১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

নেকড়েপুরাণ

উৎসের উচ্চারণ
-

পূর্ণিমার চাঁদের দিকে চোখ রেখে নেকড়েরা চিৎকার করছে। তারা কোন বেদনা বা আনন্দের উদযাপন করছে? দশ মাইল দূর থেকে শোনা যায় নেকড়ে দলের ডাক। তারা কি কাঁদছে? তাদের কি খুব দুঃখ? তাদের কি কোনো দুর্বলতা? নেকড়েদের নিয়ে ভাবছিলাম। তাদের ক্লান্তি, হতাশা, নৈরাশ্য, অবকাশ, আলস্য, অনিদ্রা, অপ্রেম, মৃত্যু ও বিচ্ছেদের ব্যাখ্যা করছিলাম। তারা কি এসবেরই মুখোমুখি হয়ে ডাকে অথবা কাঁদে?
নেকড়েরা মূলত চিৎকার করে যোগাযোগের জন্য। তাদের যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে অন্তর্ভেদী চিৎকার। চাঁদের নিচে নেকড়েরা স্বপ্নচারী। তাদের রক্তের মধ্যে খেলা করে যে সংবেদ, তার বিহ্বলতাকে দেখা যায় নেকড়ের চোখে। শব্দের চেয়ে দৃষ্টি তাদের প্রিয় মাতৃভাষা।
কিন্তু দৃষ্টির চেয়ে গন্ধ তাদের অধিক ব্যবহৃত ভাষা। কারণ তারা শরীর থেকে সৃষ্টি করে ঘ্রাণ। সেই ঘ্রাণ দিয়ে চাঁদের নিচে বহু দূরের পাহাড়ে বিহ্বল নেকড়ের কাছে পাঠিয়ে দেয় নিজের বিহ্বলতা। ঘ্রাণ থেকে বার্তা পাঠ করতে পারে তারা। মানুষের চেয়ে নেকড়ের ঘ্রাণশক্তি ১০০ গুণ বেশি।
কিন্তু কোথা থেকে জন্ম নেয় তাদের ঘ্রাণ? নেকড়েদের ঘ্রাণের মূলে আছে তাদের প্রস্রাব। নিজেদের প্রস্রাব দিয়ে নেকড়েরা চিহ্নিত করে আপন রাজ্যসীমা। রাজত্বের সীমা কত বড় হবে, তা শিকারের প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে। একেক অঞ্চল ৫০ থেকে ১০০০ বর্গমাইলেরও বেশি পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে।
নেকড়েরা বসবাস করে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে। একেক গোষ্ঠীতে থাকে সাত থেকে দশ নেকড়ে। সেখানে থাকে মা-বাবা, সন্তান। শিকার করা, মা-বাবার দেখভাল করা, সন্তান লালন-পালন, নিরাপত্তার সুরক্ষা ইত্যাদি সবাই একসাথে করে তারা। কুকুর গোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় প্রাণী নেকড়ে। নেকড়ের ইংরেজি নাম the wolf. এদের বৈজ্ঞানিক নাম Canis lupus. এদের উচ্চতা আড়াই ফুটের কাছাকাছি। লম্বায় তিন থেকে সাড়ে তিনফুট হয়। ওজন ১৮ থেকে ২৭ কেজি। চোখ হলুদাভ। জংলি হলেও খোলা প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায়। সারাদিনে প্রায় ১২ মাইল এলাকা বিচরণ করে নেকড়ে। কখনো কখনো এক দিনে ২০ মাইলেরও বেশি পথ পাড়ি দিতে পারে। নেকড়েদের পা বেশ লম্বা হয় এবং এরা দিনের বেশির ভাগ সময়ই খুব ধীরগতিতে দৌড়ে কাটায়। তবে যখন কোনো শিকারের পিছু নেয়, তখন ঘণ্টায় ৬৫ কিলোমিটার বেগেও দৌড়াতে পারে। কিন্তু শিকার ধরতে গতির চেয়ে কৌশলকে বেশি ব্যবহার করে তারা। সাধারণত শেষ আক্রমণের আগে শিকারকে তারা ক্লান্ত করে ফেলে। বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে ধূসর নেকড়েরাই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এদের গড় ওজন ৪০ কেজি। এ পর্যন্ত খোঁজ পাওয়া সবচেয়ে বড় নেকড়েটির ওজন ৮০ কেজির বেশি। সামাজিকতা ও দায়িত্বশীলতার জন্য নেকড়েরা বিখ্যাত। তাদের সমাজে পদমর্যাদা রয়েছে। সামাজিক স্তরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে নেকড়েদের আলফা জুটি। তারা গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দেয়, সিদ্ধান্ত নেয় এবং দলের কল্যাণ নিশ্চিত করে। তাদের নিচে থাকে সন্তান নেকড়েরা। তারা শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সাহায্য করে। সবার নিচে থাকে ওমেগা নেকড়ে। সে হলো অনেকটা যুদ্ধবন্দী বা দাসের মতো। সে হয়তো একদা কোনো গোষ্ঠীর আলফা নেকড়ে ছিল। কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সে নিজের ভূমি হারিয়েছে এবং বিজয়ীদের ভূমি ও গোষ্ঠীতে বসবাসে বাধ্য হচ্ছে। এই নেকড়েরা প্রায়ই বলির পাঁঠা হিসেবে কাজ করে। তাদের খাটুনি দলের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বড় নেকড়ে তাদের ছোট ভাইবোনদের জন্য খাবার জোগাড় করে। তাদের যত্ন নেয়। বাচ্চা নেকড়ে মা-বাবার দলে থাকে কমপক্ষে দুই বছর। মা-বাবা নিজের ছানাদের বেড়ে ওঠা তদারকি করে, তাদের শেখায় নানাবিধ দক্ষতা। শেখার এ সময়টা খুব আনন্দের। লাফালাফি, দৌড়ঝাঁপ, একে অন্যকে তাড়া করা, লুকোচুরি খেলা, কুস্তি, খুনসুটি ইত্যাদির মধ্যে বাচ্চারা পারিবারিক আবহে বিকশিত হয়। শিখে নেয় দায়-দায়িত্ব ও প্রথাপদ্ধতি। তাকে এ সময়ের মধ্যে শেখানো হয় ক্ষুধা মেটানোর জন্য শিকার করা, পানির অবস্থান খুঁজে বের করা, রাতে আশ্রয় নেয়ার মতো গুহার খোঁজ করা, নিজেকে অন্য প্রাণীর থেকে বাঁচানোর কৌশল। দুই বছর পরে বাচ্চারা চাইলে কেউ অন্য দলে যোগ দেবে কিংবা নিজেদের দলেই থেকে যাবে।
পাহাড়ের পাদদেশে বিভিন্ন গুহার গর্তে বাস করে এরা। কষ্টসহিষ্ণুতা তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। নেকড়েরা না খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে এক সপ্তাহেরও বেশি। এরা খাবার থেকে দ্রুত শক্তি উৎপাদন করতে পারে, দীর্ঘ সময় সক্ষম থাকতে পারে না খেয়ে। তারা নিজেদের দেহে ঘ্রেলিন (Ghrelin) নামে একধরনের হরমোন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ঘ্রেলিন একধরনের ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন। নেকড়েরা শরীরে প্রচুর পরিমাণে চর্বি জমা করে। কখনো খাবারের অভাব হলে এই চর্বি কাজ করে শরীরের শক্তির প্রধান উৎস হিসেবে।
তবে খাবার-দাবারে নেকড়েরা বেশ খান্দানি। এক বসায় তারা প্রায় ২০ পাউন্ড মাংস খেয়ে ফেলতে পারে। দলবদ্ধভাবে হরিণ, শূকর, বনগাইও শিকার করে নেকড়েরা। একা শিকার করতে বের হলে কাঠবিড়ালি বা খরগোশের মতো ছোট ছোট প্রাণীও শিকার করে। তবে ভোজন করতে হয় সবাই মিলে। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের পাশাপাশি পাখি, মাছ, সরীসৃপ ও ফলমূল খায় নেকড়েরা। খাদ্যাভ্যাসের এই নমনীয়তা তাদের বিভিন্ন পরিবেশে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। তবে খাবারেরও আদব আছে। শিকার ধরার পর দলপতি এবং তার সঙ্গী প্রথমে খায়। তারপরে ক্রমেই বাকিরা খাবারের ভাগ পায়।
নেকড়েদের একেক গোষ্ঠীর একেক অঞ্চল। প্রতিটি অঞ্চলের আছে সীমান্ত, রাজধানী। সীমান্তরেখা চিহ্নিত হয় নেকড়েদের প্রস্রাব দিয়ে। রাজধানী হয় না রাজা ছাড়া। নেকড়েদের গোষ্ঠীতে রাজা থাকবেই।
নেকড়ে যখন চিৎকার করে, তখন হয়তো সে নেতার তরফে ঘোষণা করছে কোনো বার্তা। অন্যেরা প্রতিধ্বনি করে সমর্থন বা অসমর্থন জানাবে। এটি তাদের গণতন্ত্র।
আবার নতুন কোনো নেতা নির্বাচিত হলে চিৎকার করেই জানাতে হয় রাজ্যময়। অন্যেরা প্রতিধ্বনি করে অভিনন্দন জানাবে। এটি রাজার অভিষেক।
নেকড়ের চিৎকার হয়তো গোটা রাজ্যে কারো নবজন্মের ঘোষণার জন্য। কারণ কোনো নেকড়ে শাবক জন্ম নিলে রাজ্যময় ঘোষণা করাই নিয়ম। অন্যরা প্রতিধ্বনি করে নবাগতের জন্য শুভবাদ জানাবে। এটি তাদের নবীন বরণ।
প্রতিটি নেকড়ে রাজ্যের আছে আলাদা ডাকভঙ্গি। একদলের ডাক আরেক দলের হুবহু হতে পারে না। ডাকের শুরুতে, মধ্যখানে বা সমাপ্তি বিন্দুতে পার্থক্য থাকবে। এটি তাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য।
তাদের প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম হাউলিং, যা শুধু একের প্রতি অন্যের ডাক নয়, বরং এটি দূরত্বের ওপর দিয়ে গোষ্ঠী সদস্যদের সাথে যোগাযোগের ওপায়। প্রতিটি হাউল আলাদা অর্থবহ, যা নেকড়েদের পৃথক কণ্ঠস্বর, বিষয়বস্তু এবং প্রয়োজনের মাত্রা ও ধরন বুঝতে সাহায্য করে। এটি তাদের ভাষিক অনন্যতা।
দুই বছর বয়সী নেকড়ে সিদ্ধান্ত নেবে সে তার পূর্বপুরুষের গোষ্ঠীতে থাকবে না নতুন গোষ্ঠীতে যোগ দেবে। এটি তার স্বাধীনতা।
সে চাইলে নতুন গোষ্ঠী তৈরির কাজও শুরু করতে পারে। যদিও এটা কঠিন, বিপদে পূর্ণ। কিন্তু এ বিপদ মাড়ানোর মধ্য দিয়ে তৈরি হয় নতুন উপদল। এ জন্য একটি নেকড়েকে প্রথমে একা হতে হয়, সঙ্গী খুঁজতে হয়। বড় দলের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার ঝুঁকি নিতে হয়। কিন্তু কঠিন এই যাত্রায় পা বাড়ায় বহু নেকড়ে। এটি তাদের সৃষ্টিশীলতা।
সে চাইলে পূর্বপুরুষের গোষ্ঠীতে অবস্থান করে নেতৃত্বের স্বপ্নও দেখতে পারে। প্রত্যেক শক্তিশালী তরুণ নেকড়ে গোষ্ঠীপ্রধানকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। এটি তার আপন সক্ষমতার যাচাই।
যুদ্ধ করতে হবে বলেও চিৎকার করে নেকড়ে। সে চিৎকার আসে রাজার তরফে। সবাইকে প্রস্তুত করার জন্য। কিন্তু প্রস্তুত নেকড়েরা যুদ্ধ করে কোনো হাঁকডাক না করেই। এটি তাদের রণকৌশল।
দেহভঙ্গি নেকড়েদের প্রধান এক ভাষা। কোনো নেকড়ে মাথা ও লেজ উঁচিয়ে রাখছে, খাড়া রাখছে কান দু’টি। এর মানে সে কোনো কথা না বলেই বলছে, আমি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় সে এমনটি করে বেশি।
কোনো নেকড়ে শরীর নিচু করে রাখছে, লেজ দুই পায়ের মাঝখান দিয়ে নিচের দিকে ঝুলে থাকছে। কান দু’টিকে করে রাখছে চ্যাপ্টা। এর মানে সে ভয় পেয়েছে। সে নতি স্বীকার করছে।
যখন সে শরীরকে ধনুকের মতো করে ফেলছে, তখন সে খেলার অভিপ্রায় জানাচ্ছে। কিংবা প্রকাশ করছে আপন আনন্দ।
যখন কপাল চাপড়াচ্ছে বা গর্জন করছে, তখন সে রেগে গেছে। তার ক্রোধ থেকে সাবধান। নেকড়ের ক্রোধ খুব ভয়ানক।
কিন্তু তার মমতা? একটি নেকড়ে সাধারণত বেঁচে থাকে ছয় থেকে আট বছর। এই ক্ষুদ্র জীবনে তাকে করতে হয় শত শত লড়াই। এই সব লড়াইয়ে আহত হতে হয়, রক্তাক্ত হতে হয়। নিতে হয় প্রাণের ঝুঁকি।
নেকড়ের এসব যুদ্ধের অধিকাংশই নিজের জন্য নয়। সেগুলো ঘটে নিজের ছোট-বড় ভাইবোন ও স্বগোত্রীয়দের দেখাশোনা, সম্মান রক্ষার জন্য। সন্তানাদির জন্য নেকড়েকে ব্যস্ত থাকতে হয়। বৃদ্ধ মা-বাবাকেও একা ফেলে দেয় না নেকড়েরা। তাদের দেখভাল করে, খাদ্য জোগায়। এ জন্য করতে হয় বহু যুদ্ধ, স্বীকার করতে হয় বহু ত্যাগ! সে তার মা ও বোনকে সব সময় মা ও বোন হিসেবে দেখে। শুধু তাদের জীবন নয়, বরং তাদের সম্ভ্রমও রক্ষা করে। একে অপরকে রক্ষা করার জন্য নেকড়েরাই নিজেদের জীবন সবচেয়ে বেশি বিপন্ন করে।
নেকড়েদের যুদ্ধমুখর জীবনের গল্প যখন করছি, কে যেন বলল, মানুষও তো জীবনভর লড়াই করে চলে। প্রতিদিনের প্রাণান্তকর প্রয়াস একেকটি যুদ্ধের নামান্তর। বললাম, মানুষ প্রতিদিনই যুদ্ধ করে বটে। কিন্তু তাদের অধিকাংশ যুদ্ধ হয়ে থাকে অন্যের নিরাপত্তার বিনাশ, সম্মানহানি ও খাবার কেড়ে নেয়ার জন্য!
বুদ্ধিমত্তা, সামাজিক কাঠামো ও খাপখাওয়ানোর ক্ষমতা নেকড়েদের করেছে বনের আকর্ষণীয় প্রাণী। তুর্কিরা সিংহের চেয়ে নেকড়েকে অধিকতর ভালো দৃষ্টান্ত মনে করে। কারণ শক্তিশালী ও ভয়ঙ্কর হবার চেয়ে দক্ষ ও দায়িত্বশীল হওয়া বেশি জরুরি।
লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement