খাদ্যশস্য ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ
- ড. মো: মিজানুর রহমান
- ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
কৃষিকাজ প্রাথমিকভাবে পারিবারিক উদ্যোগ হলেও বর্তমানে পারিবারিক খামারের গণ্ডি ছাড়িয়ে বাণিজ্যিক ফার্মিংয়ের দিকে এগিয়েছে। বড় আকারের এবং আধুনিক কৃষিকার্যক্রম উন্নত যন্ত্রপাতি ও কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক জনসংখ্যার সাথে তাল মিলিয়ে পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদনের চেষ্টা করা সম্ভবত কৃষির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
উন্নত বিশ্ব যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খামারে প্রায় ০২ শতাংশ মানুষ কৃষিকাজ করে, তবে প্রতিটি কৃষক ৪০ জনেরও বেশি লোকের জন্য যথেষ্ট উৎপাদন করে। বিপরীতে, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলোতে একজন সাধারণ কৃষক মাত্র চারজনের জন্য যথেষ্ট উৎপাদন করতে পারে। ফলে খাদ্য উৎপাদন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করণীয় নিয়েই আজকের আলোচনা।
কৃষির আধুনিকায়ন
কৃষিতে ‘সবুজ বিপ্লব’ থেকে ‘জিন বিপ্লব’ শুরু হওয়ায় বিশ্বব্যাপী কৃষির উৎপাদনশীলতার জন্য বিজ্ঞানীরা আরো জোরালো, উচ্চ ফলনশীল শস্য জন্মানোর উপায় খুঁজে পেয়েছেন। এ ছাড়াও দরিদ্র দেশগুলোর কৃষকদের কাছে এই উন্নত শস্যের জাত এবং অন্যান্য প্রযুক্তি, যেমন সঠিক সার ব্যবহার নিয়ে আসার আন্তর্জাতিক কর্মসূচি এবং ভিত্তিগুলো এগিয়েছে। এর ফলে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে, গমের ফলন ২০০ শতাংশ, ভুট্টা ১৫০ শতাংশ এবং চালের ফলন ১০০ শতাংশ বেড়েছে। প্রজনন কৌশল সবুজ বিপ্লবকে উৎসাহিত করে। ক্রমবর্ধমান বিশ্ব জনসংখ্যা বৃদ্ধির আলোকে, জৈবপ্রযুক্তি বিশ্বকে খাওয়ানোর অন্যতম উপায় হয়ে উঠছে; খাবার আরো পুষ্টিকর করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে অনাবাদি জমিতে ফসল রোপণ করা হয়। নিবিড় ক্রপিং প্রবণতার মাধ্যমে যেকোনো জায়গায় আরো গাছপালা বৃদ্ধি করা যায়। একই সাথে উন্নত শস্যের জাত এবং আরো দক্ষ সার ও সেচ পদ্ধতি কৃষকদের এটি অর্জনে সহায়তা করছে।
কীটনাশকের ব্যবহার উদ্ভিদ ও প্রাণীর রোগ এবং কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করে। কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের জন্য ন্যূনতম পরিমাণে রাসায়নিক ও প্রাকৃতিক পদ্ধতির মাধ্যমে সমন্বিত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা একটি কাক্সিক্ষত নিয়ন্ত্রণ কৌশল। আগাছা মারার জন্য রাসায়নিকের ব্যবহার অনেক শ্রম বাঁচিয়েছে। ফসলের ফলন বাড়িয়েছে। রাসায়নিকের ব্যবহার ছাড়া প্রাকৃতিক উপাদানে উদ্ভিদের রোগবালাই দূর করা হচ্ছে। সার, চুন ও কীটনাশকের উন্নতি ১৯৪০ সাল থেকে খামারের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রক্রিয়াজাতকরণের অবশিষ্টাংশ জৈবসার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
গত অর্ধশতাব্দীতে কৃষকরা মাটি ও পানি ব্যবস্থাপনায় দক্ষ হয়ে উঠেছে। জমির উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য কৃষি গবেষণা বায়ো-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। এ প্রযুক্তির ফলে শুষ্ক জমিতে বা লবণের জলাভূমিতে ফসল জন্মানো সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের কৃষি ও শস্য
বাংলাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। দেশের কর্মসংস্থানের ৪০ শতাংশের বেশি কৃষি খাতে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর জনসংখ্যা ১৮ কোটি হলেও খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতার কাছাকাছি। কৃষি এখন অনেকের আয়েরও উৎস। কৃষির এই উন্নয়নের জন্য কৃষক যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কৃষি গবেষণা ও সম্প্রসারণও গুরুত্বপূর্ণ; সরকারেরও সহযোগিতা রয়েছে। কৃষির অগ্রগতির ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ইফপ্রি) ও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। এফএওর বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৯ অনুযায়ী, গত ৫০ বছরে দেশের প্রধান শস্য উৎপাদন চার থেকে পাঁচগুণ বেড়েছে।
বর্তমানে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। ভুট্টা ও গমে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয়। নিবিড় সবজি চাষে এক কোটি ৬০ লাখ টন সবজি উৎপাদন করেছে, যা বিশ্বে তৃতীয়। এক কথায়, কৃষি খাতের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য আধুনিক ও বিরূপতা সহনশীল জাতের উদ্ভাবন, সাশ্রয়ী সেচ প্রযুক্তি আবিষ্কার, ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের মাধ্যমে সেচ এলাকার সম্প্রসারণ, সমন্বিত পতঙ্গ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অনুসরণ, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ, ইত্যাদি বিশেষ ভূমিকা রাখছে। নিউক্লিয়ার ও জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে লবণাক্ত সহনশীল ও স্বল্প ব্যাপ্তির শস্য জাত এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। বন্যাপ্রবণ এলাকায় জমি চার ফসলি জমিতে রূপান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের ফসলের নিবিড়তা ২১৬ শতাংশ, যা ২০০৬ সালে ছিল মাত্র ১৬০ শতাংশ। ফলে চাষের অধীন জমি অনেক বেড়েছে।
শস্য খাতের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
শস্য খাতের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো প্রতি বছর দেশের প্রায় ১ শতাংশ হারে আবাদযোগ্য জমি কমে যাচ্ছে। বছরব্যাপী ফসল ফলানো, অত্যধিক রাসায়নিক সার প্রয়োগ, জৈবসার প্রয়োগ যথার্থ না হওয়ায় মাটির স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে ফলন কমে যাচ্ছে। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও হাউজিংয়ের জন্য প্রতি বছর প্রায় শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ হারে আবাদি জমি হ্রাস পাচ্ছে, প্রচুর ভালো মানের উর্বর তিনফসলি জমি হারিয়েছে দেশ। অন্য দিকে প্রতি বছর জনসংখ্যা বাড়ছে ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ হারে প্রায় ২৩ লাখ। সেই সাথে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা প্রতিকূলতা কৃষির জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের কৃষক ও তাদের পরিবার বিদেশে চলে যাওয়ায় প্রায় ৬ শতাংশ কৃষিজমি অনাবাদি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া যারা বিদেশে অভিবাসী হয়েছেন, তাদের পরিবারের ২.৩ শতাংশ জমি অনাবাদি রয়েছে, যা মোট কৃষিজমির ১২.৪৬ শতাংশের সমপরিমাণ।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট আয়তন এক কোটি ৪৯ লাখ ২১ হাজার হেক্টর এবং আবাদযোগ্য জমি ৮৮ লাখ ১৭ হাজার ৯৩৫ হেক্টর, যা মোট জমির প্রায় ৫৯ শতাংশ। আগে যেসব জমিতে তিনবার ফসল হতো, সেগুলোতে এখন বছরে দু’টি ফসল ফলছে। এর ফলে ১২ শতাংশ জমিতে ফসলের পরিমাণ কমেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে এক কেজি চাল বিক্রি করে কৃষকরা লাভ করতেন ১৬ টাকা ৫২ পয়সা যা ২০১৮ সালে ১৭ টাকা ৪৮ পয়সা হয়। তবে গড় লাভ ১ দশমিক ৩১ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও উৎপাদন খরচ ৩.৪৫ শতাংশ বেড়েছে। এর ফলে কৃষকরা তাদের বিনিয়োগে কম রিটার্ন পাচ্ছেন, কারণ উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়লেও খরচ দ্রুত বেড়ে গেছে, যা তাদের লাভ কমিয়ে একটি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।
আন্তর্জাতিক কৃষির আধুনিকায়ন অনুসারে বাংলাদেশের কৃষি খাতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগের অনেক উন্নতি হলেও এখনো আধুনিক বিশ্বের তুলনায় যথেষ্ট নয়। জমির ব্যবস্থাপনা, সেচ ও পানি প্রয়োগ, কীটনাশক ও বালাইনাশক প্রয়োগে আরো আধুনিক, অপচয়রোধ এবং খরচসাশ্রয়ী হতে হবে। এগুলো প্রয়োগে পরিবেশের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
কৃষি খাতে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা ও প্রাপ্য মর্যাদা না থাকা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি আবাদ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গ্রামের অনেক মানুষ উৎপাদনবিমুখ হচ্ছে। ফলে দেশের প্রকৃত সম্পদের পরিমাণ ক্রমেই কমে যাচ্ছে।
কৃষিতে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা এখন কমে ৪০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ফলে কৃষি মজুরের সঙ্কট যেমন বেড়েছে, তেমনি মজুরিও অনেক বেড়েছে। কৃষিপ্রযুক্তি প্রসারের জন্য ই-কৃষির সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের যেসব মানুষ ই-কৃষির ধারণার মোটেও রাখে না সেসব সুবিধাবঞ্চিত কৃষককে কৃষি সম্প্রসারণকর্মীদের মাঠে গিয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতে হয়। এ জন্য এ কর্মীদের প্রশিক্ষণ এখনো যথেষ্ট নয়।
বিশ্বের আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে ব্যাপকভাবে। বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের তলদেশের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে- ফলে অনেক দেশের স্থলভাগ ডুবে যাচ্ছে, জমিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে; ব্যাপকভাবে ঝড়বাদল হচ্ছে, ঋতুকাল পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে- ফলে ফসলের সাইকেলের পরিবর্তন হচ্ছে। ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে খাপখাইয়ে কৃষির প্রযুক্তির পরিবর্তন আনতে হবে।
কৃষিকাজ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এবং খরচের তুলনায় লাভজনক না হওয়ায় কৃষক কৃষি ছেড়ে সেবা সেক্টরের দিকে ঝুঁকছে। এসব কৃষককে কৃষিকাজে ধরে রাখতে হলে ব্যাপকভাবে ইনপুট সরবরাহ নিশ্চিতকরণ ও সাবসিডি দিতে হবে।
উপসংহারে বলতে হয়, বর্তমানে কৃষি খাতে উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে দেশের অবস্থান সবার ওপরে। আধুনিক বিশ্বের মতো আমাদের কৃষিরও আধুনিকায়ন করতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়েও অধিক বিনিয়োগ ও অংশীদারিত্ব প্রয়োজন। কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রতিটি উপজেলায় ফসল সংরক্ষণাগার গড়ে তুলতে হবে। জাতীয় কৃষিনীতি, জাতীয় বীজনীতি, জাতীয় খাদ্যনীতি ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যের (এসডিজি) সাথে সঙ্গতি রেখে দেশের জনস্বাস্থ্যের ঝুঁঁকি এড়ানোর জন্য নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, পশ্চাৎপদ নৃগোষ্ঠীর জন্য পাহাড়ি অঞ্চলে ফলের বাগান ও সবজি আবাদের বিস্তার এবং অনুন্নত চর ও হাওর অঞ্চলে সমন্বিত কৃষিসহ বহুবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। কৃষির বহুমুখীকরণের পাশাপাশি কৃষিজাত শিল্পকারখানা এবং উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ
ইমেইল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা