ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক : উত্তেজনার কারণ ও সমাধান
- ব্রি. জে. (অব:) রোকন উদ্দিন, পিএসসি
- ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
ভারত ও বাংলাদেশ এমন এক সম্পর্ক ভাগাভাগি করে, যা যেমন জটিল তেমনই গুরুত্বপূর্ণ, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভূগোলের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। একসময় একই ভূখণ্ডের অংশ দু’টি দেশ, ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভাজনের পরেও একে অপরের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্কের বন্ধন আরো দৃঢ় করে এবং বাণিজ্য, সংযোগ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার মতো ক্ষেত্রে সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি করে।
এই গভীর শিকড়যুক্ত সংযোগ থাকা সত্ত্বেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বারবার সহযোগিতা ও সঙ্ঘাতের মধ্যে দোদুল্যমান। সহযোগিতার সময়গুলো পারস্পরিক উপকারিতার সম্ভাবনা তুলে ধরলেও, অন্তর্নিহিত উত্তেজনা প্রায়ই অগ্রগতি ব্যাহত করেছে। আকার, ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডার বৈষম্য এই গতিশীলতাকে প্রভাবিত করে, যা কখনো কখনো আধিপত্য এবং নির্ভরশীলতার ধারণা সৃষ্টি করে।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সম্পর্ক ক্রমেই তিক্ত হয়ে উঠছে, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্বের কারণে। নদীর অমীমাংসিত পানিবণ্টন চুক্তি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের মতো মূল বিষয়গুলো বাংলাদেশে অসন্তোষ বাড়িয়ে তুলেছে। এর পাশাপাশি, ঢাকার নির্দিষ্ট রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার প্রতি ভারতের স্পষ্ট সমর্থন এই গতিশীলতাকে আরো জটিল করে তুলেছে এবং ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে।
২০২৪ সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর, পরিস্থিতি সঙ্কটপূর্ণ মোড় নিয়েছে। ভারতের প্রতিক্রিয়া, যার মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ এবং মানসিক যুদ্ধের কৌশলের রিপোর্ট অন্তর্ভুক্ত, বিভাজনকে আরো গভীর করেছে। জাতীয় প্রতীককে অসম্মান এবং ভারতীয় নেতাদের উসকানিমূলক বক্তব্যের মতো ঘটনাগুলো এই ফাটলকে আরো তীব্র করেছে এবং তাদের সম্পর্কের কূটনৈতিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে, বর্তমান উত্তেজনা কেবল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককেই হুমকির মুখে ফেলছে না; বরং দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যও বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। একটি ভারসাম্যপূর্ণ, সম্মানজনক এবং পারস্পরিকভাবে উপকারী অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা এর আগে কখনো এতটা জরুরি ছিল না। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের ভূমিকার সমালোচনামূলক মূল্যায়ন করা হয়েছে এবং আস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও সীমান্ত উভয়পারের মানুষের আকাক্সক্ষাকে প্রতিফলিত করে টেকসই সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য একটি রোডম্যাপ প্রস্তাব করা হয়েছে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের লড়াইয়ে ভারত রাজনৈতিক, সামরিক এবং মানবিক সহায়তা দেয়। এতে শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত হয়নি বরং দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তি তৈরি হয়। তবে, এই সংহতি সবসময় মধুর সম্পর্ক গঠনে সফল হয়নি, কারণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলো বারবার এই সম্পর্ককে পরীক্ষা করেছে।
স্বাধীনতার পরের সম্পর্ক এবং প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর, সম্পর্কের প্রাথমিক বছরগুলো সদিচ্ছা এবং সহযোগিতার দ্বারা চিহ্নিত ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ পুনর্নির্মাণের অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ভারত ও বাংলাদেশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সহায়তা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে, সহযোগিতার দিকে পরিচালিত করে। তবে, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিশীলতায় পরিবর্তনের সূচনা করে, যা সরাসরি ভারতের সাথে সম্পর্ককে প্রভাবিত করে।
পরবর্তী সরকারগুলো ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়া এবং দূরে থাকার মধ্যবর্তী নীতি অনুসরণ করেছে, যা তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং জনসাধারণের অনুভূতির উপর নির্ভর করেছিল। কিছু শাসনব্যবস্থা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চাইলেও, অন্যরা সার্বভৌমত্ব ও জাতীয়তাবাদের উপর জোর দিয়েছিল, প্রায়ই ভারতকে একটি আধিপত্যশীল প্রতিবেশী হিসেবে উপস্থাপন করে।
ভৌগোলিক কৌশলগত আগ্রহ এবং ক্ষমতার অসমতা
বাংলাদেশের প্রতি ভারতের কৌশলগত আগ্রহ তার ভৌগোলিক অবস্থান থেকে উদ্ভূত। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর প্রবেশদ্বার হিসেবে, বাংলাদেশ ভারতের আঞ্চলিক নিরাপত্তা, বাণিজ্য রুট এবং সংযোগ প্রকল্পের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ধরে রাখে। ভারত এই আগ্রহগুলো নিশ্চিত করতে ধারাবাহিকভাবে ঢাকায় তার প্রভাব বজায় রাখতে চেয়েছে, বিশেষত চীন এবং অন্যান্য আঞ্চলিক খেলোয়াড়দের সাথে প্রতিযোগিতার মুখে।
তবে, এই প্রভাবের উপর গুরুত্বারোপ প্রায়ই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা এবং নির্দিষ্ট শাসনব্যবস্থার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের অভিযোগ সমালোচনা টেনে এনেছে। অনেকেই ভারতের এই পদক্ষেপগুলোকে অংশীদারিত্বের পরিবর্তে আধিপত্যের একটি বৃহত্তর চিত্র হিসেবে দেখেন।
সহযোগিতার সময়কাল এবং অনুমানিত ভারসাম্যহীনতা
শেখ হাসিনার শাসনকালকে প্রায়ই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সহযোগিতার সময়কাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই সময়ে বাণিজ্য, সংযোগ, জ্বালানি ও নিরাপত্তা বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং সীমান্ত অতিক্রমকারী অবকাঠামো প্রকল্পগুলো গতি পায়। উভয় দেশ সন্ত্রাসবাদ এবং মানব পাচারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে একসাথে কাজ করেছিল।
তবে, এই অগ্রগতি সত্ত্বেও বাংলাদেশের মধ্যে অনেকেই এই চুক্তিগুলোকে ভারতের স্বার্থে অতিমাত্রায় ঝুঁকে থাকার জন্য সমালোচনা করেছেন। যেমন-
পানিবণ্টন চুক্তি : কিছু পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও তিস্তা নদী নিয়ে বিরোধ অমীমাংসিত রয়ে গেছে। পানি বণ্টনে অসমতার ধারণা জনসাধারণের অসন্তোষ উসকে দিয়েছে।
অর্থনৈতিক বৈষম্য : বাণিজ্য সম্পর্ক প্রায়ই ভারতের পক্ষে ঝুঁকে থাকে, যেখানে বাংলাদেশ একটি উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য ঘাটতি বহন করে। টেক্সটাইল ও কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে অন্যায্য প্রতিযোগিতার উদ্বেগগুলো অসন্তোষ বাড়িয়েছে।
সংযোগ প্রকল্প : বাংলাদেশ হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ট্রানজিট রুটের মতো উদ্যোগগুলো ভারতের জন্য উপকারী হলেও, সমালোচকদের মতে বাংলাদেশের জন্য সুবিধা সুস্পষ্টভাবে সীমিত।
অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের ধারণা
বিশেষ করে শেখ হাসিনার শাসনামলে আওয়ামী লীগের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অতিরিক্ত প্রভাবের অভিযোগ তুলেছে। অনেক বাংলাদেশী এই সম্পর্ককে তাদের দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য আপস হিসেবে দেখেন। ভারতের একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে সমর্থন করার ব্যাপক ধারণা অন্য গোষ্ঠীগুলোকে বিচ্ছিন্ন করেছে, জনসাধারণ ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব তীব্র করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ধারণা একটি সঙ্কটপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কের ফাটল স্পষ্ট করে তুলেছে। দীর্ঘদিনের অভিযোগগুলোর সমাধানে ভারতের অনিচ্ছা অবিশ্বাস এবং অসন্তোষকে বাড়িয়ে তুলেছে।
সাম্প্রতিক ঘটনা এবং ক্ষোভের বৃদ্ধি
গত এক দশকে এই উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ এবং জনসাধারণের দ্বারা অন্যায্য বলে মনে করা চুক্তির প্রয়োগ ভারতের সহযোগী প্রতিবেশী হিসেবে ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করেছে। বাংলাদেশের জনগণের অনেকের কাছে এই ধারণা গড়ে উঠেছে যে, ভারত তার নিজস্ব কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে সমান সহযোগিতার চেয়ে অগ্রাধিকার দেয়। এই ভারতবিরোধী মনোভাব এখন অনেকের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত।
এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বর্তমান উত্তেজনার মঞ্চ প্রস্তুত করেছে, যেখানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন স্থিতাবস্থাকে ব্যাহত করেছে। বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে খাপ খাওয়াতে ভারতের অক্ষমতা এবং পারস্পরিক বিশ্বাসের ক্ষতির বিনিময়ে তার নিজস্ব স্বার্থ সাধনের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা সম্পর্ককে এক সন্ধিক্ষণে নিয়ে এসেছে। এই প্রেক্ষাপট বোঝা পারস্পরিক অবিশ্বাসের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করা এবং একটি সমাধানের পথ খুঁজে বের করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মোড় ঘোরানো মুহূর্ত : হাসিনা সরকারের পতন
২০২৪ সালের জুলাই মাসে শেখ হাসিনার সরকারের নাটকীয় পতন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস এবং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হিসেবে চিহ্নিত হয়। আওয়ামী লীগের দীর্ঘকালীন শাসনের সমাপ্তি, যা কর্তৃত্ববাদী শাসন, ব্যাপক দুর্নীতি এবং জনগণের ব্যাপক অসন্তোষের অভিযোগে জর্জরিত ছিল, দেশের রাজনৈতিক সংস্কারের দরজা খুলে দেয় এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে সম্ভাব্য নতুন দিক নির্ধারণের সুযোগ সৃষ্টি করে। তবে, ভারতের জন্য এই রাজনৈতিক পরিবর্তন জটিল চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে, কারণ আওয়ামী লীগের সাথে ভারতের গভীর সম্পর্ক এবং ঢাকায় প্রভাব বজায় রাখার স্বার্থ।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন
হাসিনা সরকারের পতন বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের প্রতি একটি গভীর আকাক্সক্ষাকে প্রতিফলিত করে। একটি নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আবির্ভাব ঘটে যারা ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি প্রতিষ্ঠা এবং দীর্ঘদিনের অভিযোগগুলোর সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভারতের জন্য এই রূপান্তর নির্ভরযোগ্য মিত্রের ক্ষতি এবং অঞ্চলে প্রভাব বজায় রাখতে তার পন্থা পুনর্বিবেচনার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।
ভারতের প্রতিক্রিয়ার ব্যর্থতা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রতি ভারতের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ব্যাপকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল এবং পরিবর্তিত গতিশীলতার সাথে খাপ খাওয়াতে অক্ষমতার প্রতিফলন হিসেবে সমালোচিত হয়েছে। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে গঠনমূলক সম্পৃক্ততার পরিবর্তে, ভারত এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যা সম্পর্ককে আরো তিক্ত করেছে।
অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ : অভিযোগ উঠেছে যে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেছে, যার মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টা অন্তর্ভুক্ত। বিরোধী দলগুলোকে গোপনে সমর্থন এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানে বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টার প্রতিবেদনগুলো উত্তেজনা বাড়িয়েছে।
মিডিয়া এবং মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ : ভারতীয় মিডিয়া নতুন সরকারকে অস্থিতিশীল এবং অযোগ্য হিসেবে চিত্রিত করার জন্য একটি প্রচারণা চালায়, যার লক্ষ্য ছিল এর বৈধতাকে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ করা। এই বিবরণটি ভারতের প্রত্যক্ষ সমর্থন ছাড়া বাংলাদেশের শাসনক্ষমতার উপর সন্দেহ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল।
প্ররোচনা এবং অপমান : একাধিক ঘটনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের অনুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে :
হাইকমিশনগুলোর উপর হামলা : ভারতে বাংলাদেশী কূটনৈতিক মিশনে ভাঙচুর এবং বিক্ষোভের ঘটনা সরকারি মদদে ইচ্ছাকৃত উসকানি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
জাতীয় পতাকা পোড়ানো : ভারতে হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পোড়ানোর মতো কর্মকাণ্ড অসম্মান এবং শত্রুতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছে, যা ক্ষোভকে আরো গভীর করেছে।
উসকানিমূলক বক্তব্য : ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের কিছু বক্তব্য, যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে খাটো করেছে এবং এর স্থিতিশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, বাংলাদেশী জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়িয়ে তুলেছে।
শেখ হাসিনাকে আশ্রয়দান : ভারত সরকার পতিত শেখ হাসিনাকে তার দেশে আশ্রয় দেয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক উন্নয়নে প্রতিবন্ধক হিসেবে গণ্য হবে বলে অনেকে ধারণা করেন। এ বিষয়টি বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে দারুণ অসন্তোষের সৃষ্টি করেছে।
সম্পর্কের উপর প্রভাব
বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতাকে মেনে নিতে ভারতের অক্ষমতা দুই দেশের মধ্যে ফাটলকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তুলেছে। সংলাপ এবং সহযোগিতা বাড়ানোর পরিবর্তে, এই পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশকে সমান অংশীদার হিসেবে গণ্য করতে ভারতের অনিচ্ছার ধারণাকে জোরদার করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম নীতি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাগুলো প্রতিরোধের মুখে পড়েছে, যা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরো জটিল করেছে।
ভবিষ্যতের পথ
শেখ হাসিনা সরকারের পতন ভারতের জন্য তার প্রতিবেশীদের প্রতি একটি আরো বাস্তববাদী এবং সম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা সামনে এনেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক রূপান্তর পারস্পরিক সম্মান এবং সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক পুনর্নির্মাণের জন্য একটি সুযোগ। তবে, এর জন্য ভারতকে বাংলাদেশকে একটি অধীন মিত্র হিসেবে দেখার ধারণা পরিত্যাগ করতে হবে এবং এটিকে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম জাতি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এ ধরনের পরিবর্তন ছাড়া, উভয় দেশের মধ্যে বিভেদ আরো গভীর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতার জন্য ক্ষতিকর।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের ভূমিকা
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রতি ভারতের প্রতিক্রিয়া ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে, বিশেষ করে এটি একপাক্ষিক এবং দৃষ্টিহীন বলে অভিহিত করা হয়েছে। ভারত যা করতে পারত তা হলো সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ গ্রহণ। কিন্তু পরিবর্তে তারা এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যা প্রতিবেশীকে আরো বিচ্ছিন্ন করেছে। কূটনৈতিক, ক্ষতিকারক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই পদক্ষেপগুলো অবিশ্বাস বাড়িয়েছে এবং উত্তেজনা তীব্র করেছে। এখানে ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে ভূমিকার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হলো:
কূটনৈতিক চাপ
বাংলাদেশ অভিযোগ করছে যে, তারা আন্তর্জাতিক মঞ্চে এবং মিডিয়াতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য তার প্রভাব ব্যবহার করেছে, যাতে সেটিকে অবৈধ বা অস্থিতিশীল হিসেবে চিত্রিত করা হয়।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল : ভারত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে তার প্রভাব ব্যবহার করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা এবং কার্যকারিতা সম্পর্কে সমালোচনা বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। শাসনব্যবস্থা, মানবাধিকার ও সংখ্যালঘু সমস্যা নিয়ে মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জগুলোকে সামনে এনে ভারত এই নতুন নেতৃত্বকে অবৈধ করতে এবং বিশ্বের মঞ্চে তার কূটনৈতিক অবস্থান সীমিত করতে চেয়েছে। এই প্রচেষ্টা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করার চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
মিডিয়া বর্ণনা
ভারতীয় মিডিয়া আউটলেটগুলো, যা প্রায়ই আন্তর্জাতিক মতামত গঠনে প্রভাব বিস্তার করে, বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হিসেবে চিত্রিত করে মিথ্যা, বানোয়াট, কল্পনাপ্রসূত ও অনুমান-নির্ভর খবর প্রচার করেছে। এ ধরনের বর্ণনাগুলো কেবল বাংলাদেশের বৈশ্বিক ইমেজ ক্ষুণœ করে না; বরং সরকারের ক্ষমতা এবং দেশের কার্যকর শাসন পরিচালনার প্রতি জনসাধারণের আস্থা কমিয়ে দেয়। এই কৌশলটি মানসিক যুদ্ধের বৃহত্তর অপারেশনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, যা ঢাকার উপর চাপ সৃষ্টি করতে চায়।
সাবভার্সিভ কার্যকলাপ
ভারতের বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা, যেমন- প্রতিরক্ষা, বিচারব্যবস্থা এবং পুলিশ বিভাগে অস্থিরতা সৃষ্টির অভিযোগে ভারতের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা undermine করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রতিরক্ষা বিভাগ : রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির জন্য কাজ করতে পারে, সম্ভবত অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে। এই প্রচেষ্টাগুলো সেনাবাহিনীর মধ্যে অশান্তি তৈরির চেষ্টা করছে, যা জাতীয় স্থিতিশীলতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ।
বিচারব্যবস্থা : ভারতের বাংলাদেশী বিচারব্যবস্থায় প্রভাবের অভিযোগ রয়েছে, যেখানে ভারতীয় স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়ার জন্য আইনি প্রক্রিয়া সধহরঢ়ঁষধঃ করার চেষ্টা করা হয়েছে। এ ধরনের হস্তক্ষেপকে বাংলাদেশের বিচারিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতার উপর আক্রমণ এবং দেশটির সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন হিসেবে দেখা হয়, যা জনগণের বিশ্বাস ক্ষুণ্ন করে।
পুলিশ এবং নিরাপত্তা বাহিনী : বাংলাদেশ পুলিশের এবং নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে কার্যকলাপের অভিযোগ রয়েছে, যেখানে অকার্যকারিতা বা দুর্নীতির বিষয়গুলো উত্থাপন করা হয়েছে, অনেক সময় বিক্ষোভকারী গোষ্ঠীকে গোপন সহায়তা দিয়ে। এসব পদক্ষেপ সরকারের বৈধতাকে অবমূল্যায়ন করার এবং জনসাধারণের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আস্থাহীনতা সৃষ্টি করার বৃহত্তর কৌশলের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অর্থনীতির পথে প্রতিবন্ধকতা
ভারত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দুর্বল করার জন্য বিভিন্ন শিল্প এবং বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি মূল স্তম্ভ।
গার্মেন্ট শিল্প : বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প, যা দেশের জিডিপি এবং রফতানি আয়ের একটি বড় অংশ গঠন করে, ভারতীয় হস্তক্ষেপের সাথে সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। সাপ্লাই চেইনে বিঘ্ন সৃষ্টি, শ্রমিক অসন্তোষ বা আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে যা এই খাতকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে গঠিত একটি কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকে দুর্বল করে ভারত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অর্থনৈতিক চাপে ফেলতে চায়।
বাণিজ্যিক বাধা : বাংলাদেশের রফতানি পণ্যে ভারতীয় শুল্ক বা অশুল্ক বাধা আরোপ বা স্থাপন করা সম্পর্ককে আরো খারাপ করেছে। এই বিধিনিষেধগুলো বাংলাদেশকে ভারতীয় বাজারে প্রবেশের সুযোগ সীমিত করে, একই সাথে বাণিজ্যিক ঘাটতি বাড়িয়ে দেয়, যা অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির ধারণাকে শক্তিশালী করে।
আঞ্চলিক সংযোগ : ভারতীয় সংযোগ প্রকল্পগুলোর প্রতি কঠোর মনোভাব, যেখানে সুবিধাগুলো একপাক্ষিকভাবে অনুভূত হয়, তার ফলে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। এমন অবকাঠামো প্রকল্পগুলো যা প্রধানত ভারতীয় স্বার্থে কাজ করে এবং পর্যাপ্ত পারস্পরিক সুবিধা প্রদান না করায়, তা এই ধারণাকে শক্তিশালী করে যে ভারত তার কৌশলগত লক্ষ্যকে প্রথমে রাখে এবং সমান সহযোগিতার পরিবর্তে একপাক্ষিক সুবিধা নিয়ে কাজ করে।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা