি। তাদের বিরুদ্ধে খুব দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণাও দেন নাহিদ। তার ঘোষণায় দুষ্ট আমলাদের পেটে মোচড় পড়েছে। রাষ্ট্রপরিচালনায় আমলাদের গুরুত্ব অনেক। তারা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের স্থায়ী অংশ। দেশ পরিচালনায় নীতিনির্ধারণ করেন রাজনৈতিক নেতারা। সেই নীতি বাস্তবায়ন করেন আমলারা। কিন্তু, বিগত কয়েক দশক ধরেই সিভিল সার্ভিস বিস্তর হেরফের।
যে কারণে প্রশাসন সংস্কার বিশ্বব্যাপী আলোচিত। আমলাতন্ত্রের অবয়ব হ্রাস করা ছিল ভারতীয় বেতন কমিশনের অন্যতম সুপারিশ। ভারত, পাকিস্তান কিংবা ব্রিটিশ কলোনিভুক্ত সাবেক দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র বা সিভিল সার্ভিসের প্রসার ও ব্যাপ্তি দ্রুত ও ব্যাপক। তাদের সেবার মানও অনেক নিচু। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট অনুযায়ী, আমাদের আমলাতন্ত্রের ভিত্তি হিসেবে পরিচিত প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তারাই হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। দেশের মানুষ তাদের কাছ থেকে সেবার পরিবর্তে শোষণের শিকারই হন বেশি।
অনেকেই একটা বিষয়ে একমত যে, ১৯৯৬ সালে সাবেক সিএসপি সচিব মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ‘জনতার মঞ্চ’ বানানোর একটি বিহিত হলে পরিস্থিতি হয় তো এ পর্যন্ত আসত না। আওয়ামী লীগ শাসনামলের অন্যান্য অনিয়মের প্রতিকারে অন্তর্বর্তী সরকার উদ্যোগ নিলেও নির্বাচনে জালিয়াতিতে জড়িতদের শাস্তির কথা নেই এখন পর্যন্ত। এই নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা ৬৭ রিটার্নিং ও ৫১২ সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তারা সুন্দর সুন্দর কথা এখন আরো বেশি বলছেন। তাদের কয়েকজন ওএসডি হলেও রিলাক্সে সময় পার করছেন। কম গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি পাওয়া কর্মকর্তারা সময় পার করছেন নিরিবিলিতে।
আমলা বা প্রশাসন বাদ দিলে দেশ চলবে না। বখে যাওয়া, বেপরোয়া হয়ে ওঠার লাগাম টেনে একটা বন্দোবস্তে আসা এখন সময়ের দাবি। এ সরকার তা না পারলে ভবিষ্যতে আর পারার আশা থাকবে না। কারণ এমন সুযোগ সব সময় আসে না। এ সরকার প্রশাসনকে একটা বন্দোবস্তের জায়গায় এনে দিতে পারলে ভবিষ্যৎ নির্বাচিত সরকার সেটাকে একটা কাঠামোতে আনতে পারবে। পরিস্থিতির অনিবার্যতায় তাকে তা করতেই হবে। প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর কথা এ কারণেই। দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যবস্থা করতে হলে প্রশাসনিক কাঠামোর সরলীকরণ প্রয়োজন। আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশন প্রশাসনিক কাঠামোতে পরিবর্তনের জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে। যেমন পদোন্নতিতে পরীক্ষা পদ্ধতির প্রবর্তন, উপসচিব পদে নিয়োগে পরীক্ষার মাধ্যমে সুযোগ নিশ্চিত করা, উপসচিব পদে ৫০% প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ও ৫০% অন্যান্য ক্যাডারের জন্য বরাদ্দ। গুরুত্বপূর্ণ আরো কিছু প্রস্তাবও আছে। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় পুলিশ ভেরিফিকেশন ব্যবস্থা তুলে দেয়া, জুডিশিয়াল সার্ভিসের মতো স্বাস্থ্য ও শিক্ষা কমিশন গঠন করার সুপারিশ। ফরিদপুর ও কুমিল্লাকে পৃথক বিভাগ করার প্রস্তাবও দিয়েছে কমিশন। প্রশাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডার প্রশাসনিক কাঠামোতে এ ধরনের পরিবর্তনের সুপারিশের বিরোধী। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা ৫০% কোটা ভাগাভাগির বিরোধিতা করেন। তাদের মতে, পদোন্নতিতে পরীক্ষার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করবে না এবং এটি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হতে পারে।
অন্য দিকে, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ প্রস্তাবিত পরিবর্তনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ২৫টি ক্যাডারের প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে তারা। বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশন এবং বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার তীব্র নিন্দা জানায় কমিশনের প্রস্তাবের। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটা ফয়সালা অবশ্যই আসতে পারে। কিন্তু, তা বানচালের চেষ্টা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে প্রশাসনিক সংস্কারের লক্ষ্যে বিভিন্ন কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশনগুলো গঠিত হয়েছিল সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রশাসনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি, দুর্নীতি দমন এবং জনমুখী সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের প্রস্তাবনাগুলোর বাস্তবায়ন সীমিত ছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রেস্টোরেশন কমিটি গঠন করা হয়।
লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রশাসনের পুনর্বহাল এবং কার্যক্রমে গতিশীলতা আনা। একই বছরে মন্ত্রণালয় এবং বিভাগগুলোর পুনর্গঠন ও প্রশাসনিক কাঠামো সহজ ও কার্যকর করার জন্য অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রি-অর্গানাইজেশন কমিটি গঠন করা হয়। সরকারি কর্মচারীদের বেতন কাঠামো উন্নয়ন ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ১৯৭৬ সালে পে অ্যান্ড সার্ভিস কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮-এর মধ্যে অন্তত ১০টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এর মধ্যে ছিল উপজেলা পরিষদ ব্যবস্থা প্রবর্তন, নতুন বেতন কাঠামো প্রবর্তন ও স্থানীয় সরকারব্যবস্থার শক্তিশালীকরণ বিষয়ক কমিশন। প্রশাসনিক কাঠামোর জটিলতা দূর করে স্বচ্ছ ও কার্যকর ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ১৯৯১ সালে প্রশাসনিক সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়। একই উদ্দেশ্যে আবার ১৯৯৬-৯৭ সময়ে প্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করে তৎকালীন সরকার। আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ও করব্যবস্থা সহজ এবং দুর্নীতিমুক্ত করার লক্ষ্যে ২০০৫ সালে ট্যাক্স অমবুডসম্যান আইন করা হয়। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের লক্ষ্যে ২০০৭ সালে রেগুলেটরি রিফর্ম কমিশন গঠন করা হয়। জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, প্রশাসনিক কার্যকারিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০০৯ সালে কর্মদক্ষতাভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি (পিবিইএস) করা হয়। ২০১০-এর দশকে ই-গভর্ন্যান্স বাস্তবায়ন, সেবা প্রদান পদ্ধতিকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা, সরকারি তথ্য ও সেবা অনলাইনে সহজলভ্য করার উদ্যোগ নেয়া হয়।
সর্বশেষ, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনকে জনমুখী ও দক্ষ করা, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এত সংস্কার কমিশন ও উদ্যোগ গ্রহণ করার পরও আশানুরূপ সফলতা পাওয়া যায়নি। বিশেষ করে পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি, পদোন্নতিতে কোটা এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডার থেকে আলাদা রাখার ক্ষেত্রে যে ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে, তা মানতে নারাজ বিসিএস ক্যাডাররা। এ নিয়ে সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সচিবের বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশের পরপরই বিবৃতি দিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছে প্রশাসন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্যাডার সমিতি এবং আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রশাসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়কে প্রাধান্য না দিয়ে ‘সার্ভিসকেই’ সংস্কারের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তবে এবার কিন্তু প্রেক্ষিত ভিন্ন। বিষয়টি জটিল বলে এড়িয়ে গেলে নয়া ফ্যাসিস্ট গজানোর পথ খোলাই থাকবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা