০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

আগরতলা মামলার অজানা ইতিহাস

-

‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ এই শব্দত্রয়ের সাথে বাংলাদেশের প্রায় সবাই কমবেশি পরিচিত। কিন্তু দুঃখের বিষয়,এ মামলার পটভূমি সম্পর্কে জানতে চাইলে দেখা যাবে, দেশের সত্তরোর্ধ্ব কিছু ব্যক্তি এ সম্পর্কে কিঞ্চিৎ অবগত থাকলেও বাকি সবাইসহ তরুণ প্রজন্ম তেমন অবগত নয়। এর একটি অন্যতম কারণ হলো- মধ্যযুগ থেকে অনেক ইতিহাস আমাদের পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত হলেও এ অংশগুলো অগোচরে রয়ে গেছে। এ বিষয়ে আমরা কিছু আলোকপাত করতে চাই।
পঞ্চাশের দশকে মোয়াজ্জেম হোসেন (তৎকালীন পাকিস্তান নৌবাহিনীতে কর্মরত একজন নৌকর্মকর্তা) প্রথমে একটি গুপ্ত ফান্ড ও ষাটের দশকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে কর্মরত স্বাধীনতাকামী বাঙালিরা যাদের সবার সাধারণ লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে দেশকে পুরোপুরি স্বাধীন করা তারা বিভিন্নভাবে একত্রিত হয়ে লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী’ নামে একটি গোপন বিপ্লবী দল গড়ে তোলেন।
১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাস, মোয়াজ্জেম হোসেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সশস্ত্র বিপ্লবের কাজের সুবিধার্থে চট্টগ্রামে বদলি হয়ে আসেন এবং জুন মাসে চট্টগ্রামের একটি সভায় পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’ প্রস্তাব করেন।
মোয়াজ্জেম হোসেন যে শুধু সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনাই করেননি; বরং পূর্ব পাকিস্তানের নাম, পতাকাসহ দেশের বিভিন্ন নীতিমালা তুলে ধরেছেন তা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের ‘বাংলাদেশ স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা’ শীর্ষক বইয়ে উঠে এসেছে। তিনি তার বইয়ে লিখেছেন, মোয়াজ্জেম হোসেন তার প্রস্তাবিত নতুন ও স্বাধীন রাষ্ট্রকে বাংলাদেশ নামে অভিহিত করেন এবং সবুজ ও সোনালি রঙের নতুন পতাকা প্রবর্তনের পরিকল্পনা নেন। দলটি মোটামুটি সুসংগঠিত হওয়ার পর ১৯৬৬ সালের শেষের দিকে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধে অস্ত্র ও গোলাবারুদের সাহায্যে আলোচনা শুরু করেন। সেই সময় ভারতীয় হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি ছিলেন পি এন ওঝা। করপোরাল সামাদকে ভারতীয় হাইকমিশনের সাথে যোগাযোগের দায়িত্ব দেয়া হয়। করপোরাল সামাদ ছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেনের স্কুলজীবনের বন্ধু। মোয়াজ্জেম হোসেন তার সহকর্মীদের সাথে আলোচনা এবং ওঝার সাথে বৈঠক করে ১৯৬৭ সালের ১২ জুলাই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় ভারতীয়দের সাথে চূড়ান্ত আলোচনার তারিখ নির্ধারণ করেন। মোয়াজ্জেম হোসেন একটি প্রতিনিধি দল আগরতলায় পাঠান। সেই প্রতিনিধি-দলের নেতৃত্বে ছিলেন আলী রেজা, তার সাথে ছিলেন স্টুয়ার্ড মুজিবর, লিডিং সিম্যান সুলতান। সেখানে গিয়ে তারা কথা বলেন ভারতীয় লে. কর্নেল মিশ্র ও মেজর মেননের সাথে এবং ১৩ জুলাই ফেরত আসেন। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা নি¤œপদস্থ হওয়ায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আলোচনায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি। মোয়াজ্জেম হোসেন প্রতিনিধিদলটিকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সিএসপি অফিসার তথা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেননি। ১৯৬৭ সালে তিনি যখন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে ১১ মার্চ পূর্ব বাংলার ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটির প্রধান হিসেবে চট্টগ্রাম থেকে বরিশালে বদলি হন, তখন তিনি জানতে পারেন ১৯৬৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বরিশালের চাঁদপুর টার্মিনাল উদ্বোধন করবেন খোদ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব নিজে, সাথে থাকবেন গভর্নরসহ উচ্চপদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা। প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার দায়িত্ব পড়বে মোয়াজ্জেম হোসেনের ওপর।
এ কথা জানার সাথে সাথে তিনি তার সংগঠনের সদস্যদের সাথে প্রেসিডেন্টকে আটক করে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন ঘোষণা করতে বাধ্য করার পরিকল্পনা করেন। যদিও শেষ মুহূর্তে পরিকল্পনাটি ত্যাগ করতে হয়। একদিকে প্রেসিডেন্টকে আটক করার পরিকল্পনা নস্যাৎ অন্যদিকে ভারতীয়দের সাথে আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায় সব মিলিয়ে তার মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
১৯৬৭ সালে আইএসআইয়ের বাঙালি অফিসার কর্নেল জামিল (তৎকালীন মেজর) ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানকে জানান, সমস্ত স্বাধীনতাকামী আইএসআইয়ের নজরদারিতে রয়েছে। তাই কিছু দিন পর কর্নেল শওকত, কর্নেল হুদা, কর্নেল আলম, কমান্ডার রউফ, মেজর মুতালিব এবং সিএসপি রুহুলকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি করা হয়। এসব কারণে কিছু দিন পর স্বাধীনতাকামী সৈনিকরা যে যার মতো দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। কিন্তু মোয়াজ্জেম হোসেন হাল ছাড়ার পাত্র ছিলেন না। তিনি পুনরায় সবার সাথে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যান এবং ভারতীয়দের সাথে নতুন করে আবারো আলোচনার পথ সুগম করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। পুনরায় ১৯৬৮ সালের ১৬ জানুয়ারি ভারতীয়দের সাথে আলোচনার দিন ধার্য করেন। এবারে আলোচনা ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে তিনি আহমদ ফজলুল রহমান সিএপসিকে সঙ্গে নিয়ে গোপনীয়তার প্রয়োজনে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে ভিন্ন ভিন্নভাবে নেপাল হয়ে ভারতে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
১৯৬৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিংশতিতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সরকারিভাবে চট্টগ্রামে পালনের সিদ্ধান্ত হয় যেখানে ওই সময় ষষ্ঠ বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করা হচ্ছিল। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রধান সেনাপতি জেনারেল মুসাসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। আর লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন মরিয়াহ হয়ে এবারে এখানে পুনরায় বিপ্লব সফল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। অকস্মাৎ এ অনুষ্ঠানে তারা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল মুসাসহ উপস্থিত সবাইকে গ্রেফতার করে ক্ষমতা দখল ও স্বাধীনতার ঘোষণার পরিকল্পনা করেন। ঢাকা সেনানিবাসের পদাতিক ও বিমানবাহিনীর অস্ত্রাগার দখল করাসহ কোনো সামরিক বিমানসহ কোনো বিমান যেন আকাশে উড়তে না পারে তার কার্যকর ব্যবস্থা নেন।
কুমিল্লা, যশোর ও উত্তরবঙ্গের সেনা ঘাঁটিগুলোর সাথেও তাদের যোগাযোগ ও পরিকল্পনা কার্যকর করার ব্যবস্থা পাকা করা ছিল। কিন্তু পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগে অনেকে মনে করেন, করপোরাল আমির হোসেন যিনি বিপ্লবী সংগঠনের অর্থের দায়িত্বে ছিলেন তিনি, আবার কারো কারো মতে সরকারের গুপ্তচরের মাধ্যমে চট্টগ্রামের বিদ্রোহ পরিকল্পনাসহ সর্বোচ্চ বিপ্লবী পরিষদের বহু গোপন তথ্য সরকারের কাছে পৌঁছে যায়। ফলে সরকার ২০ ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানটি বাতিল করে এবং ১৯৬৭ সালের নভেম্বর মাসে লে. কমান্ডারকে জানানো হয়, বিশেষ কাজে তাকে রাওয়ালপিণ্ডি যেতে হবে। ৩ ডিসেম্বর তিনি রাওয়ালপিণ্ডি বিমানবন্দরে যান এবং সেখান থেকে সরাসরি সেনানিবাসে নিয়ে একনাগাড়ে ৪০ ঘণ্টা তাকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। ৭ ডিসেম্বর ঢাকায় আনার পর থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত পুনরায় টর্চার করা হয়। অত্যধিক অত্যাচারে তিনি বহুবার জ্ঞান হারান। এমনকি আঘাতে তার একটি দাঁত গোড়া থেকে নড়ে যায়, পরে ওই দাঁত তুলে ফেলতে হয়।
দলের বেশ কিছু সদস্যের আত্মপরায়ণতা ও নিজেদের মধ্যে মতদ্বৈধতায় জন্ম নিলো এক অন্য ইতিহাস। ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার’ ইতিহাস। একটি মহান জাতির মুক্তি সংগ্রামের নায়ক হওয়ার পরিবর্তে মোয়াজ্জেম হোসেন হয়ে গেলেন একটি ষড়যন্ত্র মামলার নায়ক। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে জন্ম নিলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ১৯৬৮ সালের পয়লা জানুয়ারি সরকার এক প্রেস নোটে বলে, সশস্ত্র বিদ্রোহের অভিযোগে বেশ কিছু বিদ্রোহীকে আটক করা হয়েছে। প্রথমে সরকার মামলার নাম দিয়েছিল ‘রাষ্ট্র বনাম মোয়াজ্জেম হোসেন’ পরে অ্যাডভোকেট মনজুর কাদেরের পরামর্শে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে এ মামলায় যুক্ত করে নাম দেয়া হয় ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান’। (তথ্যসূত্র : স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-২৮০, শহীদ কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা, পৃষ্ঠা : ৮-৯, স্বাধীনতাযুদ্ধের গোপন বিদ্রোহী কমান্ডার মোয়াজ্জেম, পৃষ্ঠা-৭২) স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে, আগরতলা মামলার গুরুত্ব অপরিসীম কারণ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কার্যবিবরণী প্রায় আট মাস চললেও বিচার তখনো শেষ হয়নি। ওই সময়ে মামলার কার্যবিবরণী পক্ষান্তরে বাঙালিদের জাতীয়তাবাদী চেতনা উজ্জীবিত করে তুলতে সাহায্য করেছে। বাঙালিদের দুঃখ-দুর্দশা, বঞ্চনা, শোষণ এবং অবিচার ছিল মামলার মূল উপজীব্য।
প্রতিদিন সংবাদপত্রে মামলার কার্যবিবরণী পড়ে বাঙালিরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হিসেবে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রেরণা পেয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে বাঙালিরা টিকে থাকতে পারবে কিনা, বিষয়টি নিয়ে এতদিন ধরে বাঙালিরা শুধু নীরবে নিভৃতে এবং গোপনে আলোচনা করছিল। মামলার ফলে তা পরিণত হয় প্রকাশ্য আলোচনার বিষয়বস্তু। এ মামলা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে গণ-জাগরণের সৃষ্টি করেছিল, এমনকি ভাসানী ন্যাপ যারা আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবের বিপক্ষে অবস্থান করছিল এ মামলার কারণে তারা পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করার স্পৃহা জুগিয়েছিল পরবর্তীতে যা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে তাদের নিজেদের প্রতি আস্থা ও সাহস বহুগুণে বৃদ্ধি করেছিল এবং এ মামলার মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান রাতারাতি নায়ক হয়ে ওঠেন। পরোক্ষভাবে যা মোয়াজ্জেম হোসেনের অবদান। কারণ সশস্ত্র পন্থায় দেশকে স্বাধীন করার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন যার নেতৃত্বে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মিলে গঠিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী’ নামক বিদ্রোহী সংগঠন। এ সংগঠন না গড়ে উঠলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সৃষ্টি হতো না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণে সময়ের কালক্রমে শেখ মুজিব হয়ে গেলেন পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা, আর মোয়াজ্জম হোসেন চলে গেলেন ইতিহাসের অন্তরালে।
লেখক : নৌবাহিনীর সাবেক সহকারী প্রধান ও উপ-উপাচার্য বিইউপি


আরো সংবাদ



premium cement