১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

শেখ মুজিব স্বাধীনতা চাননি

-


আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান ভাঙার ১০ মাস আগে সেনা নেতৃবৃন্দের সাথে একটি রাজনৈতিক মীমাংসায় ইচ্ছুক ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ডের সাথে ঢাকায় সাক্ষাৎ করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ সেপারেশন বা পৃথক হওয়ার চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশনকে অগ্রাধিকার দেন। তিনি একাত্তরের মার্চে তৎকালীন ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাডের কাছে পুনরায় একটি গোপন বার্তা পাঠান। তাতে শেখ মুজিব মার্কিন কনসাল জেনারেলের কাছে অনুরোধ করেন, যদি আমেরিকা প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে মতামত পৌঁছে দিতে ইচ্ছুক হয়, তাহলে আওয়ামী লীগ আলোচনায় বসতে রাজি। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সেনা অভিযান শুরু হলে তা ভারতকে পূর্ব পাকিস্তানে হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতের সাথে ১৩ দিন যুদ্ধ করার পর ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে।

বাংলাদেশী লেখক বি জেড খসরু তার সাম্প্রতিক লেখা ‘মিথস অ্যাড ফ্যাক্টস : বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার’ গ্রন্থে বাংলাদেশ সৃষ্টির নেপথ্যের কিছু গোপন কথা খোলাখুলি আলোচনা করেছেন। খসরু কিছু লুকোনো সত্য মার্কিন সরকারের নথিপত্রের সহায়তায় উন্মোচন করেছেন, যা তিনি ফ্রিডম ইনফরমেশন অ্যাক্টের আওতায় সংগ্রহ করেছেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছেন, আওয়ামী লীগের শেখ মুজিব তথাপিও ১৯৭১ সালের নভেম্বরে রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু পাক-ভারত যুদ্ধ একটি রাজনৈতিক মীমাংসার সম্ভাবনা ধ্বংস করে দেয়। পাকিস্তানের মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানো তারবার্তা অনুসারে জানা যায়, শেখ মুজিবুর রহমান ১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১ স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য মার্কিন সমর্থনের চেষ্টা করেন। কিন্তু মার্কিন কর্মকর্তারা কখনো মুজিবকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করেননি; বরং যদি পাকিস্তান ভেঙে যায় তার জন্য বিকল্প পরিকল্পনা গ্রহণ শুরু করেন।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড ১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটনকে শেখ মুজিবের সাথে তার সাক্ষাৎ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেন। তাতে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা তার আগের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করেছেন। এর পরিবর্তে তিনি পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে একটি কনফেডারেশনের প্রস্তাব দেন। ধীরে ধীরে এবং ক্রমেই মুজিব জেনারেল ইয়াহইয়া খানের সাথে কথা বলতে রাজি হন এবং ১৯৭১ সালের ১০ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট নিরসনে একটি রাজনৈতিক সমাধানে ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেলের সাথে যোগাযোগ করেন।

আওয়ামী লীগ নেতারা ভারতেও মার্কিন কর্মকর্তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করেন এবং মিলিটারি অপারেশনের পরও আলোচনায় প্রস্তুত ছিলেন। কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্য কাজী জহিরুল কাইউম ১৯৭১ সালের ৩১ জুলাই কলকাতায় মার্কিন কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের জানান, আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সাথে একটি রাজনৈতিক মীমাংসা চাচ্ছে। কেননা, তারা আশঙ্কা করছেন, শেষ পর্যন্ত পাক-ভারত যুদ্ধ বেধে যাবে। যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ প্রলম্বিত হয়, তাহলে বামপন্থীরা গেরিলা আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়ে নেবে। এ ছাড়া নির্বাসিত আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মুশতাক ১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর কলকাতায় মার্কিন কর্মকর্তাদের জানান যে, তার দল জেনারেল ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত, তবে তাদের আলোচনার কোনো উপায় বা পথ খোলা নেই।
১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহর বিপরীতে জাল ভোটে জেনারেল আইয়ুব খানের জয়ের পর পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। আওয়ামী লীগ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোনকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু তার পরাজয় শেখ মুজিবকে হতাশ করে। তিনি তার বিখ্যাত ছয় দফার মাধ্যমে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করেন। আইয়ুব সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে জড়িয়ে তার কণ্ঠরোধ করতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কোনো আইন-আদালত তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পেশ করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। সে সময় ভোটারদের বয়সসীমা ছিল নিম্নে ২১ বছর। তালিকাভুক্ত ভোটারের সংখ্যা ছিল ৫,৬৯,৪১,৫০০ জন। সাধারণ নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল ৬৩ শতাংশ। আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের ১৬০টি আসনে জয়লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ১৯৭০ সালের এই সাধারণ নির্বাচনে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে পাকিস্তান পিপলস পার্টি পেয়েছিল ৮১টি আসন। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামী চারটি, পাকিস্তান মুসলিম লীগ কাউন্সিল দু’টি, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাইউম গ্রুপ) ৯টি, জেইউআই সাতটি, জেইউপি সাতটি, পিএমএল কনভেনশন সাতটি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ছয়টি, পিডিপি একটি এবং স্বতন্ত্র ১৬টি আসন থেকে নির্বাচিত হয়। আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে এবং পিপলস পার্টি পূর্ব পাকিস্তানে একটি আসনও পায়নি। তবে ওয়ালী খান নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ও মুমতাজ দৌলতানা নেতৃত্বাধীন কাউন্সিল মুসলিম লীগ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আওয়ামী লীগের সাথে কাজ করার জন্য প্রস্তুত ছিল।

পাকিস্তান পিপলস পার্টি পুরো পশ্চিম পাকিস্তানে বৃহত্তর দল হিসেবে এবং পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে বড় দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ন্যাপ ও জেইউআই পশ্চিম-পাকিস্তানের এনডব্লিউএফপি (পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকা, বর্তমান খায়বার পাখতুনখাওয়া) ও বেলুচিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে এক বছরের মধ্যেও ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়।
১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ একটি মজার ঘটনা ঘটে। খসরুর গ্রন্থে বর্ণিত তথ্য মতে- ওয়ালী খান ও মীর গওসবখশ বিজেঞ্জো ১৩ মার্চ ঢাকায় পৌঁছেন। ১৪ মার্চ মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করেন। বিজেঞ্জো মুজিবকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কি একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে চাচ্ছেন? মুজিব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তিনি প্রশ্ন করেন, কে কাকে পাকিস্তান না ভাঙার কথা জিজ্ঞেস করছে? আপনারা-যারা কংগ্রেসের সাথে যুক্ত ছিলেন- আমাকে বলেন, কে মনেপ্রাণে মুসলিম লীগার ছিল এবং পাকিস্তান সৃষ্টিতে আত্মত্যাগ করেছিল? কী আশ্চর্য!

বিজেঞ্জো ১৫ মার্চ ঢাকায় ইয়াহিয়ার সাথে মুজিবকে সাক্ষাৎ করতে বলেন। আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হলেন না। ইয়াহিয়া বিজেঞ্জোকে বললেন, যদি মুজিব সদাচারণ না করেন, তাহলে তার আর্মি জানে, কিভাবে গুলি করে পথ বের করতে হয়। মুজিব ২৪ মার্চ বিজেঞ্জোকে ঢাকা ত্যাগ করতে বললেন। কেননা, আর্মি দু’দিনের মধ্যে নেমে পড়বে। হতভম্বিত ও নির্বাক বিজেঞ্জো ও ওয়ালী খান সেই দিন ঢাকা ত্যাগ করেন।
খসরু তার গ্রন্থে দাবি করেছেন, মার্কিনিরা শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করছিল যে, মুজিব পাকিস্তান ভাঙতে চান না। তিনি যথাসম্ভব স্থির ছিলেন একটি কনফেডারেশনের জন্য, এমনকি যদি ১৯৭১-এর নভেম্বরেও কোনো সুযোগ তিনি পেতেন। আমেরিকানরা আলোচনা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জুলফিকার আলী ভুট্টোকে দায়ী করেছে। ভুট্টো আমেরিকানদের বলেছিলেন, মার্চ থেকে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে এড়ানো যেত। কিন্তু এরপর যা ঘটল তা ছিল অযৌক্তিক। ভুট্টো কনফেডারেশনে মুজিবের সাথে কাজ করতে প্রস্তুত ছিলেন। তিনি নিঃশর্তভাবে মুজিবকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৮ জানুয়ারি, ১৯৭২ মুক্তি দেন, কিন্তু মস্কো ও দিল্লি কখনো মুজিবকে উৎসাহিত করেনি পাকিস্তানের অংশ হিসেবে থাকতে।
[বি: দ্র: লেখাটি ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বরের। ওই সময় বিরূপ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে লেখাটি প্রকাশ করা যায়নি। দেশের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় এখন এটি উপস্থাপন করা হলো।-অনুবাদক]
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা ইংরেজি দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল দ্য নিউজ ১৬ ডিসেম্বর, ২০১২ থেকে ইংরেজি থেকে ভাষান্তর।
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]
হামিদ মীর : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 


আরো সংবাদ



premium cement