১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

সিরিয়ায় আসাদের পতনের নেপথ্যে

-

ইসলামপন্থী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) দামেস্ক দখল করেছে। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ব আরেক স্বৈরশাসকের পতন প্রত্যক্ষ করল। আবু মোহাম্মদ আল-জোলানির শিকড় আলকায়েদার সাথে সম্পর্কিত। এই বিজয়ে ইসলামপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সিরিয়ার ভবিষ্যৎ, ইসরাইল ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তনও প্রত্যক্ষ করবে।
১৪ বছরের সঙ্ঘাতে বাশার আল-আসাদের সেনাবাহিনী অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। যুদ্ধে বহু সেনা নিহত হয়, অনেকে দলত্যাগ করে। সামরিক বাহিনীর মনোবল ভেঙে যায়। আসাদ যুদ্ধে রাশিয়া ও ইরানের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে এ ধরনের নির্ভরতা মারাত্মক।
রাশিয়া এ গৃহযুদ্ধে সিরিয়াকে যথেষ্ট সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। বিমানঘাঁটি, নৌঘাঁটিসহ সিরিয়ার সামরিক অবকাঠামোতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। এ অঞ্চলে রাশিয়ার শক্তি প্রদর্শনে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ছিল। রাশিয়া বিদ্রোহীদের অবস্থানে বিধ্বংসী বিমান অভিযান চালাত। এতে সিরিয়ার সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেত। রাশিয়া হাজার হাজার ভাড়াটে সেনা এবং নিয়মিত সেনাও মোতায়েন করে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে রাশিয়া সেনা ফিরিয়ে নেয়। আসাদ সে সামরিক ঘাটতি পূরণে অসমর্থ হন।
ইরানও সঙ্ঘাতের পুরো সময় সিরিয়াকে ব্যাপক সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিয়েছে, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইসলামিক রেভুল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি) এবং মিলিশিয়া বাহিনীসহ হাজার হাজার সেনা ও সামরিক উপদেষ্টা মোতায়েন করে। ইরান সিরিয়ার সরকারপন্থী মিলিশিয়া গ্রুপগুলোকেও সমর্থন দিয়েছে। এই গোষ্ঠীগুলো সঙ্ঘাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইসরাইলে আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণে পরিস্থিতি জটিল হলে ইরান নিজের দিকে মনোনিবেশ করে ফলে আসাদের শক্তি ক্ষীয়মান হয়ে পড়ে।
ইরান আসাদকে সহায়তা করার জন্য শক্তিশালী হিজবুল্লাহ প্রক্সি পাঠিয়েছে। যুদ্ধের পুরো সময় আসাদ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ছিল হিজবুল্লাহ। সম্প্রতি ইসরাইলের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে হিজবুল্লাহ সিরিয়া থেকে সেনাদের লেবাননে নিয়ে যায়। এতে আসাদ বাহিনী একরকম পঙ্গু হয়ে পড়ে। দু’টি বড় শক্তির যুগপৎ সরে আসার ফলে সৃষ্ট শূন্যস্থান আসাদ পূরণ করতে পারেননি।
আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল সরাসরি অংশ নেয়। আমেরিকার মিসাইল ও টমা হক আসাদের বিমান ঘাঁটিগুলো পঙ্গু করে দেয়। এমন কোনো সপ্তাহ ছিল না, ইসরাইলি বিমানবাহিনী সিরিয়ায় আক্রমণ করেনি। এই রকম বিপর্যয়ের সময়ে বিরোধী দলগুলো যৌথভাবে আসাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায়। বিশেষ করে আল-জোলানির হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। এইচটিএসের নেতৃত্বে এবং তুর্কি সমর্থিত দলগুলোর সমর্থনে বিরোধী বাহিনী সুসমন্বিত আক্রমণ চালায়। তারা দ্রুত কৌশলগত আলেপ্পোসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো দখল করে নেয়।
সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে দুর্নীতি ও লুটপাটের ফলে আসাদের ট্যাংক ও বিমানগুলো জ্বালানিহীন হয়ে পড়ে এবং সেনারা বেঁচে থাকার জন্য সম্পদ লুট করতে শুরু করে।

অর্থনীতিতে ধস
সিরিয়ায় ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধে ধ্বংস হয়েছে অর্থনীতি। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সব অবকাঠামো। ২০২০ সালে সিরিয়ায় প্রতি ডলারে পাওয়া যেত প্রায় এক হাজার ১৫০ সিরিয়ান পাউন্ড। কিছু দিন আগে সেটি দাঁড়ায় ১৪ হাজার ৭৫০ পাউন্ড, পতনের এক দিন আগে দাঁড়ায় ২২ হাজার পাউন্ডে।
জাতিসঙ্ঘ বলেছে, ৯০ শতাংশ সিরীয় দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। এরই মধ্যে হাজার হাজার সিরীয় উদ্বাস্তু তুরস্ক থেকে স্বদেশের দিকে রওনা দিয়েছে। নিজ দেশে তারা কোথায় থাকবে, কী খাবে কেউ জানে না। এ বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১.৫ শতাংশ হবে ২০২৩ সালে ছিল ১.২ শতাংশ। অর্থনীতির এ এক ভয়াবহ চিত্র। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এখান থেকে বেরিয়ে আসতে সিরিয়ার অর্থনীতির অন্তত এক দশক লাগবে।
সিরিয়ার অর্থনৈতিক পতনে বেশ কিছু আন্তঃসম্পর্কিত কারণও রয়েছে। যেমন- দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে বিশ্ববাজারে সিরিয়ার প্রবেশাধিকার সীমিত হয়ে পড়ে। বাণিজ্য ও বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষমতা সঙ্কুচিত হয়। লেবাননের ব্যাংকগুলো সিরিয়ার নগদ অর্থ আটকে রাখে। নগদ অর্থ উত্তোলন ও স্থানান্তরের উপর বিধিনিষেধ থাকায় সিরিয়ার অর্থনীতির উপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। তীব্র খরায় কৃষক কোনো সরবরাহ পায়নি। প্রান্তিক চাষিদের কপাল চাপড়ানো ছাড়া কিছু করার ছিল না। যুদ্ধ সিরিয়ার মধ্যবিত্ত শ্রেণীকেও সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে, যারা একসময় জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ ছিল। সিরিয়া একটি বিপর্যয়কর অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে পড়ে। আসাদের পক্ষে এর মোকাবেলা করা অসম্ভব ছিল।

তুরস্কের সম্পৃক্ততা
সিরিয়া সঙ্কটে তুরস্কের ভূমিকা জটিল। ২০১১ সালে শুরু হওয়া সিরিয়ার সঙ্ঘাতে তুরস্ক আসাদ সরকারের বিরোধীদের সমর্থন করে। এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সিরিয়ায় গণতান্ত্রিক রূপান্তর দেখার আকাক্সক্ষা, এ অঞ্চলে ইরানের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ এবং আসাদকে আরো তুরস্কবান্ধব করে তোলার কৌশলগত লক্ষ্য থেকে। তুরস্ক ফ্রি সিরিয়ান আর্মি (এফএসএ) এবং অন্যান্য বিরোধী গোষ্ঠীর প্রধান সমর্থক হয়ে ওঠে। তাদের সব ধরনের সহায়তা দেয়। এই সমর্থনের উদ্দেশ্য ছিল আসাদের ক্ষমতা দুর্বল করা এবং তুরস্ক সীমান্তে সহিংসতার বিস্তার রোধে একটি বাফার জোন তৈরি করা। ২০২৪ সালের হিসাবে, তুরস্ক ৩৬ লাখের বেশি সিরীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। এতে তুরস্কের অর্থনীতি, সামাজিক সেবা ও অবকাঠামোর ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে।
সিরিয়ায় তুরস্কের সরাসরি সামরিক সম্পৃক্ততা ২০১৬ সালে অপারেশন ইউফ্রেটিস শিল্ডের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল, যার লক্ষ্য ছিল সীমান্ত অঞ্চল থেকে আইএসআইএস জঙ্গিদের নির্মূল করা এবং কুর্দি ওয়াইপিজি (পিপলস প্রোটেকশন ইউনিট) তুরস্কের দক্ষিণ সীমান্তে একটি সংলগ্ন স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠা থেকে বিরত রাখা। ২০১৮ সালে অপারেশন অলিভ ব্রাঞ্চ এবং ২০১৯ সালে অপারেশন পিস ¯িপ্রংয়ের মতো পরবর্তী অভিযানগুলো কুর্দি বাহিনীর মোকাবেলায় তুরস্কের দৃঢ় সঙ্কল্প আরো স্পষ্ট করে তোলে। তুরস্কের কূটনৈতিক কৌশলগুলো যুদ্ধোত্তর সিরিয়ায় প্রভাব বজায় রাখা এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির উপস্থিতির পাল্টা ভারসাম্যসহ তার বৃহত্তর কৌশলগত লক্ষ্যগুলো প্রতিফলিত হবে বলে মনে হচ্ছে। সিরিয়ায় তুরস্কের সম্পৃক্ততায় অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার কারণও রয়েছে। সিরিয়া সঙ্কটে তুরস্কের ভূমিকা বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ হলেও এটি বিরোধীদের সমর্থন এবং কুর্দি প্রভাব মোকাবেলায় মুখ্য ছিল।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের ভূমিকা
সিরিয়া সঙ্কটে অনেক আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় জড়িত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের লক্ষ্যে ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তক্ষেপ করে। এই অপারেশনে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জর্দান, তুরস্ক, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াসহ আন্তর্জাতিক অংশীদারদের একটি জোট জড়িয়ে পড়ে। মার্কিন বাহিনী এসডিএফকে প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম ও বিমান সহায়তা সরবরাহ করেছিল, যা তাদের আইএসের নিয়ন্ত্রণ থেকে মূল অঞ্চলগুলো পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করেছিল।
আসাদের পতনের সাথে সাথে ইসরাইল গোলান মালভূমির বাফার জোন দখল করে পুরো গোলান মালভূমির কর্তৃত্ব নিয়েছে। একই সাথে আসাদের রাসায়নিক ও অস্ত্র কারখানা বোমা ও মিসাইলের আঘাতে তছনছ করে দেয়।
আসলে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর যোগদান ও বিভিন্ন দেশের স্বার্থ মিলে এক জটিল আবর্তের সৃষ্টি হয়। আসাদের পতনে দেশটিতে ৫৪ বছরের একনায়কতন্ত্রের অবসান হলো।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement

সকল