০২ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ পৌষ ১৪৩০, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৫
`

আধিপত্যবাদের বাংলাদেশবিরোধী বিষোদগার

-


উপনিবেশ হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম হওয়ায় বেসামাল হয়ে পড়েছে আধিপত্যবাদী দেশ ভারত। এখানে কোনো ডান-মধ্য-বাম নেই। বাংলাদেশ প্রশ্নে সব ভারতীয়ই এক। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিষোদগারে শামিল হয়েছেন পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও। বলেছেন, দিল্লির উচিত বাংলাদেশে জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর অনুরোধ জানানো। কারণ তার ভাষায়- বাংলাদেশে যে সঙ্ঘাতের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তা সামাল দেয়ার সামর্থ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেই। অথচ তার শহর কলকাতায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় আগুন ধরানো হয়েছে। পরে আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, দূতাবাসের বাংলাদেশী কূটনীতিকদের সাথে দুর্ব্যবহার ও হামলার দৃশ্য। বাংলাদেশ এই রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট দুর্বৃত্তদের হামলার কঠোর প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু গণদাবি হচ্ছে- ভারতীয় আধিপত্যবাদের এই ধৃষ্টতার প্রতিরোধ করা। বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য পুরোপুরি বর্জন করা। ভারত ছাড়া অন্য কোনো চিকিৎসা গন্তব্য খুঁজে বের করা এবং বাংলাদেশের সব ন্যায্য দাবি আদায়ে ভারতের উপর সর্বোচ্চ চাপ অব্যাহত রাখা। সোজা আঙুলে ঘি কখনো ওঠেনি, উঠবেও না। এ জন্য চাই অন্তর্বর্তীকালীন কর্তৃপক্ষের সুদৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার।

এটি স্পষ্ট যে, ভারত চিরকালই বাংলাদেশের শত্রু। এই শত্রুরা ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা ও দেশ বিভাগের আগে থেকেই ছিল। ১৯৭১ সালে তারা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সুযোগ নিয়ে তথাকথিত বন্ধুর ভেক ধরে। এরপর গত ৫৩ বছর ধরে ভারত ব্যবসায়-বাণিজ্য, কূটনীতি-অর্থনীতি-অর্থপাচার, প্রতিরক্ষা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা সর্ব ক্ষেত্রে আগ্রাসী আচরণের পরিচয় দিয়েছে। গত ১৬ বছরের হাসিনার স্বৈরাচারী আমলে তারা একেবারেই যেন পেয়ে বসে। শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, পাকিস্তান এমনকি নেপালেও তারা ‘উষ্টা’ খেয়ে বাংলাদেশকে পরিণত করে উপনিবেশবাদের নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্তে। কারণ, স্বৈরাচারী হাসিনার শাসন ছিল ভারতীয়করণেরই সম্প্রসারণ।
ভারতীয় আধিপত্যবাদ ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা ও দেশ বিভাগের সময় পূর্ববাংলার মানুষকে চরমভাবে ঠকিয়েছে। এর আগে ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন যখন প্রশাসনিক সুবিধার্থে পূর্ববাংলা ও আসামসহ ঢাকাকে রাজধানী করে পৃথক পূর্ববাংলা প্রদেশ গড়েন, তার বিরুদ্ধে তথা বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলনে তারা আদাজল খেয়ে লাগে। বিশ্বকবির বঙ্গপ্রীতি উথলে ওঠে। শুরু হয় ছলনার রাখিবন্ধন। উদ্দেশ্য ছিল পূর্ববাংলা বা আজকের বাংলাদেশের উপর বাবু সমাজের জমিদারগিরি চালিয়ে যাওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের বিরুদ্ধে তারা একই কারণে অবস্থান নেয়। অথচ তারাই ১৯৪৭-এ ভারত থেকে পূর্ববাংলাকে পৃথক করার ষড়যন্ত্রে পৌরহিত্য করে। মুসলিম লীগ বা সেই অর্থে কায়েদে আজম জিন্নাহ বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশ বিভক্ত করার আগাগোড়া বিরোধিতা করে এসেছেন। দেশ যখন ভাগ হয়েই গেল, তখন সম্পদ-সম্পত্তির ন্যায্য বখরা থেকে তারা পূর্ববাংলাকে নিদারুণভাবে ঠকায়। এই ঠকানোর কাজে কংগ্রেস-আরএসএস-হিন্দু মহাসভা সব ভারতীয় মহাজনরা এক ও ঐক্যবদ্ধ ছিল, যেমনটি আছে আজও। শেখ মুজিব হকদার ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার, তাকে ষড়যন্ত্রের চোরাপথ দিয়ে আগরতলায় ডেকে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চক্রান্ত পাকায় ভারত (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা)।

১৯৭১-এর মার্চ মাসে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে স্বেচ্ছা কারাবরণ করে পাকিস্তানে চলে যান। সেই নেতৃত্বশূন্যতার সুযোগে ভারত তার পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ড ও বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি রাখে এবং চক্রান্ত করে সংখ্যালঘুদের ভারতের সীমান্ত গলিয়ে শরণার্থী সঙ্কট সৃষ্টি করে বিশ্বকে বিভ্রান্ত করে। ভারত আমাদের স্বাধীনতা সেনানী, ৯৮ জন কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরভিত্তিক ও অগণিত গেরিলা যোদ্ধার বিপরীত একজন ভারতীয় পদস্থ সেনা কর্মকর্তাকে (জেনারেল উবান) দিয়ে মুজিব বাহিনী বা বিএলএফ সৃষ্টি করে, যাতে মুক্তিযুদ্ধ তাদের কব্জায় থাকে এবং বাংলাদেশ বাহিনীর বাইরের কেউ অর্থাৎ ভাসানী-ন্যাপের নেতাকর্মী, বামপন্থী দল-উপদল, স্থানীয় পর্যায়ের মুক্ত চিন্তার পেশাজীবীরা কেউ মুক্তিযুদ্ধের ত্রি-সীমানায় ঢুকতে না পারে। এ সবের উদ্দেশ্য ছিল গোড়াতেই জাতীয় ঐক্য শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলা এবং মুক্তিযুদ্ধকে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র বন্দোবস্তের মধ্যে রাখা। বাধ্য হয়ে আওয়ামী বিরোধীরা স্যান্ডউইচের মতো চ্যাপ্টা হয়ে নিজেরাই ক্ষুদ্র সামর্থ্য দিয়ে পাক বাহিনীর মোকাবেলা করতে থাকে এবং বেঘোরে প্রাণ হারায়। আশ্চর্যের কথা, গত ৫৩ বছরেও মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বীর বামপন্থী সেনানীদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা কোনো নাটক-নভেল, তথ্যচিত্র, স্মৃতিগ্রন্থ বা নিদেন প্রবন্ধ-নিবন্ধ আকারেও প্রকাশ করতে দেয়নি ভারত নিয়ন্ত্রিত আওয়ামী শাসিত বাংলাদেশে। এরা মোকাবেলা করেছেন একদিকে পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের, অন্যদিকে ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের এবং আরো একদিকে তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে সৃষ্ট উপদলীয় বিভেদ-বিভাজনের। এদের নিঃস্বার্থ আত্ম বলিদানের করুণ উপাখ্যান একাকার হয়ে গেছে আওয়ামীবিরোধী সব স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাথে।

শেখ মুজিব দেশে ফিরেই স্বাধীনতা এবং জাতীয় ঐক্যের গোড়ায় কুঠারাঘাত করলেন। তিনি বামপন্থীদের বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। অথচ এই বামপন্থীরাই ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন বর্জন করে আওয়ামী লীগকে মাঠ ফাঁকা করে ওয়াকওভার দিয়েছিল। তাদের এই ত্যাগের কথা কোনো দিন মুখেও আনেনি আওয়ামী লীগ। তিনি সবাইকে বাঙালি হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে পার্বত্য জেলার উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মন বিষিয়ে দিলেন। তারা বলল, আমরা বাংলাদেশী; তবে বাঙালি নই। আমাদের রয়েছে পৃথক উপজাতীয় সত্তা, আমাদের সংস্কৃতি, জীবনাচার আলাদা। সেই থেকেই পাহাড়ে আগুন জ্বলছে। ভুলে গেলে চলবে না, স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে ভারতীয় বাহিনী এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রক্ষীবাহিনী পার্বত্য উপজাতিগুলোর উপর অকথ্য গণনির্যাতন এবং গণহত্যা পরিচালনা করে। এখানেও রয়েছে ভারতীয় আধিপত্যবাদের সুদূরপ্রসারী নীলনকশা। সেই ষড়যন্ত্রের সুড়ঙ্গ পথ দিয়েই ভারতীয় আধিপত্যবাদীরা এখন চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে ফারাক করার দিবাস্বপ্ন দেখছে। তাদের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ খোয়াব চিরদিন অপূর্ণই থেকে যাবে। যারা মোগলদের ভয় পায়নি, ব্রিটিশের কাছে মাথানত করেনি, পাকিস্তানিদের হাতে গোনেনি, তারা ভারতের মুখভেঙচি সহ্য করবে না। ভারতের এমন আগ্রাসী খোয়াবের মুখে লাথি মেরে নেপাল এর মধ্যেই তার নিয়তি স্থির করে ফেলেছে; এমনকি ভুটানও নেপালের দেখাদেখি চীনের সাথে সম্পর্কের নতুন বিন্যাস উন্মুক্ত করেছে। শেখ হাসিনা যেমন কিয়ামত পর্যন্ত বাংলাদেশ পুনর্দখলের মোহ ত্যাগ করেছে; তার মহাজন ভারতীয় শাসকরাও তেমনি কোনো দিনই আর বাংলাদেশের মানুষের স্বাভাবিক সম্পর্কের সদিচ্ছা ফেরত পাবে না।

ভারতের অবস্থান, পণ্য, সেবা ও সমরনীতির আগ্রাসী চরিত্র সবসময়ই বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্য সংহতি এবং দেশপ্রেমের উজ্জীবক। ঠিক এই কথাটিই বলে গেছেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের রূপকার সাংবাদিক-কলামিস্ট খন্দকার আব্দুল হামিদ, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়া, জনপ্রিয় রাষ্ট্রনেতা বেগম খালেদা জিয়া, সব দেশপ্রেমিক বাংলাদেশী বিবেকবান মানুষ। বিশেষ করে এ জাতির আশা-ভরসার স্থল সংগ্রামী ছাত্র-তরুণ-যুবক এবং এদেশের স্বাধীনতার প্রতীক বীর সশস্ত্রবাহিনী সদস্যরা। তাদের বীরত্বগাথা উপমার মতো হয়ে আছে মোগলদের বিরুদ্ধে বাংলার বারো ভূঁইয়াদের প্রতিরোধে, ফকির বিদ্রোহে, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লায়, হাবিলদার রজব আলীর স্বাধীনতা সংগ্রামে, নীল বিদ্রোহে, ১৭৫৭-এর পলাশী যুদ্ধে, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহে, ব্রিটিশবিরোধী অসংখ্য যুদ্ধে, ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে এবং সর্বশেষ ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টের মহান ছাত্র-জনতা-সিপাহি বিপ্লবে।

আরএসএস, হিন্দু মহাসভার সন্তান মোদির হিন্দুত্ববাদী চানক্যেরা বীর বাঙালির এই অসীম বীরত্বগাথা সম্পর্কে বেখবর থাকলেও একাত্তরে এটি ঠিকই বুঝেছিলেন ভারতের সেনাপতি ফিল্ড মার্শাল ম্যানেকশ। তাই তো সেদিন তিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, এপ্রিল নাগাদ ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে ঢুকলে তাদের পরাজয় ‘শতভাগ নিশ্চিত; আর তাকে ছয় মাস সময় দিলে বিজয় শতভাগ ভাগ নিশ্চিত। ম্যানেকশ জানতেন, সীমিত অস্ত্র নিয়েও বাংলাদেশের বীর সৈনিক ও জনযোদ্ধারা পৃথিবীর অন্যতম দুর্ধর্ষ পাকবাহিনীকে কার্যত নিজেরাই কুপোকাত করতে সক্ষম হবে। সেটিই ঘটেছিল। ভারত আমাদেরকে সাহায্য দিয়েছিল; তবে এ যুদ্ধটি ছিল বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য বাংলাদেশী বীর সৈনিক ও গেরিলা যোদ্ধাদের রক্তগঙ্গায় ডোবা গণযুদ্ধ। এ যুদ্ধের নায়ক বীর বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা ও সেনা, নৌ এবং বিমান বাহিনীর বাঙালি বীর সদস্য ও তাদের দ্বারা প্রশিক্ষিত দেশপ্রেমিক বীর ছাত্র-শ্রমিক-জনতা। আওয়ামী লীগাররা কলকাতায় নিরাপদে বসে আমোদের গা ভাসিয়ে ৯ মাস পার করেছে।
ভারতীয় আধিপত্যবাদ জানে সেদিন কাদের কী ভূমিকা ছিল। কারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের চরণে তুলে দিতে চেয়েছিল আর কারা দিনে একটি কাঁঠাল ভাগ করে খেয়ে, প্রাণপণ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। ভারতীয় এবং ভারতীয় বশংবদদের মুক্তিযুদ্ধে কৃতিত্ব তুলে দিয়ে আসলে বীর শহীদদের সাথে বেঈমানি করা হয়েছে।

 

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement
পাথরঘাটায় যুবদল নেতাকে হত্যার ঘটনায় ছাত্রশিবিরকে অভিযুক্ত করায় নিন্দা চট্টগ্রামে ডিসি পার্কে শুরু হচ্ছে মাসব্যাপী ফুল উৎসব শিক্ষকতাকে প্রথম শ্রেণীর পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে : সমন্বয়ক হাসনাত আ’লীগ নেতা বলরাম পোদ্দারকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ গাজীপুরে কেয়া গ্রুপের চার কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা সমবায় ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মহির স্ত্রী নুরজাহানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা হিন্দুদের জন্য চাকরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে দাবি নাকচ প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের আশুলিয়ায় নিখোঁজের ৬ দিন পর যুবকের লাশ উদ্ধার ইসরাইলি হামলায় গাজা পুলিশের প্রধান ও উপ-প্রধান নিহত ৪৩তম বিসিএস থেকে বাদপড়া ২২৭ জন প্রসঙ্গে যা জানাল সরকার সিরাজ সিকদার-আবু সাইদ হত্যা একই সূত্রে গাঁথা : রাশেদ প্রধান

সকল