ইতিবাচক ধারায় এগোচ্ছে দেশ
- ড. মো: মিজানুর রহমান
- ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
৫ আগস্ট ২০২৪ এর বিপ্লবের পরে চার পাশ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত মতে, স্বৈরাচারী সরকার কেবল সম্পদ লুট নয়, বরং দেশের পুরো সিস্টেমটাই ধ্বংস করে গেছে। দেশের গভর্নেন্সের মূল পিলার, জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, ন্যায়পরায়ণতা ও স্বাধীনতার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জঘন্য ও অভিনব কায়দায় ম্যানিপুলেট করেছিল। গত ১৫ বছরে তিলে তিলে রাষ্ট্রের মৌলিক স্তম্ভ আইন, নির্বাহী ও বিচারব্যবস্থাসহ গণমাধ্যমকে ব্যাপকভাবে দলীয়করণ করা হয়। এক দিকে অযোগ্য ও অসৎ লোকদের দিয়ে দেশ শাসন করেছে, অন্য দিকে যোগ্য লোকদের ডাম্পিং করে রাখা হয়েছিল।
শুধু মৌলিক কাঠামো ধ্বংস করেই ওরা ক্ষান্ত হয়নি বরং দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভৌতিক ব্যবস্থা, কালচার, সভ্যতা, নৈতিকতা, মানবিক গুণসহ সব কিছু ধ্বংস করে দেশটিকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশটির ভাবমর্যাদা ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। প্রতিবেশী দেশটির সাথে বিভিন্ন অসম এবং দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি করে দেশটিকে কাশ্মির, হায়দরাবাদ অথবা সিকিমের ভাগ্যের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল। শেয়ারবাজার ধ্বংস, ব্যাংক ধ্বংস, রফতানিতে লুটপাট, প্রবাসী আয়ে ধস, শত বিলিয়ন ডলার বিদেশী ঋণ, টাকা ছাপিয়ে দেশীয় ঋণ নিয়ে লুটপাট এবং সর্বোপরি দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে দেশটিকে স্বাধীনতার পরপরের সেই তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করে ফেলেছিল। আল্লাহর রহমত, এ যাত্রায় দেশটি রক্ষা পেল। তবে তাদের ষড়যন্ত্র থেমে যায়নি; বরং জোরদার হয়েছে।
স্বৈরাচার বিতাড়িত হয়ে দেশ এখন মুক্ত; অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে। কিন্তু স্বৈরাচারের পতনের ফলে জনমানুষের আক্ষাক্সক্ষা আকাশচুম্বী। তাদের আকাক্সক্ষা একটি গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যার অন্যতম উপায় একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এর জন্য চাই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা। তবে এত রক্তদান, এত ত্যাগ কেবল একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিপ্লব নয়। সাথে দীর্ঘ ষোলো বছরে ধ্বংস করা রাষ্ট্রের প্রতিটি অরগান নতুন করে সংস্কার করতে হবে। কারণ কোনো দলীয় সরকার ক্ষমতায় এলে তারা সংস্কারের পরিবর্তে ভিন্ন কিছু করতে পারে। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশ প্রণয়ন প্রায় সমাপ্ত করে এনেছেন। আশা করা যায়, এই সুপারিশ সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ বহুলাংশে সহজ করবে।
স্বৈরাচারী শাসনামলে দলীয় ক্যাডারদের ব্যাপক পদায়ন জনপ্রশাসনকে দলের অঙ্গসংগঠন বানিয়ে ফেলে। এই প্রশাসনের নির্লজ্জ সহায়তায় ২০১৪ সালের অটো নির্বাচন, ২০১৮ সালের রাতের ভোট এবং ২০২৪ সালের বিনা ভোটের নির্বাচন হতে পেরেছে এবং স্বৈরশাসন দীর্ঘায়িত হয়েছে। ৫ আগস্ট স্বৈরাচারের পতন হলেও প্রশাসনের মূল কাঠামো অক্ষুণœ রয়ে গেছে। জাতীয় সংসদ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগে প্রায় সব কর্মকর্তা বহালতবিয়তে। সরকার ইতোমধ্যে ১৫ বছরের বঞ্চিতদের পদোন্নতির ব্যবস্থা নিয়েছে। পাবলিক সার্ভিস কমিশন পুনর্গঠন করেছে। সাইবার সিকিউরিটি আইনে আইনের অধীনে মিথ্যা মামলাগুলো প্রত্যাহার করেছে। এ ছাড়াও আইন, বিধিবিধান তৈরি ও সংশোধন এবং গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে সবচেয়ে বেশি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় পুলিশ প্রশাসনে। পুলিশের দায়িত্ব দিতে হয়েছে সেনাবাহিনীকে। অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে পুলিশ এখন অনেকটাই সক্রিয়। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিয়ে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চক্রান্ত দৃঢ়ভাবে সামাল দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বিপ্লব চলাকালে গণহত্যা এবং সব অপকর্ম, গুম, খুনের বিচারের তদন্ত কমিশন তথ্য সংগ্রহ করেছে। অপরাধীদের আন্তর্জাতিক আদালতেও বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে। গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে। সংঘটিত অপরাধের বিচারের জন্য বিভিন্ন জেলায় সহস্রাধিক প্রসিকিউটর এবং হাইকোর্টে নতুন বিচারক নিয়োগ দিয়েছে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল করেছে।
ইতিবাচক ধারায় অর্থনীতি
সরকারের দায়িত্ব গ্রহণকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল তলানিতে। গত তিন মাসে রিজার্ভে কোনো রকম হাত না দিয়েই প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ শোধ করা গেছে। জ্বালানি তেল আমদানির বকেয়া কমিয়ে আনা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা ইতোমধ্যে ঋণ ও অনুদান হিসেবে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। রাজস্ব আদায়ে জুলাইয়ের নেতিবাচক অবস্থা থেকে অক্টোবর নাগাদ পৌনে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য চেষ্টা করছে তবে বন্যায় ফসল নষ্ট হওয়া, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, অনেক ব্যবসায়ী পলাতক হওয়ায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে তেমন সফলতা আসেনি, তবে আরো বৃদ্ধি রোধ হয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকারের সুবিধাভোগী গার্মেন্ট মালিকদের প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা ইতোমধ্যে নিরসন করা হয়েছে। রফতানিমুখী শিল্পগুলোর অক্টোবর মাসে রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ২১ শতাংশ।
পরস্পরের যোগসাজশে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী পতিত সরকার ও তার দোসরদের পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রবাসীদের কল্যাণে কাজ হচ্ছে। ফলে রেমিট্যান্স আহরণ বেড়ে প্রতি মাসে দেড় বিলিয়ন ডলার থেকে এখন আড়াই বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
এই সরকারের সবচেয়ে বড় সফলতা দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে। বিশেষ করে ভারতের সাথে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ছিল একতরফা। ছিল নতজানু। বাংলাদেশকে প্রায় ভারতের অঙ্গরাজ্য বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। ভারতের প্রেসক্রিপশনে বাংলাদেশের নব্বই ভাগ মুসলমানের ধর্ম ইসলামকে প্রায় মুছে ফেলেছিল। অন্তর্বর্তী সরকার মাত্র চার মাসে বাংলাদেশ-ভারতের পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর ভারত বিভিন্নভাবে অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে ফ্যাসিস্ট সরকারকে আবার প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছিল। বাংলাদেশে ইসকনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনে হামলা এবং ভারতীয় সন্ত্রাসীরা বর্ডার ঠেলে জোর করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার মতো অপচেষ্টার প্রেক্ষিতে চলতি ডিসেম্বরের মাসের ৩ তারিখে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ডক্টর ইউনূসের আহ্বানে সর্বদলীয় ঐক্যের সভা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অভাবনীয় এবং প্রথম প্রচেষ্টা। তার পরই চলতি মাসের ১০ তারিখে ভারতে অবস্থিত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২৭টি দেশের হাইকমিশনারদের, যারা বাংলাদেশের জন্য ভিসা সার্ভিস দেয়, ঢাকায় এসে প্রধান উপদেষ্টার সাথে সভা করে বাংলাদেশের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম। এর প্রেক্ষিতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব স্বেচ্ছায় এসে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আগ্রহ প্রকাশ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির এক মাইলফলক।
স্বাধীনতার ৫২ বছর পরে বাংলাদেশ যেন নতুন করে স্বাধীন। মানুষ পেয়েছে প্রকৃত স্বাধীনতা, যে স্বাধীনতায় রয়েছে মুক্ত হাওয়ায় প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারা, রয়েছে স্বাধীনভাবে কথা বলা, মতপ্রকাশ করা, আনন্দ-উৎসব করা। সাথে নেই কোনো ক্রসফায়ারের ভয়, নেই কোনো গুমের ভয়, নেই কোনো খুনের ভয়। অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের কোটি জনতা স্বাধীন মতপ্রকাশের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার।
পরিশেষে বলতে হয়, এ সরকারকে ব্যর্থ করার মহা ষড়যন্ত্র প্রতি মুহূর্তে সক্রিয় রয়েছে। তার ওপর মূল্যস্ফীতি, শেয়ারবাজার, রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার তেমন উন্নতি হয়নি; এ বিষয়ে নজর দিতে হবে। একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে; তবে তা হতে হবে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে। এ জন্য ফ্যাসিস্টবিরোধী সব রাজনৈতিক দল, পক্ষ এবং আপামর ছাত্র-জনতাকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তা হলেই আসবে সত্যিকার গণতন্ত্র, রক্ষা পাবে সার্বভৌমত্ব।
লেখক : অর্থনীতিবিদ
ই-মেল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা