ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের মুখে ভারত
- রিন্টু আনোয়ার
- ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
এক দিনের সফরে নতুন বাংলাদেশ দেখে গেছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি। ঠেলায় পড়ে আপাত বলে গেছেন, ‘বাংলাদেশের সাথে একটি ইতিবাচক, গঠনমূলক ও পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ক চায় ভারত। দেশে ফিরেই সংসদের পররাষ্ট্রবিষয়ক স্থায়ী কমিটির ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে যেসব সমালোচনা করেন তা ভারত সমর্থন করে না। ভারতের সম্পর্ক বাংলাদেশের সাথে কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা সরকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এই সম্পর্কের ভিত্তি বাংলাদেশের জনগণের মধ্যেই নিহিত।
ঢাকায় তার সফরের সময় তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে জানিয়েছেন, ভারত জনগণের সাথে সম্পর্ক অগ্রাধিকার দেয় এবং বর্তমান সরকারের সাথে কাজ চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও আগের তাচ্ছিল্য ও হুমকি থেকে সরে এসে নমনীয় কথা বলছেন। উপলব্ধিতে এসেছে, একটু বেশিই বলে ফেলেছিলেন। আর তার এক সময়ের সহচর পরে বিজেপিতে পল্টি দেয়া শুভেন্দু কখন কী বলতে গিয়ে কী খেয়ে ফেলেন- তা আমলে নেয়ার মতো নয়। ভারতের বাদবাকিদেরও বুঝতে হবে- এই বাংলাদেশ আর সেই বাংলাদেশ নেই। বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বের আড়ালে কেবল আওয়ামী লীগ আর শেখ হাসিনার সাথে বন্ধুত্ব করার পরিণাম এখন ভারতকে ভুগতে হচ্ছে! সামনে আরো কত কী ভুগতে হতে পারে!
আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশের পর সিরিয়ার দৃশ্যপট ভারতের জন্য এক আতঙ্কের। ধাওয়া খেয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় জুটেছে সিরিয়ার প্রতাপশালী বাশার আল-আসাদের। শেখ হাসিনার আশ্রয় হয়েছে ভারতে। উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার ১৯৮১-তে যেখান থেকে বাংলাদেশে তার আগমন ২০২৪-এ সেখানেই তার নির্গমন। একাত্তরে পাকিস্তানিরা রিয়েলিটি মেনে না নিয়ে পরিণাম ভুগেছে। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের রিয়েলিটি মানছে না ভারত। তাছাড়া চারদিকের প্রতিবেশীদের জ্বালিয়েও জ্বালা-যন্ত্রণা দিয়ে অতিষ্ঠ করে তুলছে তারা। শেষতক তার চারদিক থেকেই এখন প্রতিপক্ষ। একনায়কত্বের দর্প যে এভাবেই গুঁড়িয়ে যায়, তা শুধু নির্দিষ্ট কোনো দেশে নয়। সিরিয়া, শ্রীলঙ্কা আর বাংলাদেশ সবখানেই। প্রতিবেশীদের ত্যক্ত-বিরক্ত করতে করতে বৃহৎ রাষ্ট্র ভারত এখন নিজেই কোণঠাসা। বিশ্বের সুপার পাওয়ার হওয়ার মোহগ্রস্ত দেশটি দক্ষিণ এশিয়াতেই দুষ্টরাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে এখন। ফলে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটানও এড়িয়ে চলছে ভারতকে। সবগুলো দেশেই এখন ভারতীয় মর্জির বিপরীত সরকার। পাকিস্তান, চীন ও শেষতক বাংলাদেশও ছেড়ে কথা বলছে না। বিশেষ করে বাংলাদেশকে পিষিয়ে মারতে মারতে এখন গোটা বিশ্বময় ভারতের স্বরূপ উদাম হয়ে গেছে। এক সময় বলা হতো- ভারতের জন্য বাংলাদেশের দম ফেলার সুযোগ নেই। কারণ এর তিন দিকেই ভারত এক দিকে বঙ্গোপসাগর। অথচ এখন ভারতের চারদিকেই তার প্রতিপক্ষ বিরাজমান।
সম্প্রতি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু নির্যাতনের নাটক ও ভুয়া অভিযোগ সাজাতে গিয়ে ভারতের চরিত্রের এক ভয়াবহ কদাকার দিক প্রকাশ পেয়েছে। বলা হচ্ছে, নতুন এক বাংলাদেশ মানতে ভারতের কলিজা ছিঁড়ে যাওয়ার কষ্টে তাল-লয়ও হারিয়ে ফেলেছে। গণ-আন্দোলনের তোড়ে গদিচ্যুত পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনাকে আশ্রয়ে নেয়ার পর থেকে ভারত পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার হেন চেষ্টা নেই যা না করছে। সর্বহারার মতো এখন ভারতের ঠুনকো অস্ত্র সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশকে ঘায়েল করার চেষ্টায় হাল না ছেড়ে খেলছে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ বা ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস-ইসকনকে নিয়ে। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে সারা দেশে যে তাণ্ডবলীলা চালানো হয়েছে, সেটি কোনোভাবেই স্বাভাবিক প্রতিবাদ নয়। মমতা ব্যানার্জি হিন্দুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে বাংলাদেশে শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করতে জাতিসঙ্ঘের প্রতি আবেদন জানিয়ে মূর্খতার পরিচয় দিয়ে সেখান থেকে সরে এসেছেন। এর আগে, আগরতলায় বাংলাদেশের হাইকমিশনে হামলা, লুট-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে বাংলাদেশ ও ভারতের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের বাকযুদ্ধ ক্রমান্বয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বেশ কয়েকটি রাজ্য নিয়ে ভারত এমনিতেই ঝামেলায় আছে। মনিপুরে নাজুক পরিস্থিতি। সম্প্রতি মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লাল দুহোমা যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে ভারতে একটি খ্রিষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন। লাল দুহোমা এ আহ্বান এক মাস আগে দিলেও এত দিন তা গোপন রাখা হয়েছিল। চিকিৎসাসেবা ও সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ থেকে শুরু করে দুই দেশে পতাকা পোড়ানো বা পদদলিত করা, বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতি, ভিসা বন্ধ বা সীমিত করার ঘটনাসহ সাম্প্রতিক অস্থিরতা বাজে ইঙ্গিত দিচ্ছে। গত ১৫-১৬ বছর ভারতের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত নানা স্বার্থ রক্ষা করেছে শেখ হাসিনা সরকার। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত-বিরোধিতা কেবল বেড়েছেই। গত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় এবং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো তুলনামূলক ভালো করেছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়ন করা হচ্ছে, এমন প্রচার চালিয়ে ভারতের জনগণকে আরো বেশি মুসলিমবিদ্বেষী করার অ্যাজেন্ডায় নরেন্দ্র মোদির বিজেপিতে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তারা আগামী নির্বাচন পর্যন্ত এই ইস্যুটি জিইয়ে রাখতে চায়। একইভাবে ভারতীয় কিছু গণমাধ্যমে বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়ন সম্পর্কে ভুয়া ও অতিরঞ্জিত খবর প্রকাশ করছে। যা বাংলাদেশে ভারত-বিরোধিতা আরো বেগবান হচ্ছে।
ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যের নিরাপত্তা এবং কৌশলগত কারণে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী শক্তিকে ক্ষমতায় দিল্লি দেখতে চায় না। সেই সমীকরণে ভারতের খাস পছন্দ আওয়ামী লীগ। যাদের দিয়ে বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী বহু অপকর্ম চালিয়ে এসেছিল দেশটি। হাসিনা প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ভারতকে তিনি যা দিয়েছেন, তারা তা আজীবন মনে রাখবে। এর মধ্য দিয়ে বিষয়টি আরো আগেই পরিষ্কার। যার প্রমাণ, গণ-আন্দোলনে শেখ হাসিনা পালানোর পর ভারত ছাড়া দুনিয়ার কোনো দেশ তাকে আশ্রয় না দেয়া। এটি ভারতের জন্য কত লজ্জা, কষ্টের তা ভারতই জানে। যে বিপ্লব তাদের খাস পছন্দের নেতা হাসিনার পতন ঘটিয়েছে, তাকে খাটো করে দেখাতে ভারত বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের দুর্দশাকে একটি আবেগপূর্ণ রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করেছে। হিন্দু জাগরণ মঞ্চের নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস গ্রেফতার হওয়ার পর ভারতের বিজেপি সরকার এবং বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা সব ধরনের রাখঢাকের পর্দা সরিয়ে দিয়েছে। দেশটি একদিকে নিজের ঘর সামলাতে পারছে না। আরেক দিকে চারদিক থেকেই ইটের বদলে পাটকেল খাচ্ছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে পদক্ষেপই নিচ্ছে সেটিতেই মার খাচ্ছে। বুমেরাং হয়ে যাচ্ছে সব চাতুরী। বাংলাদেশে কেবল সংখ্যালঘু নয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থকদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চলছে- সংবাদ রটিয়ে দিতেও কলকাঠি নেড়েছে।
অবস্থাটা এখন এমন পর্যায়ে চলে গেছে, সেখানে এখন ভারত যত বেশি অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে উসকানি দিচ্ছে তত বেশি এই সরকারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনের মতো কিছু আয়োজন করার ফাঁক এখন আর ভারতের নেই। ব্যাপক ভোট কারচুপি, রাতে ভোট চুরি এবং দিনে ভোটের মহাডাকাতির দিন ফুরিয়ে গেছে বাংলাদেশে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী ও গদি মিডিয়ায় অপপ্রচার চালিয়ে কিছু ঘটিয়ে ফেলবে- সেই চান্সও আর নেই। কত দিন আর মিথ্যা যুদ্ধ চালাবে? বাংলাদেশে এখন প্রকাশ্যে ভারতের আধিপত্যবাদী শক্তির পক্ষে কথা বলার লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কী এক কঠিন বিপদে পড়েছে ভারত। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও সিরিয়ার ঘটনাবলি ভারতকে হতবাক করে দিয়েছে। তার মিত্র রাশিয়ার দুরবস্থার অর্থই হলো ভারতের করুণ পরিণতি। অতীতে রাশিয়ার শক্তির ওপর নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারত যেভাবে দরকষাকষি করত সে অবস্থারও এখন পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। অতিদ্রুত ভারতকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক ভারত নির্মাণের দিকে যেতে হবে, নইলে বারাক ওবামার ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হবে- ‘ভারত খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত হবে ’।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম সম্প্রতি বলেছেন, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং প্রভাবশালী দেশের শীর্ষ সংসদীয় শুনানিতে অন্যায্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি সেক্যুলার সংবাদপত্র ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে বাংলাদেশের কথিত ধর্মীয় সহিংসতার মামলাগুলো তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস সারা বিশ্বে বক্তৃতা দিয়ে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। এখন তিনি নিজ দেশে ক্ষমতায় এসে তারুণ্যের শক্তি কিভাবে প্রয়োগ করেন তা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন বিশ্ববাসী। তারুণ্য ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সেতুবন্ধ রচনা করতে দক্ষ ড. ইউনূস- যা করলে বাংলাদেশ বাঁচবে। ১৯৭১ সালে তরুণরাই দেশ স্বাধীন করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। এবার দেশ গঠন করার কাজে তারা পিছিয়ে থাকবেন না।
ভারত ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে পুতুল হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে সাড়ে ১৫ বছর ধরে খাঁচার মধ্যে বন্দী করে রেখেছিল। কিন্তু গত ৫ আগস্টের বিপ্লবের (অভ্যুত্থান নয়, কারণ ফ্যাসিস্টের পতন শুধু যুদ্ধ ও বিপ্লবের মাধ্যমে হয়) মাধ্যমে হাসিনার পতনের পর দিশেহারা হয়ে পড়েছে ভারত তথা নয়াদিল্লি। একটির পর একটি বাংলাদেশ-বিরোধী কর্মকাণ্ডে সরাসরি মদদ দিচ্ছে ভারত ও তার গণমাধ্যম। এ নিয়ে ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে এখন চরম উত্তেজনা চলছে; ড. ইউনূস জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে ভারতের ঘুম হারাম করে দিয়েছেন।
ঐক্য হলো শক্তির প্রতীক। তা ব্যক্তিতে, দলে, চেতনায় সবদিকেই হতে পারে। আবার একক বিষয়েও হতে পারে। একাত্তরে স্বাধীনতার প্রশ্নে গোটা জাতি ছিল ঐক্যবদ্ধ; আর এ কারণেই সম্ভব হয়েছিল আমাদের বিজয় অর্জন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, স্বাধীনতার পর নানা ইস্যুতে দেশ বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরপর একটি সুযোগ আসে নব্বইয়ে। তাও বেশি দিন টেকেনি। এ বিভক্তি দিন দিন বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতেও জাতি অভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় ব্যর্থ হয়। চব্বিশের ঘটনাবলি ও আবহ একেবারে ভিন্ন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]
স্মরণ : বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর
১৯৪৯ সালের ৭ মার্চ বরিশাল জেলার রহিমগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। ১৯৫৩ সালে পাতারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬৪ সালে মুলাদি মাহমুদ জান পাইলট স্কুল থেকে সম্পন্ন করলেন ম্যাট্রিকুলেশন। ১৯৬৬ সালে ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ থেকে সম্পন্ন করেন উচ্চমাধ্যমিক স্তর। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত অবস্থায়ই পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। কমিশন লাভের পর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। পেশায় দ্রুত সাফল্য সত্ত্বেও জাহাঙ্গীর সর্বক্ষণ বাঙালিদের প্রতি অন্যায় আচরণের কথা ভাবতেন। চিন্তা করতেন এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথাও। ১৯৭১ এসে এক সময় কড়া নাড়ল কালের দরজায়। ২৫ মার্চের কালরাতের বর্বরতা গ্রাস করল মানুষকে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। ৩ জুলাই শিয়ালকোটের নিকটবর্তী সীমান্ত নদী অতিক্রম করে পৌঁছলেন কাছের বিএসএফ হেডকোয়ার্টারে। সেখান থেকে দিল্লি ও কলকাতা হয়ে পা রাখলেন বাংলাদেশের রণাঙ্গনে। জাহাঙ্গীরের পোস্টিং হলো ৭ নম্বর সেক্টরের মাহাদিবপুর সাব-সেক্টরে। তিনি অবতীর্ণ হলেন সম্মুখ সমরে। একের পর এক আক্রমণ করলেন পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে খ্যাত কানসাট, আরগারার হাট, শাহপুর। এবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর। ১১ ডিসেম্বর। মহানন্দা নদী পার হয়ে পাকিস্তানি সেনা ঘাঁটিটি আক্রমণ করল মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের বাহিনী। যুদ্ধ চলল। ১৪ ডিসেম্বর, সকাল ১০টা। যুদ্ধ তখন ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। জাহাঙ্গীর হঠাৎ লক্ষ করলেন, সামনেই একটি বাড়ির দোতলায় অবস্থানরত পাকিস্তানি মেশিনগান পোস্ট থেকে অনবরত গুলি আসছে। এই পোস্টটি দ্রুত ধ্বংস না করা গেলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ দখল করা অসম্ভব। কিন্তু মৃত্যুঝুঁকি প্রায় শত ভাগ। জাহাঙ্গীর একক সিদ্ধান্ত নিলেন। বাঁ হাতে এসএমজি এবং ডান হাতে একটা গ্রেনেড নিয়ে ক্রলিং করে এগিয়ে গেলেন পোস্টটির দিকে। গ্রেনেডটি লক্ষ্যে ছুড়লেন অব্যর্থভাবে। উড়ে গেল পোস্টটি। সেই সময়ই একটি গুলি এসে লাগে জাহাঙ্গীরের কপালে। সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল তার নি®প্রাণ দেহ। আজ শাহাদতবার্ষিকীতে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি এই বীর যোদ্ধাকে।
খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন এবং বিবিধ প্রসঙ্গ
এম এ খালেক
বাংলাদেশ ব্যাংক গত ২৭ নভেম্বর জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঋণ মান নির্ধারণের নীতিমালা কঠোর করেছে। আগামী বছর এপ্রিল মাস থেকে এই নতুন নীতিমালা প্রযোজ্য হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নীতিমালা অনুযায়ী, এখন থেকে কোনো ঋণ হিসাবের নিকট ব্যাংকের পাওনা কিস্তি তিন মাস অর্থাৎ ৯০ দিন অপরিশোধিত থাকলে তার পরদিন থেকেই তা খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এক শ্রেণীর প্রভাবশালী উদ্যোক্তা গোষ্ঠীর চাপের মুখে বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ সংজ্ঞা সহজীকরণ করা হয়েছিল। বিদ্যমান অবস্থায় কোনো ঋণ হিসাবের কিস্তি নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করতে না পারলেও ঋণ গ্রহীতা আরো এক বছর পর্যন্ত নিজেদের ঋণ খেলাপিমুক্ত দেখানোর সুযোগ পেতেন। এই সময়ের মধ্যে তারা নতুন করে ঋণ গ্রহণের সুযোগ পেতেন। নতুন নীতিমালা জারি করার কারণে এখন থেকে কোনো ঋণ হিসাবে পাওনা ঋণের কিস্তি নির্ধারিত দিনে পরিশোধ না করা হলে পরদিন থেকেই তা খেলাপি ঋণে পরিণত হবে। নতুন এই সার্কুলার বাস্তবায়ন শুরু হলে প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে বর্ধিত খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণের মাত্রাও বৃদ্ধি পাবে। ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণদান ক্ষমতা সঙ্কুচিত হয়ে পড়তে পারে। তবে কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা সঙ্কুচিত করায় ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণের সঠিক পরিমাণ জানার ক্ষেত্রে এক ধাপ অগ্রগতি সাধিত হবে বলে প্রকৃৃত অবস্থা জানা যাবে। কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানোর সুযোগ অনেকটাই কমে আসবে।
অনেকেই এমনভাবে ইস্যুটিকে বর্ণনা করছেন যেনো বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ হিসাব শ্রেণিকরণের সংজ্ঞা বা প্রক্রিয়া নতুনভাবে নির্ধারণ করেছে। আসলে বিষয়টি মোটেও তা নয়। দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের আগেও এভাবেই ঋণ হিসাব শ্রেণিকরণ করা হতো। কিন্তু বিগত সরকারের আমলে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে অনৈতিক সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যই মূলত ঋণ হিসাব শ্রেণিকরণের সংজ্ঞা শিথিল করা হয়েছে। কাজেই জারিকৃত সার্কুলারকে নতুন হিসেবে আখ্যায়িত না করে বরং পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তন বলা যেতে পারে। তবে যেভাবেই বিশ্লেষণ করা হোক না কেনো বাংলাদেশ ব্যাংকের জারিকৃত সার্কুলারটি অবশ্যই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
নতুন প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঋণ মান নির্ধারণের যে নীতিমালা ঘোষণা করা হয়েছে তার মাধ্যমে ঋণ হিসাবগুলোকে ৭টি বিশেষ শ্রেণীতে বিভক্ত করা হবে। এর মধ্যে নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা হয় এমন ঋণ হিসাবকে স্ট্যান্ডার্ড লোন হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এ শ্রেণীর ঋণের জন্য ১ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ হবার পর ১ দিন থেকে ১ মাস পর্যন্ত কোনো ঋণ হিসাবের কিস্তি অপরিশোধিত থাকলে তাকে স্ট্যান্ডার্ড-১ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এই শ্রেণীর ঋণের জন্য ১ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। ঋণ পরিশোধের নির্ধারিত শিডিউল থেকে ১ হতে ২ মাস পর্যন্ত কোনো ঋণের কিস্তি অপরিশোধিত থাকলে তার জন্য ১ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। কোনো ঋণ হিসাব থেকে নির্ধারিত সময়ের পর ২ থেকে ৩ মাস কিস্তি আদায় না হলে তাকে ‘স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট (এসএমএ) হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে। এ ধরনের ঋণ হিসাবের জন্য ৫ শতাংশ হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। সাব-স্ট্যান্ডার্ড বা নি¤œমানের ঋণ হিসাব হচ্ছে সেই ঋণ হিসাব নির্ধারিত সময়ের পর ২ থেকে ৩ মাস যার কিস্তি অপরিশোধিত থাকবে। এই শ্রেণীর ঋণ হিসাবের বিপরীতে ২০ শতাংশ হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। নির্ধারিত শিডিউলের পর ৬ মাস থেকে ১২ মাস পর্যন্ত কোনো ঋণের কিস্তি অপরিশোধিত থাকলে তাকে সন্দেহজনক বা ডাউটফুল লোন হিসাবে আখ্যায়িত করা হবে। এই শ্রেণীর ঋণ হিসাবের জন্য ৫০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। নির্ধারিত সময়ের পর ১২ মাস বা তারও বেশি সময় কিস্তি অপরিশোধিত থাকলে তাকে মন্দ ঋণ বা ব্যাড লোন হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে। এই শ্রেণীর ঋণ হিসাবের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে।
নতুন এই সার্কুলার কার্যকর হলে ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণকে লুকিয়ে রাখার প্রবণতা অনেকটাই কমে আসবে। তবে এখানে থেমে থাকলেই চলবে না। বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো কিছু ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিগত সরকারের আমলে একটি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা গোষ্ঠীকে অনৈতিক সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে ব্যাংকিং সেক্টরে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক মানের আইনগুলো নেতিবাচকভাবে পরিবর্তন করা হয়। ব্যাংকিং সেক্টরে বিদ্যমান আইনগুলো পরিবর্তন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে এমনভাবে দুর্বল করে ফেলা হয়েছিল যে, মহল বিশেষ ব্যাংক থেকে ঋণের নামে অর্থ তুলে নিয়ে তার কিস্তি ফেরৎ না দিলেও তাকে ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাচ্ছিল না। সরকারের ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী মহলকে ব্যাংক থেকে অর্থ লুটে নেয়ার অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছিল। কিস্তি আদায় না করে খেলাপি ঋণকে আইনি মারপ্যাঁচে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এই প্রবণতাকে ‘কার্পেটের নিচে ময়লা রেখে ঘর পরিষ্কার দেখানোর প্রচেষ্টা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে একমাত্র আ হ ম মোস্তাফা কামালই ছিলেন সরাসরি ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা। তিনি দায়িত্ব পালনকালে ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য যেসব আইনি পরিবর্তন বা সংশোধন করেছিলেন তার অধিকাংশই ছিল ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের স্বার্থে নিবেদিত। তার সময় ব্যাংকিং সেক্টরে যেসব আইনি পরিবর্তন করা হয়েছে তার কুফল অনুধাবন করার জন্য আরো ৭-৮ বছর অপেক্ষা করতে হবে। বিগত সরকারের আমলের শেষের দিকে ব্যাংকিং সেক্টরে যেসব আইনি পরিবর্তন করা হয়েছিল তার কয়েকটি এখানে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে।
আগে কোনো ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণিকৃত হবার পর ৫ বছর অতিক্রান্ত হলে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়েরপূর্বক শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণের মাধ্যমে তা অবলোপন করা যেতো। এই আইনটি পরিবর্তন করে অবলোপন নীতিমালা সহজীকরণ করা হয়। পরিবর্তিত নিয়ম অনুসারে কোনো ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণিকৃত হবার পর ২ বছর অতিক্রান্ত হলে তা অবলোপন করার সুযোগ দেয়া হয়। বিবেচনাধীন প্রকল্পের নিকট পাওনা খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ টাকার কম হলে আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে না। একই সঙ্গে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণের বিধানও বাতিল করা হয়। ঋণ হিসাব অবলোপন নীতিমালা সহজীকরণের ফলে ঋণ হিসাব অবলোপনের মাত্রা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ঋণ হিসাব অবলোপন শব্দটি উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে মনে হতে পারে বর্ণিত ঋণ হিসাব থেকে কিস্তি আদায়ের দাবি ব্যাংক বোধ হয় ত্যাগ করেছে। কিন্তু আসলে বিষয়টি তা নয়। ঋণ হিসাব অবলোপনের অর্থ হচ্ছে বর্ণিত ঋণ হিসাবের কাছে পাওনা অর্থ খেলাপি ঋণ হিসাবে প্রদর্শন করা হয় না। এটি আলাদা একটি অ্যাকাউন্টে সংরক্ষণ করা হয়। ব্যাংক অবলোপনকৃত ঋণ হিসাব থেকে কিস্তি আদায়ের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যায়। তবে এ ধরনের ঋণ হিসাব থেকে কিস্তি আদায় হবার ব্যাপারে ব্যাংক সন্দিহান থাকে। তাই অবলোপনকৃত ঋণ হিসাব থেকে কোনো কিস্তি আদায় হলে তা সরাসরি ব্যাংকের মুনাফা খাতে চলে যায়।
কিস্তি আদায় না করেও লোন অ্যাকাউন্ট ক্লিন দেখানোর আর একটি সহজ ও কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলীকরণ। ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ অর্থ হচ্ছে ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় বাড়ানো। যেমন কোনো ঋণ হিসাব থেকে কিস্তি আদায়ের নির্ধারিত তারিখ ছিল ৩১ ডিসেম্বর,২০২৪। সেই তারিখ পরিবর্তন করে কিস্তি আদায়ের সময়সীমা হয়তো জুন,২০২৫ পর্যন্ত বর্ধিত করা হলো। বর্ধিত ৬ মাস সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ঋণ হিসাবধারী কিস্তি পরিশোধ না করলেও তাকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। আগে কোনো ঋণ হিসাব সর্বোচ্চ তিনবার পুনঃতফসিলীকরণ করা যেতো। এ জন্য প্রথমবার পুনঃতফসিলীকরণের জন্য পাওনা খেলাপি ঋণের ১০ শতাংশ এককালীন নগদে ব্যাংকে জমা দিতে হতো। দ্বিতীয়বারে পুনঃতফসিলীকরণের জন্য ২০ শতাংশ এবং তৃতীয়বার এই সুযোগ গ্রহণ করার জন্য ৩০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট জমা দিতে হতো। আ হ ম মোস্তাফা কামাল অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার দায়িত্ব শেষ করার কিছুদিন আগে আইনি পরিবর্তনের মাধ্যমে মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট জমা দিয়ে এক বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ মোট ১০ বছরের জন্য ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলীকরণের সুযোগ দেয়া হয়। মোট ৩৮ হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই সুযোগ গ্রহণ করে তাদের খেলাপি ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলীকরণ করিয়ে নিয়েছেন। ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলীকরণ করানো হলে সেই প্রকল্পের উদ্যোক্তা অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন করে ঋণ গ্রহণের সুযোগ পান।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার জারি করে যে, কোনো শিল্পগোষ্ঠীর এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হলেও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো যাদের বিরুদ্ধে কোনো ঋণ খেলাপের অভিযোগ নেই তারা ব্যাংক থেকে নতুন করে ঋণ গ্রহণ করতে পারবে। আগের বিধানে কোনো শিল্পগোষ্ঠীর এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হলে অবশিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক ঋণ পেতো না।
২০১৫ সালে দেশব্যাপী রাজনৈতিক আন্দোলনের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই অজুহাতে ৫০০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব অঙ্কের খেলাপি ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা দেয়া হয়। সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট কয়েকটি গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়ার জন্য এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। কারণ রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে যদি শিল্প প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে তাহলে তো সব শিল্প প্রতিষ্ঠানই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাহলে এ ধরনের সুবিধা দেয়া হলে তা সবার জন্যই অবারিত করা উচিত ছিল।
ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করার জন্য একই পরিবার থেকে একযোগে চারজন পরিচালক নিয়োগের বিধান করা হয়েছিল। পরে ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ডের আপত্তির কারণে চারজনের পরিবর্তে তিনজন পরিচালক একই পরিবার থেকে নিয়োগের বিধান করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক যদি সত্যি সত্যি ব্যাংকিং সেক্টর, বিশেষ করে খেলাপি ঋণ সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে চায় তাহলে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব আইনি পরিবর্তন করা হয়েছে তা বাতিল করে আইনগুলোকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রয়োজনে আরো কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি তাদের চিহ্নিত করে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণসহ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানাদিতে তাদের নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। বিদেশ ভ্রমণ, বিদেশে লেখাপড়া এবং চাকরির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা প্রয়োজন।
লেখক : ব্যাংকার
ভিটিলিগো ভিকটিম মানসিক ঝুঁকিতে
রাসনা হাসনাহেনা
ভিটিলিগো হলো মানুষের শরীরের রং উৎপাদনকারী মেলানোসাইড কোষের অটোইমিউন ডিজঅর্ডার, যার ফলে মেলানোসাইড কোষ দ্বারা উৎপাদিত মেলানিন বা ত্বকের রং উৎপাদন ব্যাহত হয়। এ পরিস্থিতিতে ভিকটিমের ত্বক ক্রমান্বয়ে সাদা হয়ে ‘সৌন্দর্য প্রতিবন্ধী’ রূপ নেয়। এ অবস্থাকে ভিটিলিগো ভিকটিম বলা হয়। বাংলায় যা ‘শ্বেতি’ নামে বহুল পরিচিত। জাতিসঙ্ঘ এটিকে ডিসঅ্যাবিলিটি ইস্যু হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করে। ভিটিলিগো ভিকটিমরা ভয়ঙ্কর এক মানসিক ঝুঁকিতে জীবনযাপন করছেন। ভিটিলিগো ভিকটিমদের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে বিষণœতা রোগ। অন্যান্য মানসিক রোগ যেমন- পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার বা বিপর্যয়-পরবর্তী সময়ে মানসিক চাপজনিত রোগ, জেনারালাইজড অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার বা অত্যধিক দুশ্চিন্তাজনিত রোগ, মাদকাসক্তি, ব্যক্তিত্বের সমস্যা বা পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার এবং মাইন্ড অটোইমিউন ডিজঅর্ডারে ভিটিলিগো ভিকটিম আক্রান্ত হয়।
ভিটিলিগো ভিকটিম নারী-শিশুরা চোখের আড়ালে
নারীরা সুবিধাবঞ্চিত, অবহেলিত, নির্যাতিত- এসব কথা এখন প্রায় সবার মুখস্ত। তাই নারীর ক্ষমতায়ন, নারী অধিকার এসব নতুন কথায় চারদিক প্রকম্পি, কিন্তু নারী ভিটিলিগো? তারা নির্যাতিত সুবিধাবঞ্চিত নারীদের থেকেও ভাগ্যাহত। রোগহীন শরীর নিয়ে ছোঁয়াচে নয় এমন ভিটিলিগো ভিকটিম হয়ে আজন্ম নীরবে মৃত্যু যন্ত্রণা সইছে, যতক্ষণ না তারা ক্ষমতায়ন ও অধিকার সচেতন হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। আর এ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে ভিটিলিগো নারীরা সমাজ সংস্কারকদের চোখের আড়ালে থেকে যাচ্ছে আমাদের দেশে। নারী ও শিশুরা আমাদের সমাজে স্বাভাবিকভাবে পিছিয়ে থাকে আর ভিটিলিগো ভিকটিম নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরো বেশি ভয়ঙ্কর। একজন নারী ভিকটিম নিজেকে সর্বদা আড়াল করে রাখতে চায়। জনসম্মুখে আসতে চায় না কারণ তার আশপাশের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী সবাই ভিটিলিগো নিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন ও মন্তব্য করে। যেটি একজন নারী ভিকটিমের জন্য খুব অস্বস্তিকর। যে কারণে নারীরা নিজেকে আড়াল করে রাখে।
শিশু ভিটিলিগো ভিকটিম বেশি সমস্যায় ভোগে অসচেতনতার কারণে। পাঁচ থেকে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা এ বিষয়ে কিছু জানে না। যেখানে ভিটিলিগো বিষয়ে সমাজের কুসংস্কার দূরীভূত হয়নি সেখানে শিশুদের সচেতনতার বিষয়টি আকাশকুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।
ভিটিলিগো নিয়ে কুসংস্কার
আমাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বৃহত্তর সামাজিক পরিমণ্ডলে ভিটিলিগো অজ্ঞতা এক ভয়াবহ দুর্ভোগ। এটি কোনো রোগ নয়। কিন্তু বিনা রোগে ভুগতে হবে ভিটিলিগো ভিকটিমদের। একইভাবে ভুগতে হবে তাদের আত্মীয়-স্বজন, প্রিয়জন ও শুভাকাক্সক্ষীদের। ভিটিলিগো ছোঁয়াচে নয়, এটিও আমাদের সমাজের মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না।
ভিটিলিগো নিয়ে প্রতারণা
ভিটিলিগো যেমন প্রাচীন ঠিক এই ভিটিলিগো নিয়ে প্রতারণাও শুরু হয়েছে প্রাচীনকাল থেকে। ফলে সমাজে প্রাচীনকাল থেকে ছড়িয়ে পড়েছে যে ভিটিলিগোরা অভিশপ্ত। চিকিৎসার অপর্যাপ্ততায় বিষয়টি নিয়ে চলে আসছে ঝাড়ফুঁক, জাদুটোনা, কবিরাজদের প্রচলিত প্রতারণা। আধুনিক যুগে চিকিৎসকদের চর্ম বা ডরমিটরি, প্লাস্টিক সার্জারি ও ফটোথেরাপি ইত্যাদি মুখরোচক যাবতীয় প্রতারণা। অর্থাৎ একজন ভিটিলিগো ভিকটিমকে শুরু থেকে মৃত্যু অবধি প্রতারণার সামাজিক জালে আবদ্ধ হতে হয়। এ তো গেল ভিটিলিগো নিজে প্রতারিত হচ্ছে অন্যদের দ্বারা। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে- ভিটিলিগো হওয়া মাত্র সে নিজে প্রতারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। কিভাবে? সে নিজের ভিটিলিগো গোপন করে, কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যে অন্যকে প্রতারণা করে। এ ঘটনা ঘটে সাধারণত বিয়ের ক্ষেত্রে। পরবর্তীতে প্রকাশিত হলে শুরু হয় মরণযন্ত্রণা, প্রতারক ও প্রতারণার শিকার উভয় ক্ষেত্রে।
ভিটিলিগো সচেতনতা কার্যক্রম
সারা বিশ্বে ভিটিলিগো ভিকটিমদের সংগঠনগুলো বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম চালু করেছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছে। একাধিক সংগঠন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে। যা সচেতনা সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা