সংস্কার ও নির্বাচন : সঙ্ঘাত কোথায়?
- জিয়া আহমদ, এনডিসি
- ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো সংস্কার ও আগামী নির্বাচন। জুলাই ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের পরে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য এ বিষয় দু’টি এখন রীতিমতো মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ছাত্রসমাজের ‘কোটাবিরোধী’ আন্দোলেনের মধ্যে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু সাঈদ যখন ছাত্রদের দাবি আদায়ের আন্দোলনে বীরের মতো আত্মাহুতি দিলেন, তখন থেকে আন্দোলন একটি ভিন্নমাত্রায় পৌঁছে গেল। আবু সাঈদের নির্মম ও হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দেশের ছাত্রসমাজ যেমন চরমভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল, তেমনি দেশের আপামর জনসাধারণও ক্ষুব্ধ হয়ে এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে শুরু করল। পরপর ওয়াসিম, মুগ্ধ ও অন্যান্য তরুণের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই আন্দোলন প্রথমে ৯ দফার, পরে এক দফার আন্দোলনে রূপলাভ করল। অবশেষে এক হাজার ৬০০ তরুণের জীবন ও ২০ হাজারের বেশি তরুণের আহত/অঙ্গহানি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালাতে বাধ্য হলো। এরপর গঠিত হলো ডক্টর ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকেই পাদপ্রদীপের আলোর নিচে চলে আসা ছাত্র নেতৃত্ব বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংস্কারের বিষয়ে উচ্চকিত হওয়া শুরু করল। রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়টি কিন্তু নতুন নয়। এর আগে বিএনপির পক্ষ থেকে গত ১৩ জুলাই, ২০২৩ রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে ৩১ দফা কার্যক্রমের ঘোষণা দেয়া হয়। বস্তুত স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার তার ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার জন্য এ দেশের সব ক’টি প্রতিষ্ঠানকেই ধ্বংস করে ফেলেছিল। দেশের নির্বাচনব্যবস্থাপনা, দুর্নীতিদমন কমিশন, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, ব্যাংক খাত ও পুলিশসহ সব ক’টি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে আওয়ামী লীগ কর্মীদের নিয়োগ (বিশেষত গোপালি) দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে সম্পূর্ণ আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিল। ‘টাকার বিনিময়ে রায়’ বিক্রি করা বিচারকদের দিয়ে ফরমায়েশি রায় নিয়ে (এবং সেই রায়কেও পুরাপুরি না মেনে) সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের শাসনভারকে ‘চিরস্থায়ী’ করার প্রচেষ্টা নিয়েছিল। গণতান্ত্রিক বিশ্বের কোথাও দু’টি সংসদ একসাথে বিদ্যমান থাকার নজির না থাকলেও, বাংলাদেশে আমাদের তাও দেখতে হয়েছে।
সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনের জন্য ‘গণভোটের’ বিধান থাকলেও, তাকে বিলোপ করে সংবিধানের বড় একটি অংশকে ‘অপরিবর্তনীয়’ ঘোষণা করা হয়েছে। আরো হাস্যকর বিষয় হলো- সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত ‘Preamble’ বা ‘প্রস্তাবনা’ যা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা গ্রামে পাঠ করা হয়েছিল, তাকেও পরিবর্তন করা হয়েছিল। এগুলো নির্লজ্জ ইতিহাসবিকৃতি ছাড়া আর কিছু নয়। দেশে কোটাব্যবস্থা বিদ্যমান থাকাকালেও ফরিদপুর বিভাগের জেলাগুলো থেকে (বিশেষত গোপালগঞ্জ জেলা থেকে) অস্বাভাবিক হারে সরকারি ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ দিয়ে দেশে জনগণের চাকরির ভারসাম্য সম্পূর্ণভাবে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। এসব কারণে সরকার চাইলেও পরবর্তী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান করা যাবে কি না, তা নিয়েও জনমনে সংশয় রয়েছে। আর সে কারণেই সংস্কার এত গুরুত্বপূর্ণ।
এ বিষয়গুলোকে একটি সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য ডক্টর ইউনূসের সরকার প্রথমে ছয়টি এবং পরবর্তী সময়ে আরো পাঁচটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। প্রথম দফায় গঠিত সংস্কার কমিশনগুলো অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ এবং ওই কমিশনগুলোর সুপারিশসহ প্রতিবেদন আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে পাওয়ার কথা। সম্প্রতি জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে ডক্টর ইউনূস জানান, এই কমিশনগুলোর কাজ শুরু করতে বিলম্ব হওয়ায় রিপোর্ট পেতে একটু বিলম্ব হতে পারে। তবে, তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যে এই রিপোর্ট পাওয়া যাবে। তিনি দেশবাসীকে জানান যে, রিপোর্ট পাওয়ার পরপরই তিনি ও তার উপদেষ্টারা দেশের জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠক শুরু করবেন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে অনুষ্ঠেয় বৈঠকেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে নির্বাচনের আগে কোন কোন খাতে কতটুকু সংস্কার করা হবে। তিনি এ-ও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি নির্বাচনের আগে কোনো সংস্কার করতে না আগ্রহী হয়, তাহলে তিনি ও তার সরকার একটি নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যাবেন। এ পর্যন্ত তো কোথাও সমস্যা দেখি না। তাহলে?
সমস্যাটা শুরু হয়েছে পরবর্তী নির্বাচনের সময় ও সম্ভাব্য তারিখ নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টার বিভিন্ন বক্তব্যে। উপদেষ্টাদের বক্তব্য অনুযায়ী আগামী নির্বাচন আগামী ডিসেম্বর ২০২৫-এ যেমন হতে পারে, তা আবার ২০২৯-এর জানুয়ারিতেও হতে পারে। অন্তত তিনজন উপদেষ্টা তিনটি সম্ভাব্য তারিখের কথা বলেছেন। আবার একজন উপদেষ্টা অন্য উপদেষ্টার বক্তব্যকে ব্যক্তিগত মত বলেও বাতিল করে দিয়েছেন। জুলাই ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের সমন্বয়কদের কেউ কেউ সংস্কার ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না মর্মে বলছেন এবং তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দলও প্রতিষ্ঠা করছেন মর্মে শোনা যাচ্ছে। এসব কারণে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম ‘ইউটিউবের’ বিভিন্ন চ্যানেলে নির্বাচনের আগে না পরে সংস্কার, তার পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলাপ-আলোচনা চলছে। এর মধ্যে পতিত স্বৈরাচারের কিছু দালাল গণ-অভ্যুত্থানের সপক্ষের শক্তিগুলোর মধ্যে বিভেদ ও ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করার অবিরত চেষ্টা করে চলেছে। গত ১৫-১৬ বছরে কঠোর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও বিভিন্ন কালাকানুনের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকার দেশের প্রেস ও টিভি মিডিয়াকে কণ্ঠরুদ্ধ করে রেখেছিল। ফলে দেশের মানুষের রাজনৈতিক খবর ও প্রকৃত তথ্য জানার জন্য সোস্যাল মিডিয়ার ওপর নির্ভরশীল হওয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না। তাদের মতপ্রকাশের জায়গাও ছিল সর্বোচ্চ ওই সোস্যাল মিডিয়া।
বর্তমানে মূল সংবাদমাধ্যমগুলো স্বাধীন হলেও দেশের মানুষ পুরনো অভ্যাসের কারণে এখনো সোস্যাল মিডিয়ার ওপর বেশ কিছুটা নির্ভর করে। এই সুযোগটা নিচ্ছে পতিত স্বৈরাচার ও তার অনুগতরা। তারা প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে মিথ্যা ছড়িয়ে দিচ্ছে এই সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। এগুলোর সাথে যোগ হয়েছে কিছু বর্ণচোরা ‘ইউটিউবার’। তারা নানা গুজব ও বিভ্রান্তিমূলক কনটেন্ট প্রচারের মাধ্যমে দেশের জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে তাদের ঐক্যকে বিনষ্ট ও গণ-অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষাগুলোকে ধূলিসাৎ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই গুজবগুলোর অনেকটাই দেশের পরবর্তী নির্বাচন ও সংস্কারকে ঘিরে।
সংস্কার তো আসমান থেকে নাজিল হওয়ার মতো কোনো বিষয় নয়। এ দেশের রাজনীতিসচেতন মানুষের পরিষ্কার ধারণা আছে কী কী সংস্কার করলে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। মোটাদাগে এ জন্য চাই মেরুদণ্ড সোজা করে চলতে সক্ষম মানুষের সমন্বয়ে গঠিত একটি নির্বাচন কমিশন, ‘আরপিও’র প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতায়ন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ। সবচেয়ে আগে প্রয়োজন নির্বাচন কমিশন, দুদকসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনীয় অর্থের সাংবিধানিক নিশ্চয়তার বন্দোবস্ত। এই কমিশনগুলোর ঐতিহাসিক ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হলো অর্থের জন্য সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা।
সম্প্রতি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা মুখ খুলছেন। আমাদের নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, তিনি তার শপথের মর্যাদা রাখবেন এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দিতে পারবেন। তিনি আরো বলেছেন, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। তিনি বলেন, গঠিত সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করে সর্বসম্মত ও প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করেই নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হবে। এ ছাড়া ভোটার তালিকা হালনাগাদ করাও জরুরি। সম্প্রতি আমাদের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব নির্বাচনের সময় সম্পর্কে বলছেন, প্রধান উপদেষ্টাই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন। অন্য উপদেষ্টারা যা বলছেন, তা তাদের ব্যক্তিগত মত। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার ‘এক্স-হ্যান্ডেলে’ প্রেরিত এক বার্তায় বলেছেন, দেশের জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারই দেশ পুনর্গঠন করতে পারে। তিনি আরো বলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সম্মান দিতে হবে এবং তাদেরকেও জন-আকাক্সক্ষা অনুধাবন করে কাজ করতে হবে। তিনি বলেছেন, একজন সংস্কার শুরু করবেন, অন্যেরা তা এগিয়ে নিয়ে যাবেন। একজনই সব সংস্কার করবেন, তা যেমন প্রত্যাশিত নয় তেমনি বাস্তবসম্মতও নয়। একই সাথে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, নির্বাচন বিলম্বিত হলে পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের ষড়যন্ত্র করার জন্য অনুকূল ও দীর্ঘ সময় দেয়া হবে, যা এই গণ-অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। আমরা প্রতিদিন প্রকাশিত নতুন নতুন ষড়যন্ত্রের দেখছি। আর সংস্কার ও নির্বাচন তো পরস্পর-বিযুক্ত (MutuallyExclusive) কোনো বিষয় নয়।
প্রধান দল বিএনপির অন্যতম চাওয়া হলো নির্বাচনের ‘রোডম্যাপ’। সরকারের তরফ থেকে এই রোডম্যাপ দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা দেখি না। ‘রোডম্যাপ’ মানে আজকাল বা তিন মাসের মধ্যেই নির্বাচন হবে এমনটি তো নয়। এটি ছয় মাস বা এক বছর পরও হতে পারে। কিন্তু একটি রোডম্যাপ থাকলে রাজনৈতিক দলগুলোর পরিকল্পনা করতে যেমন সুবিধা হয়, তেমনি নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে তাদের মনের সংশয়ও দূর হয়।
বর্তমানে বিভিন্ন গ্রুপ নানা দাবিদাওয়া নিয়ে প্রতিদিন ঢাকার রাজপথ অবরুদ্ধ করে শহরটিকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে, যার পেছনে পতিত স্বৈরাচারের মদদের সংবাদও পাওয়া যাচ্ছে। এ সময় আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে পতিত স্বৈরাচারের সব অশুভ পরিকল্পনাকে রুখে দিতে হবে। এ প্রেক্ষাপটে সরকারের তরফ থেকে নতুন কোনো ইস্যু সৃষ্টি করা বাঞ্ছনীয় নয়। আমরা আশা করব, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা তার প্রতিশ্রুতিমতো আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্ট পাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের একটি অগ্রাধিকার তালিকা প্রণয়ন করবেন। একই সাথে তিনি আগামী নির্বাচনের ‘রোডম্যাপ’ও ঘোষণা করবেন। এতে দেশের রাজনৈতিক দল ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্ঘাতের আশঙ্কা দূর হবে এবং দেশের মানুষের মনেও স্বস্তি ফিরে আসবে।
লেখক : সাবেক সরকারি কর্মচারী ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা