১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ইবনে খালদুনের আসাবিয়া এবং বাশার আল আসাদের পতন

-

২৭ নভেম্বর হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) নেতৃত্বে সশস্ত্র বিরোধী দলগুলোর একটি জোট সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমে আলেপ্পো ও ইদলিব প্রদেশে সরকার-নিয়ন্ত্রিত অবস্থানের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে। দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের মাঝে তারা দামেস্ক দখল করে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ ও তার পরিবার রাশিয়া পালিয়ে যায়।
সিরীয় সরকারের সেনাবাহিনীর দ্রুত ভেঙে পড়াটা ছিল দৃশ্যমান দ্রুত। এটি আফগানিস্তান ও ইরাকের পতনের কথা মনে করিয়ে দেয়। মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহারের পর তালেবান আফগান সরকারের কাছ থেকে কাবুল দখল করে নেয়। তেমনি ইরাকে ২০১৪ সালে আইএসআইএল (আইএসআইএস) আক্রমণ করে রাতারাতি ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুল দখল করে নেয়।
এইচটিএস, তালেবান ও আইএসআইএলের (আইএসআইএস) সাফল্যের অন্যতম কারণ ঐক্যবদ্ধতা ও অভ্যন্তরীণ সংহতি। ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন এটিকে বলেন ‘আসাবিয়া’। ইরাক ও আফগানিস্তানের মতোই সিরিয়ার সেনাবাহিনী রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও দুর্নীতিকে প্রাধান্য দিয়েছিল, যা বিদেশী বাহিনীর সমর্থনের অভাবে দেশগুলোকে অস্থিতিশীল ও অকার্যকর করে তুলেছিল। বাশার আল আসাদের দুর্বল শাসনব্যবস্থার পাশাপাশি অন্যায় ও অজনপ্রিয় শাসনের ফলে দুর্বল হয়ে যাওয়া সিরিয়ার সামরিক বাহিনী সুসংগঠিত সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সামনে দাঁড়াতেই পারেনি।
অভিভাবকহীনতা ও হীন মনোবল
বছরের পর বছর ধরে সিরিয়ার বিরোধী দল বিভিন্ন বিভক্তি ও দ্বন্দ্বে ভুগে সিরিয়ার শাসকদের কাছে বিভিন্ন স্থলভাগের দখল হারায়। ২০২০ সালের পরে দ্বন্দ্বটি ‘হিমায়িত’ হওয়ার সুযোগে বিরোধীদের বিশেষ করে এইচটিএসকে একত্রীকরণ ও পুনর্গঠিত করার সুযোগ এনে দেয়। বহু বছর ধরে অবস্থার অবনতি থাকা সত্ত্বেও বিরোধী দলগুলো সিরিয়ার শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার আশা ও উৎসাহ হারায়নি।
বিরোধীরা পরস্পর নির্ভরশীল হয়েছিল, যা ইবনে খালদুন ১৪ শতকেই বর্ণনা করেছিলেন। ইবনে খালদুনের মতে, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এমন একটি মূল উপাদান, যা একটি উপজাতীয় শক্তিকে পুরো রাজ্য দখল করতে যথেষ্ট শক্তিশালী করে। তিনি মঙ্গোল নেতা তৈমুরের মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ ভূমিসহ ভারত, পারস্য, ইরাক ও আনাতোলিয়ার কিছু অংশ দখল করার নেপথ্য কারণ হিসেবে এ কথা বর্ণনা করেছিলেন। ১৪০০ সালে তৈমুরের বাহিনী আলেপ্পো দখল করে এবং তার পর বিদ্যুৎগতিতে আক্রমণ করে হামা ও হোমস দখল করে। অবশেষে দামেস্ক ১৪০০ সালের ডিসেম্বরে কোনো প্রকার যুদ্ধ ছাড়াই তৈমুরের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং অজনপ্রিয় মামলুক সুলতান শহর ছেড়ে পালিয়ে যান।
সিরিয়ার বিরোধীদের ক্ষেত্রে তাদের মনোবল কেবল অভ্যন্তরীণ সংহতির মাধ্যমেই নয়, বরং তারা জাতীয় মুক্তির জন্য লড়াই করছে এমন ধারণার মাধ্যমেও বৃদ্ধি পেয়েছিল। বিপরীতে সিরিয়ার সামরিক বাহিনী হীন মনোবলে ভুগছিল। সেনাবাহিনীর বেশির ভাগ লোককেই বলপ্রয়োগ করে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। যাদের মধ্যে অনেককেই গ্রেফতার ও নির্যাতনের পর চাকরি করতে বাধ্য করা হয়েছিল। তাই সিরিয়ার হীন মনোবল এক লাখ ৩০ হাজারের বিশাল সেনাবাহিনী উদ্যমী ৩০ হাজার বিদ্রোহী যোদ্ধার সামনে দাঁড়ানোর সুযোগই পায়নি। ঠিক এমনটিই হয়েছিল আফগানিস্তানে ৬০ হাজার তালেবানের বিপরীতে তিন লাখ সদস্যের শক্তিশালী আফগান সেনাবাহিনী এবং ৩০ হাজার সদস্যের শক্তিশালী ইরাকি বাহিনীর বিপরীতে মাত্র দেড় হাজার আইএসআইএল (আইএসআইএস) যোদ্ধা মসুলে আক্রমণের সময়।
সিরিয়ার সেনাবাহিনী বাস্তবে বিশাল সৈন্যসংখ্যার ঘাটতি লুকিয়ে রাখত। সিরিয়ার সেনাবাহিনী ইরাকি ও আফগানদের মতো দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছিল। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য সমস্যা ছিল ‘ভূত সৈন্য’। কাল্পনিক নাম সৈন্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করে অফিসাররা অতিরিক্ত বেতনের চেক সংগ্রহ করতেন। এ চর্চাটি শুরু হওয়ার কারণ ছিল সামরিক বাহিনীগুলোকে পুরস্কৃত করা হতো আনুগত্যের কারণে, সামরিক কাজের জন্য নয়। তাই সেই অফিসাররা ‘ভূত সৈন্যের’ মাধ্যমে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে অথবা বেসামরিক জনগণের ওপর অত্যাচার করে অবৈধ সম্পদ বৃদ্ধি করতে থাকে।
একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাজবংশের পতন
মিসর যখন ১৯৭৯ সালে ইসরাইলের সাথে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে, তখন বাশারের বাবা তৎকালীন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদ আরব সামরিক জোট ছেড়ে দেন এবং একতরফাভাবে একটি বিশাল সামরিক বাহিনী গড়ে তোলেন। এ অঞ্চলে তার প্রধান শত্রু ইসরাইলকে রোধ করতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি ও বিমানের একটি বহর, ব্যালিস্টিক স্কাড ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছিল। সিরিয়া ইসরাইলের পারমাণবিক অস্ত্রের সাথে তাল মেলাতে রাসায়নিক অস্ত্র কর্মসূচিও তৈরি করেছিল।
তথাপি এই অস্ত্রগুলি ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচলিত যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়নি। পরিবর্তে এই বিশাল সামরিক শক্তি সিরিয়ার জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। প্রথমে হামা বিদ্রোহের সময় হাফেজের শাসনের সময়ে এবং তারপর ২০১১ সালে সিরিয়ার বিপ্লবের সময় বাশারের শাসনের সময়ে। ইসরাইলি সামরিক বাহিনীকে মারাত্মক ক্ষতি করতে তৈরি করা অস্ত্রগুলি সিরিয়ার বেসামরিক লোকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। এমনকি বাশার আল আসাদ সিরিয়ার শহরগুলোতে তার দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক স্কাড ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিলেন।
যখন সামরিক বাহিনী দিয়ে সিরিয়া জনগণকে গণহত্যা করা হচ্ছিল, তখন অর্ধেকের বেশি অফিসার ও সৈন্য পদত্যাগ করে। তখন আল আসাদ সরকার তার পক্ষে লড়াই করতে বিদেশী সেনাবাহিনী আমদানি করে। বিদেশী সেনাদের মাঝে হিজবুল্লাহর লেবানিজ যোদ্ধা, ভাড়াটে ওয়াগনার গ্রুপের রুশ যোদ্ধারা, বিভিন্ন ইরানপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী রুশ বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়। বিদেশী বাহিনী বিদ্রোহীদের হটিয়ে দিতে এবং আল আসাদ সরকারকে সুরক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছিল। এর ফলে তাদের মনে একটা মারাত্মক ভুল ধারণা হয়েছিল যে তারা পেশি শক্তি দিয়ে চিরকাল রাজত্ব করতে পারবে। আসাদ সরকার জনগণকে সুশাসন বা নাগরিক সুবিধা দিয়ে বৈধতা পুনরুদ্ধার করার চেষ্টাও করেনি। সিরিয়ার অর্থনীতির ক্রমাগত পতন অব্যাহত থাকায় এবং জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী হওয়ায় অল্প কিছু নাগরিক পরিষেবা ছাড়া প্রায় কোনো নিরাপত্তা দিতে পারত না আসাদ সরকার।
আসাদ সরকার সেনাবাহিনীর সাথেও একই ধরনের অবহেলা করে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত সৈন্যরা ১০ হাজার সিরিয়ান লিরা বা ০.৭৫ ডলার বোনাস পেয়েছিলেন। সরকার পতনের তিন দিন আগে সামরিক বাহিনীতে বেতন ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে মনোবল বাড়ানোর শেষ চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু এ পদক্ষেপ কোনো ধরনের প্রভাব ফেলেনি বলে প্রমাণিত হয়েছে।
সিরিয়ার সামরিক বাহিনী তার নিজের জনগণের বিরুদ্ধে এক দশক ধরে যুদ্ধ চালানোর পরে ২০২৪ সালে আর একটি দশকব্যাপী যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক ছিল না। আল আসাদের পক্ষে যুদ্ধ করতে বিদেশী বাহিনী আর পাশে না থাকায় সিরিয়ার সৈন্যদের প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এর ফলে বিদ্রোহীরা একে একে শহরের পর শহর দখল করার একপর্যায় দামেস্কও দখল করে নেয়। তখন সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের সামরিক ইউনিফর্মগুলো ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে বেসামরিক পোশাক পরিধান করে পালিয়ে যায়।
প্রায় ৭০০ বছর আগে ইবনে খালদুন যেমন দেখেছিলেন দুর্নীতি আসাবিয়াকে হত্যা করতে পারে এবং পুরো রাজবংশের দ্রুত পতন ঘটাতে পারে। স্পষ্টতই আল আসাদরা তাদের দেশের ইতিহাস থেকে একটুও শিক্ষা নেয়নি।
[লেখক ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির মিডলইস্ট হিস্টোরির অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর নাজমুল হক শিবলী]


আরো সংবাদ



premium cement
‘আপত্তিকর ভাষা’ ব্যবহারে শাস্তি পেলেন জোসেফ শ্রীমঙ্গলে হত্যা মামলায় প্রেমিক গ্রেফতার জামায়াত নেতা কাজী ফজলুল করিমের মৃত্যুতে ড. রেজাউল করিমের শোক প্রকাশ বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় দেশের মানুষকে সাথে নিয়ে মাঠে থাকব : মুন্না আমতলীতে ব্যবসায়ীকে আত্মহত্যার প্ররোচনায় জড়িতদের বিচার দাবি সিরিয়া নিয়ে আশা ও শঙ্কা ইসরাইলের সিরিয়ায় বাশারের পতনে ইসরাইল কতটুকু লাভবান অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের ৫৭৯ কর্মকর্তা লক্ষ্মীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতাহত ৫ এ দেশে রাজনীতি করতে হলে জনগণের সেবক হয়েই রাজনীতি করতে হবে : সেলিম উদ্দিন এখন সময় শান্তি ও স্থিতিশীলতার : অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী

সকল