০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২১ পৌষ ১৪৩১, ৪ রজব ১৪৪৬
`

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবচ্ছেদ

-

বছর কয়েক আগে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর থেকে পৃথক মাদরাসা অধিদফতর করা হয়েছে। দেশে হাতেগোনা তিন-চারটি সরকারি মাদরাসা রয়েছে। ফলে মাদরাসা শিক্ষায় সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বা সরকারি কলেজের মতো কর্মী ব্যবস্থাপনা সেই অর্থে নেই। যদিও অনেকে মনে করছেন, মাদরাসা শিক্ষা যেহেতু থাকবে, তাই শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে চাইলে এবং মাদরাসা শিক্ষাকে শিক্ষার মূল ধারায় আনতে প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি করে সরকারি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা সময়ের দাবি। আবশ্যক, মাদরাসায় পড়া বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর কর্মসংস্থান তৈরি করা। কিন্তু সেরকম পরিকল্পনার কথা জানা যায়নি। তাই সঙ্গত কারণে প্রশ্ন এসে যায়, তাহলে মাদরাসা অধিদফতর আলাদা করা হলো কেন? যতটা জানা যায়, এ নিয়ে সেভাবে কোনো দাবি ওঠেনি। মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষক নিয়োগে সরকার তথা মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদফতরের বিশেষ কাজ নেই; যাবতীয় পরীক্ষা গ্রহণের দায়িত্ব মাদরাসা বোর্ডের। আবার উচ্চতর ডিগ্রির জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আলাদা আরবি বিশ^বিদ্যালয়। তাহলে কি শুধু এমপিও নিয়ন্ত্রণে একটি অধিদফতর সৃজন করা হয়েছে? আদতে বিষয়টি তাই।

২০২১ সালের শিক্ষা পরিসংখ্যান (এটিই সর্বশেষ)- মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-১৮,৮৭৪টি (সরকারি ৬২১টি)। স্কুল অ্যান্ড কলেজ-১৪২০টি (সরকারি ৬৩), কলেজ-৩৩০৯টি (সরকারি ৬২৫টি), মাদরাসা-৯২৯১টি (সরকারি তিনটি), টেকনিক্যাল-ভোকেশনাল-২৪৮৯টি (সরকারি ৩০৯টি)। এর বাইরে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ, প্রফেশনাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ আরো কিছু রয়েছে। ৬৬৬টি মাধ্যমিক স্কুলের সাথে প্রাথমিক স্তর সংযুক্ত আছে। একই পরিসংখানে আছে, মাধ্যমিকে অধ্যয়ন করছে এমন শিক্ষার্র্থীর সংখ্যা ৮৯,৩০,২৪৫ জন। পক্ষান্তরে মাদরাসায় পড়ছে ২৬,৫৭,২৫২ ছাত্রছাত্রী। স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ছে ১৫,৮৩,০৫০ জন। কেবল কলেজে পড়ছে ৪,৩০,৩২৬৫ জন। পাশাপাশি কারিগরি ও ভোকেশনালে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ৭,৬২,১০৮ জন। পরিসংখ্যান বলছে, মাদরাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দ্বিগুণ সংখ্যায় আছে মাধ্যমিক বিদ্যালয়, যার মধ্যে সরকারি খাতে ৬২১টি। স্বতন্ত্র কলেজের সংখ্যা ৩৩০৯টি এবং এর মধ্যে সরকারি ৬২৫টি।
তাহলে মাদরাসার জন্য আলাদা অধিদফতর হলো, অপেক্ষাকৃত বৃহত্তর মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য নয় কেন? শিক্ষা প্রশাসকদের বিবেচনাবোধ প্রখর হলে কালকেই মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর আলাদা হওয়া দরকার। কেননা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা, শিক্ষকের সংখ্যা এবং সর্বোপরি কাজের পরিধি বিবেচনায় মাধ্যমিক অধিদফতর আলাদা হওয়া সময়ের দাবি। যেমন দরকার খুব দ্রুত মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ থেকে উচ্চ শিক্ষা বিভাগ আলাদা করা। একই কথা প্রযোজ্য স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে নগর উন্নয়ন আলাদা করার বেলায়। এক সময়ে দেশে ষাটটির মতো পৌরসভা ছিল। এখন তা ৩২৮টি, যোগ হবে ১২টি সিটি করপোরেশন-স্থানীয় সরকার বিভাগের বিশাল বাজেট থাকে শুধু নগরসমূহে। সাত-আটটি বিশ^বিদ্যালয় থেকে পাবলিক-প্রাইভেট মিলিয়ে দেড়শত; এক শিক্ষা বিভাগ দিয়ে এসব সামলানো কঠিন। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা সামলাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে বলা, সাড়ে তিন লাখ শিক্ষকের জন্য আলাদা প্রশিক্ষণ অধিদফতর না হলে প্রাথমিকের শিক্ষকের প্রশিক্ষণ হবে কী করে! পঁয়ষট্টি হাজার বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ আর মেরামতে কখনো এলজিইডি, কখনো শিক্ষা প্রকৌশল, কখনো জনস্বাস্থ্য, কখনো গণপূর্তের ওপর নির্ভর করতে হয়; এর কোনো মানে আছে? প্রয়োজন আর যৌক্তিতা দিয়ে কিছু যে হচ্ছে না, তাই তো আমাদের দেশ। দেশে পুলিশের সংখ্যা কত; কী কী সুধিধা আছে তাদের! সাড়ে তিন লাখ প্রাথমিক শিক্ষকের জন্য এ জাতি কী কী করেছে? গুরুত্ব বিবেচনায় প্রাথমিক শিক্ষাকে অবহেলা করার উপায় নেই। তাই প্রাথমিক শিক্ষায় আলাদা শিক্ষা বোর্ড এবং কারিকুলাম বোর্ডও হওয়া চাই।
মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর ভিন্ন না হওয়ায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। সময়মতো পদপূরণ হয় না, নেই নিয়মিত পদোন্নতি। নামে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর হলেও মাধ্যমিক শিক্ষাকে অধিদফতর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দেখে যেন (একজন ডিজিকে জেলা শিক্ষা অফিসারের সঙ্গে যে আচরণ করতে দেখেছি, সেটি বর্ণনা করা অসম্ভব)। সরকারি কলেজের শিক্ষক দিয়ে অধিদফতরটি ঠাসা। মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর সৃজন করার প্রস্তাব কেন আটকে আছে, তা-ও এক প্রশ্ন। কোনো এক কাগজে দেখেছি, শিক্ষা ক্যাডারের জন্য বারবার আটকে যায়। সত্য হলে বুঝতে অক্ষম যে, কলেজ শিক্ষকদের মাধ্যমিক শিক্ষা ধরে রাখতে হয় কেন! মাধ্যমিক শিক্ষার বিভাগীয় উপপরিচালক পদেইবা কেন কলেজের শিক্ষকরা যেতে আগ্রহী? আর আমাদের শিক্ষকদের আগ্রহ শিক্ষকতার চেয়ে শিক্ষা প্রশাসনের পদের প্রতি বেশি; সেটাইবা কেন! অধ্যাপনার চেয়ে ডিজি হওয়া পছন্দের কেন? কিংবা অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ এবং কলেজে অধ্যাপনা রেখে আগ্রহ বোর্ডের চেয়ারম্যান-কন্ট্রোলার পদের দিকে কেন?

টেক্সট বুক বোর্ডে একটি পদ পেতে মরিয়া হয়ে যান আমাদের শিক্ষকরা। সম্ভবত বাড়তি গুড় কিংবা মাখন-পনির আছে ও-সব পদে। হয়তো সে কারণে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিফতর হচ্ছে না-অন্যেরটা ধরে রাখার প্রবণতা এখানে মুখ্য নিয়ামক। কিন্তু সরকার তা মানছে কেন? আদতে, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর শুধু কলেজ নিয়ে ব্যস্ত; তাও সরকারি কলেজ। অন্যদিকে শিক্ষা ক্যাডারের সঙ্গে একটা অযৌক্তিক আচরণ করা হচ্ছে। অধ্যাপক পদটি কেন তিন নম্বর গ্রেডের হবে না; এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদ তৃতীয় গ্রেডের। মেডিক্যাল কলেজেও তাই। কেবল পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের দ্বিতীয়-প্রথম গ্রেডে যাওয়ার অবারিত সুযোগও আছে। কয়েকটি ক্যাডারে এক-নম্বর গ্রেডের পদ সৃষ্টি হলেও ক্যাডারের সদস্যসংখ্যা বিবেচনায় কৃষি-স্বাস্থ্য-শিক্ষায় অনেক কম দেয়া হয়েছে, একটি বা দু’টি-এটি প্রত্যাশিত নয়। এ সমস্যার দ্রুত সমাধান হওয়া জরুরি। শিক্ষক থেকে উপযুক্ত সেবা পেতে হলে তাদের যৌক্তিক সমস্যার সমাধান করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। শিক্ষক দিবসে বক্তাদের মুখে যা শোনা যায়, তার কিছু বাস্তবায়িত হলে শিক্ষকরা যথার্থ অর্থে জাতির মেরুদণ্ড হয়ে উঠতে পারবেন।
ভালো মানের শিক্ষার জন্য ভালো শিক্ষকের বিকল্প কোথায়? এ পর্যায়ের প্রথম নিবন্ধে বলেছিলাম, সরকারি প্রাথমিকে আমরা কাদের নিয়োগ দিচ্ছি এবং তার ফলটি কী। দেখিয়েছিলাম, সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা গণিত ও ইংরেজি না শিখে মাধ্যমিক স্কুলে আসে এবং হাইস্কুলগুলোর কোনো দায় নেই তা পুষিয়ে দেয়ার; তাদের সে সময় কোথায়! তাই এসএসসিতে অকৃতকার্যদের অধিকাংশ এই গণিত আর ইংরেজিতে। কিন্তু মাধ্যমিকেও কি ভালো শিক্ষক নেয়া হচ্ছে? সরকারি মাধ্যমিকের-উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষক নিয়োগ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের হাতে বলে ভরসা করা যায়। গোলমালটা হচ্ছে বেসরকারি কলেজ, মাধ্যমিক বিদ্যালয় আর মাদরাসায়। একদা জেলা শহরের স্কুলগুলোর সভাপতি ছিলেন মধ্যগোছের আমলারা। মন্দের ভালো ছিল-শতকরা আশি ভাগ ভালোরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতেন। মাদরাসার সভাপতি ছিলেন ইউএনও। ব্যতিক্রম ছাড়া পরীক্ষায় প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয়রা চাকরি পেতেন। নাহিদ জমানায় তা তুলে দিয়ে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটির প্রধান করা হয়। কয় বছর আগে নবম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষায় নকল করার দায়ে বহিষ্কৃত হয়ে আর স্কুলমুখো হননি, তিনি-ই কিনা এখন সভাপতি হয়ে তার প্রধান শিক্ষকের পাশের চেয়ারে বসে সভা করছেন। এ রকম চিত্র বহু।

নানা কিসিমের মানুষ হরেক মতলবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটির সভাপতি হয়েছেন। আর এতে ধস নেমেছে শিক্ষক নিয়োগে। নিয়োগ হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। বিক্রি হয়েছে শিক্ষকের চাকরি। আবার ওই শিক্ষামন্ত্রী সংসদে বলেছেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বর্তমান কমিটি ভালো শিক্ষক নিয়োগে চরম ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু পরিবর্তন করে যাননি তিনি। ওই সময়ে নিয়োগকৃতরা আগামী তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে না পারলেও উচিত শিক্ষা দিতে কসুর করবেন না, এ-কথা হল্ফ করে বলা যায়। এ কথা বলছি না যে, রাজনীতিকদের মধ্যে ভালো মানুষ নেই। কিন্তু তাদের ক’জন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটির প্রধান হতে পেরেছেন?
উচ্চ আদালতের আদেশে কতিপয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতির পদ ছাড়তে হয়েছে রাজনীতিকদের। আমরা ভালো কিছুর অপেক্ষায় থাকব। অন্যদিকে এনটিআরসিও একটি যোগ্যতার পরীক্ষা নিলে কেবল সরকারি টাকা পাওয়া যাবে-আশার কথা বটে। কিন্তু শিক্ষক নিয়োগে আলাদা কমিশন করতে সমস্যা কোথায়! পরীক্ষায় বোর্ড, কারিকুলামে বোর্ড, প্রশিক্ষণে একাধিক প্রতিষ্ঠান, নির্মাণে ভিন্ন অধিদফতর, সব আছে। এ সরকার একাধিক কমিশন করেছে আর সেটা প্রয়োজন আছে বলেই। শিক্ষক নিয়োগের মতো একটি জনগুরুত্বপূর্ণ কাজে কেন কমিশন করা হচ্ছে না? আমরা অপেক্ষাকৃত মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে পেতে চাই। এও চাই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের পদ দ্রুত পূরণ হোক। চাই তো, আমাদের আগামী প্রজন্ম উচিত নয়, উপযুক্ত শিক্ষা পাক।
এমপিওর নামে এখন সব বেসরকারি মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, মাদরাসা এবং কারিগরি ও ভোকেশনালে সরকার অর্থ জোগাচ্ছে; কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেঁটে দিয়ে অথবা কিছু অর্থ বাড়িয়ে দিয়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি খাতায় নিলেই তো হয়। আপত্তি কোথায় এবং কেন, কেউ বলবেন? উপজেলা সদরগুলোতে স্কুল-কলেজ সরকারি হয়ে গেছে, কিছু বাদ থাকলেও সরকারীকরণের প্রক্রিয়ায় আছে। এ সরকারীকরণের মূল উদ্দেশ্য হলো, শিক্ষার মান উন্নয়ন, ভালো শিক্ষক দিয়ে ছেলেমেয়েদের উপযুক্ত ও আধুনিক শিক্ষা দেয়া; তাহলে উপজেলার বাইরের জনগোষ্ঠীকে এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা কেন?
পরের প্রশ্ন, এ বিপুলসংখ্যক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে, মাদরাসায় ও মাধ্যমিক কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমাদের পড়–য়ারা ঠিকঠাক শিখছে তো? একাদশ শ্রেণীতে যাওয়ার আগে যতটা জানার কথা, শেখার কথা; তা কতভাগ ছেলেমেয়ে জেনে উচ্চমাধ্যমিকে যাচ্ছে? কিংবা কারিগরি ও ভোকেশনালে যা শেখানোর কথা, তা কতটা হচ্ছে?
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব ও কথাসাহিত্যিক


আরো সংবাদ



premium cement