২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস : সত্য উদঘাটন হোক

-

স্বাধীনতার ৫৩ বছর ধরে সময়ের ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর ফিরে আসে। এ দিনটি এগিয়ে এলেই বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে এক ধরনের ব্যস্ততা দেখা দেয়। এ ব্যস্ততার মূলে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান, মসজিদ, গির্জা, মন্দিরসহ অন্যান্য উপাসনালয়ে বিশেষ দোয়া ও প্রার্থনার ব্যবস্থা; বিকেলে বিদগ্ধ সুধীজনের আলোচনা, এভাবেই পালিত হয়ে আসছে দিনটি। বিভিন্ন ধরনের আলোচনায় মূলসুর একটিই- বাংলাদেশকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পঙ্গু করে দেয়ার জন্য পরাজিত হওয়ার পূর্বক্ষণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বেছে বেছে অপহরণ করে হত্যা করে। যেন জাতি ভবিষ্যতে এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে, দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার গ্লানিতে ভোগে। স্বাধীনতার পর থেকেই এই একই বয়ান জাতির সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি ভালোবাসা শ্রদ্ধা স্বাভাবিকভাবেই জাতির দায়বোধের প্রকাশ। এই দায়বোধ আরো অর্থবহ হতে পারত এ দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন অথবা জাতীয় শোক দিবস হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে। অপ্রয়োজনীয় বহু দিবস উদযাপনের মধ্যে এ রকম একটি দিবস পালন করার ঘোষণার দাবি সঙ্গত হতো। অথচ আজ ৫৩ বছর ধরে এভাবেই অনেকটা গতানুগতিকভাবে পালিত হয়ে আসছে দিনটি নিতান্তই দায়সারাভাবে। এখন সময় এসেছে শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রকৃত ঘটনাবলি, সঠিক ইতিহাস রচনার উদ্দেশ্যে বের করে আনা জাতীয় প্রয়োজনেই। প্রথমত, এটি পরিষ্কার হওয়া দরকার, বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রকৃত সুবিধাভোগী কে? বিজয়ের মাত্র দুইদিন আগে যখন পাকিস্তানি সৈন্য এবং তার সহযোগীদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য, আশ্রয়ের জন্য পাগলপারা অবস্থা; তখন তারা নিজের প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করবে নাকি বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য তাদেরকে বাড়ি বাড়ি খুঁজে বেড়াবে? দ্বিতীয়ত বাংলাদেশ মেধাশূন্য হলে কার লাভ? নিশ্চয়ই স্মরণ থাকার কথা তৎকালীন দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত সংবাদ, বিজয় দিবসের পরপরই পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা পূর্ব ভারতীয় হাইকমিশনার জনাব ডিপি ধর সাহেব প্লেন বোঝাই করে ভারতীয় আইসিএস অফিসার নিয়ে হাজির হয়েছিলেন পাকিস্তানি অফিসাররা চলে যাওয়ায় আধিকারীকদের শূন্য পদগুলো পূরণের জন্য। একইভাবে বিজয় দিবস পরবর্তী সময়ে প্রতিবেশী দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, নাট্যকার এবং অন্যান্য বিশেষ ব্যক্তিদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছিল এ দেশের অঙ্গন। বাংলাদেশ থেকে স্বাস্থ্যসেবার জন্য ভারতে যাওয়ার দুয়ার খুলে যায় তখনই। ব্যবসায়-বাণিজ্যের একতরফা সুবিধা প্রাপ্তির শুরু তখন থেকেই। আদমজীসহ অন্যান্য পাটকল যখন এপাশে আগুনে দাউদাউ করে জ্বলছিল, ওপারে তখন নতুন নতুন পাটকলের যাত্রা শুরু। বাংলাদেশের সিনেমা হলগুলোতে শুরু হয় প্রতিবেশী দেশের চলচ্চিত্রের অবাধ রাজত্ব। যৌথ প্রযোজনার নামে চলচ্চিত্র ধ্বংসের নীল নকশার বাস্তবায়ন শুরু তখন থেকেই। প্রতিবাদী জহির রায়হানকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বিজয়ের দেড় মাস পর গুম করে দায় চাপিয়ে দেয়া হয় পাকিস্তানি দোসরদের কারসাজি হিসেবে। পাকিস্তানিদের ফেলে দেয়া অস্ত্র প্রতিবেশী দেশে পাচারের বিরোধিতা করায় মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলকে করতে হয়েছিল কারাবরণ। এ দেশের মুক্তবুদ্ধির দেশপ্রেমিক মানুষগুলোকে হত্যা করে কাদের লাভ তা আজ ভাবার সময় এসেছে। শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্তের জন্য একটি আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করা প্রয়োজন সঠিক ইতিহাস বের করার স্বার্থে। যে বিষয়গুলো এই কমিটির তদন্তের আওতায় থাকা দরকার সেগুলো হচ্ছে-
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতার সুবিধাভোগী কারা তা বের করা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের মাঠে অসংখ্য শহীদের কবর আছে এই বয়ানের সত্যতা প্রমাণের জন্য ফরেনসিক তদন্ত করা, রাতের ঘন অন্ধকারে পাশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাড়ি থেকে ভিডিও করার বয়ানের বাস্তবতা যাচাই করা ও যেসব সাক্ষী সে সময় বয়ান দিয়েছিলেন সম্ভব হলে সেগুলো পুনঃ বিশ্লেষণ করা। সুষ্ঠু তদন্তের পর পূর্বাপর পরিস্থিতি পরিবেশ বিবেচনাপূর্বক সঠিক ইতিহাস উদঘাটিত হওয়া প্রয়োজন জাতির ভবিষ্যৎ পথচলার স্বার্থেই। এতদিন কেবল একতরফা বয়ানের শুধু এক পাশটাই জাতি শুনেছে। পরিপূর্ণ ময়নাতদন্তের মাধ্যমে ঘটনার বিবরণ উন্মোচন সঠিক ইতিহাস রচনার স্বার্থেই প্রয়োজন।
আজ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মোহমুক্তির সময়, সঠিক ইতিহাস জানার সময়, অতিরঞ্জিত এবং কল্পিত উপাখ্যান থেকে বের হয়ে আসার সময়। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিনটিকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে তাদেরকে জাতীয় বীরের মর্যাদায় অভিষিক্ত করার সময়। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement