চাই আধিপত্যমুক্ত নতুন বাংলাদেশ
- প্রফেসর ড. মো. আবুল কালাম আজাদ
- ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০৫
পৃথিবীতে অনেক নেতা কেবল দেশপ্রেমিক হওয়ার কারণে নিজের জাতির কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন। এসব নেতার কাছে তার দেশ ও দেশের নাগরিকদের স্বার্থই অগ্রাধিকার পায়। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত পৃথিবীতে বাংলাদেশ নামে কোনো ভূখণ্ড ছিল না। এখন যে অংশটুকু নিয়ে বাংলাদেশ, তা ১৯৪৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান নামে ভারতের পেটের ভেতর ছিল। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ভারতবর্ষ ভাগ হলে এই অংশটুকু পাকিস্তানের পেটে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। ফলে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্র বিশ^ মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের দূরত্ব প্রায় ১২০০ মাইল, যা আবার তিন দিকে ভারত ও অন্যদিকে মিয়ানমার দ্বারা পরিবেষ্টিত। এরকম ভৌগোলিক ভাগাভাগি পৃথিবীতে বিরল। জাতিগতভাবে ৯৮.৭ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানির চেহারা একই রকম। প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ একই ধর্মে বিশ^াস করে, কমপক্ষে ৯৮ ভাগ মানুষ বাংলায় কথা বলে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানকে একটি করিডোর হিসেবে ট্রিট করত বিধায় এ অংশের মানুষের প্রতি তাদের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বৈষম্যমূলক। সেজন্য শোষণ, বঞ্চনা, জেল-জুলুম, গণগ্রেফতার, প্রতারণা ছিল পূর্ব পাকিস্তানিদের কপাল লিখনের মতো। ফলে এই অংশের মানুষরা ১৯৪৭-১৯৭১ পর্যন্ত তাদের ২৪টি বছর কাটিয়েছে মৌলিক অধিকার, যেমন কথা বলার স্বাধীনতা, শিক্ষার সুযোগ, ন্যায়বিচার ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে। এসব আন্দোলন সংগ্রামে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।
১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী ১৯৭০ সালটি ছিল পাকিস্তানের অখণ্ডতা থাকবে কি না তার নির্ধারক সময়কাল। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এককভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের ম্যান্ডেট পেলেও, ক্ষমতা না দিয়ে যুদ্ধ চাপিয়ে দিলো পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। যে দলটির নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ চলার কথা ছিল, সেই দলের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান আত্মসমর্পণ করে প্লেনে চড়ে চলে গেলেন পাকিস্তানে। আর তার দলের ২৫১ জন এমএনএ (মেম্বার অব ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি) ও ২৬৭ জন এমপিসহ দলের সব সদস্য শরণার্থী হিসেবে ভারতে চলে গেলেন। এদিকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ রাতে বাঙালি জাতির ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তখন মেজর জিয়াউর রহমান ‘উই রিভোল্ট’ বলে প্রথমে সাধারণ সৈনিক ও ইপিআর সদস্যদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পরে ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ডাক দিয়ে এ দেশের লাখ লাখ তরুণ, কৃষক, মেহনতি মানুষসহ সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ করেন। মেজর জিয়ার আহ্বানে সবাই যার যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধ করল কিন্তু ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা গঠন করল মুজিববাদী গেরিলা সংগঠন, যারা এই দেশের মুক্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করল না। মুক্তিযুদ্ধে ভারত প্রত্যক্ষ সহায়তা করায় মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে অসংখ্য শহীদের তাজা রক্তে ও দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভ করে। জাতি স্বাধীনতা পেয়েছে, তবে ভৌগোলিক অধিকার রয়ে গেল আধিপত্যবাদীদের কব্জায়। কারণ আধিপত্যবাদীদের কথায় আমাদের পরিচয় দাঁড়ায় আমরা বাঙালি, মানে এপার-ওপার বাংলার, বাংলায় কথা বলা সবাই এক জাতি। বিষয়টি দাঁড়াল, আমরা ঠিক ১৯৪৭ এর পূর্বে ফিরে গেছি। পাকিস্তান আমলে আমাদের আইডেনটিটি ছিল আমরা মুসলিম। কাজেই আমাদের মুসলিম আইডেনটিটি মুছে দেয়ার জন্য তারা ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি সংযুক্ত করে দিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশটাকে পুরো মুসলিম বিশ^ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
এরপর তারা শেখ মুজিবকে দিয়ে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ একটি নির্বাচন করায়, যাতে জনগণের ভোটের কোনো মূল্য থাকে না। তাদের সাথে ২৫ বছরের গোলামি চুক্তির বদৌলতে সামরিক বাহিনীর স্থলে মুজিববাদী গেরিলাদের দিয়ে গঠন করা হয় রক্ষীবাহিনী। লাখ লাখ সশস্ত্র যুবকের সমন্বয়ে গড়ে তুলল যুবলীগ, যা হয়ে উঠল লালবাহিনী নামক আরেক আতঙ্ক। পাড়া-মহল্লায় বিভিন্ন নামে বেনামে সন্ত্রাসী সংগঠন গঠিত হলো। এসব বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তিগত লাভ আর শেখ মুজিবকে অবতার বানানো। দেশ হয়ে গেল মৃত্যুপুরী, দুর্ভিক্ষে প্রায় ১০ লাখ মানুষ মরল। এসব কিছু ধামাচাপা দেয়ার জন্য মাত্র চারটি সংবাদপত্র রেখে বাকি সব বন্ধ করা হলো, মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করে সব ধরনের নিবর্তনমূলক আইন জারি করল। সবশেষে সব দল নিষিদ্ধ করে আজীবন ক্ষমতায় থাকার জন্য বাকশাল গঠন করল। দেশটাকে ব্যক্তিগত রাজ্যে রূপান্তর করল যার মালিক হলেন স্বয়ং শেখ মুজিব আর দেশের সবাই হয়ে গেল তার গোলাম বা প্রজা। দেশটা হয়ে গেল আধিপত্যবাদীদের চারণভূমি। ঠিক এমন একটি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায়, দেশটাকে আধিপত্যবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করতে দেশপ্রেমিক কিছু মুক্তিযোদ্ধা আর্মি অফিসার ও রাজনৈতিক নেতার প্রযোজনায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব ও তার পরিবারের প্রায় সব সদস্য নিহত হন। দেশ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে তাই ৭৯ দিন পর (৩ নভেম্বর ’৭৫) ভারতপন্থী সেনাবাহিনীর গ্রুপ খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একেবারে রক্তপাতহীন আরেক অভ্যুত্থান ঘটাল এবং আর্মির প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে হাউজ অ্যারেস্ট করল। জাতি অবাক হয়ে দেখল একটি দেশ চলছে যেখানে কোনো সরকার নেই, শৃঙ্খলা নেই, আছে কেবল বিভেদ। এমন দিশাহীন জাতিকে সত্যিকার নেতৃত্ব উপহার দেয়ার জন্য সব স্তরের আর্মি ও জনতা বুকে বুক রেখে, হাতে হাত রেখে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ৭ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের কারাগার থেকে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে তার হাতে তুলে দিলেন দেশের নেতৃত্ব। সেদিন থেকেই জিয়াউর রহমান তার প্রখর মেধা, সাহসিকতা, সততা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি আপসহীনতা, উৎপাদন ও উন্নয়নের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করার রাজনীতি এবং সর্বোপরি সমগ্র জাতি গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করা ও ধরে রাখার জন্য সামনে নিয়ে এলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নামক দর্শন। যে দর্শনের জন্য এই জাতি পেল আত্মপরিচয় (বাংলাদেশী), স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং আত্মনির্ভরশীল নতুন এক বাংলাদেশ। জিয়াউর রহমান হয়ে উঠলেন সর্বস্তরের মানুষের প্রিয় নেতা। সে সময় প্রতিবেশী দেশটির সাথে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি দাঁড়ায় উইন-উইন সিচ্যুয়েশনে, যাতে আধিপত্যবাদীদের মাথা আবার নষ্ট হয়ে গেল। তারা জেনারেল এরশাদকে দিয়ে নকল বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রচলনের চেষ্টা করল দীর্ঘ ৯ বছর। ১৯৯১ থেকে ২০০৬ যত চড়াই উৎরাই থাকুক, বাংলাদেশ দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু ২০০৯ সালের পর থেকে দেশ আবারো চলে যায় আধিপত্যবাদীদের আশ্রয়ে, যেখানে একটি রাষ্ট্র হয়ে ওঠে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতীক। মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়, লুটপাট আর অর্থ পাচারের মাধ্যমে দেশটাকে ফোকলা করে ফেলা হয়।
এ রকম অবস্থায় ‘জুলাই-৩৬’-এর অভ্যুত্থানে ১৫৮১ জনের মৃত্যু, ১৯ হাজার আহত, ৬৪৭ জনের দৃষ্টিশক্তি হারানোর বিনিময়ে জাতি সিন্দাবাদের ভূত ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলে আবারো ফিরিয়ে আনল নতুন বাংলাদেশ, যা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ দর্শন ধারণ করে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনেপ্রাণে বাঙালি। তারা এপার-ওপার বাংলায় বিশ^াসী দল। অন্য দিকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী দল দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের দল, যাদের অন্তরে শুধুই বাংলাদেশ। এ দল দাসত্বে বিশ^াস করে না। এই স্বাধীন চিন্তা আধিপত্যবাদীদের পছন্দ নয়। তাদের দরকার সিকিমের লেন্দুপ দর্জির মতো শাসক যেমনটা গত দেড় দশক ধরে এ দেশে ছিল।
দেশের মুক্তিকামী ছাত্র-জনতাই হলো সাচ্চা জাতীয়তাবাদী এবং তারা সত্যিকার জাতীয়তাবাদী দল চিনতে ভুল করবে না। আশা করি, দেশপ্রেমিক সাচ্চা জাতীয়তাবাদী এক পরিবার হয়ে আধিপত্যবাদের সব আগ্রাসন ও প্রোপাগান্ডা রুখে দিয়ে বৈষম্যমুক্ত নতুন বাংলাদেশকে বিশে^র বুকে তুলে ধরবে।
লেখক : অধ্যাপক, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা