০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ইতিহাসের বিচার-আচার

অদৃশ্য-দৃশ্যাবলী
-

ইদানীং প্রায় প্রতিদিন এমন সব ঘটছে বা ঘটানো হচ্ছে এবং একই সাথে যেসব উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে, সেসব দেশের ইতিহাসে অবশ্যই যোগ হবে। তবে একটি কথা প্রচলিত আছে, প্রতিদিনের সব কিছুর তাৎক্ষণিক মূল্যায়ন বা ব্যাখ্যা করা সমীচীন নয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যতিক্রম তো থাকবে। সেই ব্যতিক্রমী ঘটনা ও তথ্যাদির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা অপরিহার্য। ভবিষ্যতে নতুন প্রজন্ম সে পাঠের জন্য অপেক্ষায় থাকবে। যা কিছু অপ্রত্যাশিত অনাকাক্সিক্ষত যেসব ঘটনাই ঘটছে। তার তাৎক্ষণিক ব্যাখ্যা করা এখন সময়ের দাবি। সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার বিপ্লব আমাদের কথা বলার সুযোগ এনে দিয়েছে বটে, তবে তার অর্থ এই নয় যে, অকথা কুকথা বা অন্যায্য দাবি দাওয়া ও আবদার তোলার পথ উন্মুক্ত হয়ে গেছে। এসবের উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া দেখানো এবং সময়োচিত জবাব দিতে হবে। এর তারতম্য কতটুকু হবে উপযুক্ত সেটা কর্তৃপক্ষই নির্ণয় করবেন। এ ক্ষেত্রে অকারণে যদি বিলম্ব করা হয় তাহলে দুই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। আইনের শাসন বিঘিœত হবে আর সেটা হচ্ছে ক্ষিপ্ত মানুষের হাতে আইন তুলে দেয়ার মতো। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে অঘটন ঘটনপটিয়শীরা কর্তৃপক্ষকে দুর্বল ভেবে তাদের দুষ্কর্ম দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা আঁটতে থাকবে। কিছুকাল পূর্ব পর্যন্ত ন্যায্য কথা যৌক্তিক দাবি দাওয়া পেশ করার কোনো সুযোগ ছিল না। এখন সে বাধা অপসারিত হওয়ামাত্র অযৌক্তিক দাবি দাওয়া নিয়ে কয়েক শত মানুষ রাজপথ জনপথ অবরুদ্ধ করে লাখ লাখ মানুষের অবাধে চলাচল করার অধিকারকে নস্যাৎ করবে। তার বিচার করতে হবে। এ কথার মধ্যেই গণতন্ত্রের সত্যিকার চেতনা বিরাজ করছে অর্থাৎ বৃহত্তর মানুষের অভিপ্রায়কে ক্ষুণœ করা। জাতি সাগ্রহে লক্ষ করেছে ছাত্র-জনতা আন্দোলন করেছে মেধার মূল্যায়নের দাবি নিয়ে। অথচ বিস্ময়ের ব্যাপার অতি সম্প্রতি দেখা গেল কিছু মেধাহীন ছাত্রছাত্রী বেরিয়ে এসে দাবি তুলল তাদের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থায় মেধাবীদের পাশেই তাদের স্থান করে দিতে হবে। এমন নির্লজ্জ দাবিকে মানতে হবে কেন। এমন সব কর্মকাণ্ড সংক্রামক ব্যাধির মতো দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে। বৃহত্তর জনগণের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে আইন-কানুন, বোধ-বিবেচনা, শৃঙ্খলা-প্রশান্তির সাথে সমান্তরালভাবে অরাজকতা-অযৌক্তিকতা, জনদুর্ভোগ অশান্তি কেন পাশাপাশি চলতে দেয়া হবে। আইন থাকবে কিন্তু প্রয়োগ হবে না। এটা কেন দেখতে হবে। খুব সাধারণ প্রশ্ন নাগরিকদের ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা খুব একটা দৃষ্টিগ্রাহ্য ছিল না। কিন্তু সেই রিকশাচালকদের যেসব সমাবেশ রাজধানীতে দেখা গেছে সেখানে কয়েক সহস্র চালকের উপস্থিতি। এত মানুষ তো আসমান থেকে নামেনি। তাহলে ওরা কারা। অনুসন্ধান করতে হবে এরা কোন ছদ্মবেশী। এ দেশের মানুষ এত আহম্মক নয় যে, কিছু একটা আশ্বাস দিলে তার পেছনে ছুটবে ঢাকা পর্যন্ত। কিছু ব্যতিক্রম হয়তো থাকতেও পারে। যাই হোক বিষয়গুলো অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। নিশ্চয় প্রশাসন সব খতিয়ে দেখবে। একই সাথে এটা দেখতে হবে, এমন তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাগুলোর পূর্বাভাস কেন প্রশাসন পেল না।
আমরা আরো কিছু বিষয় নিয়ে কথা তুলতে চাই, যা ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। শুধু তাই নয়, খুব স্পর্শকাতর বিষয়ও বটে। ইতিহাসের কথা আবার তাৎক্ষণিকভাবে মূল্যায়ন ও ব্যাখ্যা করতে হয় না। তখন সত্য উচ্চারণ কঠিন হয়ে থাকে। কেননা তথাকথিত বিজয়ীদের ভ্রƒকুটি থাকে, আবেগ থাকে সে কারণে ট্যাগও করা হতে পারে। এমনি একটি স্পর্শকাতর এবং জাতির সর্বোচ্চ আবেগ ও অনুভূতির বিষয়। জাতির সেই মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধের মহান সৈনিকদের সাথে যদি ষোড়শ ডিভিশনকে সংযুক্ত করা হয় তাহলে এই ‘মিক্স আপটা’ কি খুবই বেদনাদায়ক এবং মুক্তির সৈনিকদের জন্য অপমানজনকও বটে। এটাও স্পষ্ট করতে হবে মুক্তিযুদ্ধে পটভূমি রচিয়তার আর যারা যুদ্ধক্ষেত্রে বসে যুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাদের সবার সঠিক মূল্যায়ন না করা হলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিপথগামী হতে পারে। পতিত লীগের বরাবর দাবি মুক্তিযুদ্ধের একক নায়ক তারা। মুক্তিযুদ্ধে মহান যোদ্ধা তারা, যারা তৎকালীন পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী নিয়মিত সৈনিক তৎকালীন বিডিআরের বাংলা ভাষী সৈনিক, পুলিশ, লক্ষ ছাত্র-জনতা আর শ্রমিক, কৃষক তারা কি সবাই লীগের টিকিটধারী ছিল। আরো প্রশ্ন আছে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বাংলাভাষী বেসামরিক প্রশাসন পদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা ভিন্ন ভিন্ন সেক্টরে বাকযুদ্ধ কলমযুদ্ধ বুদ্ধির যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, তারা কি লীগের টিকিটধারী ছিলেন, যারা বহির্বিশ্বের বিশ্বজনমত নির্মাণে যুদ্ধ করেছেন। তারা লীগের কাছে কখনো টিকিট চেয়েছিলেন? বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, অধ্যাপক ইউনূসসহ শত শত বাংলাভাষী পণ্ডিতজন তারা কখনোই লীগের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন । বহু বিদেশী এই জনপদের মুক্তির জন্য কাজ করেছেন। তারা কবে কোথায় কখন নৌকার মাঝিমাল্লা ছিলেন?
বাংলাদেশের সংবিধান রচয়িতা সাবেক আইন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। এসব তার একমাত্র পরিচয় নয়। তিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইন বিশেষজ্ঞ। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন লীগের মুক্তিযুদ্ধে একক মালিকানা নিয়ে। লীগ যদি সত্যি যুদ্ধের ময়দানে থাকত তবে লীগের টিকিটধারী ক’জন শহীদ হয়েছেন, কতজন যুদ্ধ করে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন। তার তালিকা না হয় প্রকাশ করা হোক। যুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের ক’জন লীগের ছিলেন। এসব প্রশ্ন তো খুবই প্রাসঙ্গিক। যে কণ্ঠস্বর শুনে মুক্তিযুদ্ধ সূচনা ‘উই রিভোল্ট’ সেটা কোন সদস্যের কণ্ঠ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যে ক্ষুদ্র মন্ত্রিসভা ছিল, একজন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন, একজন প্রধান সেনাপতি ছিলেন। লীগ তখনই তাদের ওই সব নেতাকে স্মরণ-শ্রদ্ধা করেনি এটা কি মুক্তিযুদ্ধে সঠিক ন্যারেটিভ।
আমাদের পরশীদের লীগ রাতারাতি পরম বন্ধু হিসেবে জাতিকে ‘ছবক’ দিলো। তারা আমাদের কী নিঃস্বার্থ বন্ধু? অবশ্য স্বীকার করব মুক্তিযুদ্ধে তাদের সমর্থন ও সাহায্য ছিল। উদ্দেশ্যও তবে তাদের ছিল আর আমাদের প্রয়োজন ছিল। এই ন্যারেটিভটা অবশ্যই আমাদের মনে রাখতে হবে। শুরু থেকে সেই বন্ধু আমাদের সাথে অবন্ধু সুলভ আচরণে ছিল। যুদ্ধটা আমাদের দ্বারা আমাদের জন্য কিন্তু বিজয় নাকি তাদের। আমাদের শোনানো হয় তারা আমাদের শরণার্থীদের খাইয়েছে, আশ্রয় দিয়েছে। এর দশআনা সত্য বাকি ছয়আনা নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন। বিদেশ থেকে এ বাবদ যত সাহায্য এসেছে তার হিসাবটা কোথায়। যুদ্ধে ‘লুটপাট হলো কাঁথা-কম্বল, সোনা-দানা এ জনপদের কলকারখানার কত যন্ত্রপাতি অস্ত্রপাতি এমনকি নগদ অর্থ ভারতীয় সেনারা নিয়ে গেল। সেসব কি সাহায্যের বিনিময়মূল্য নয়। তাহলে আমাদের আর বিনয় প্রকাশ কেন।
এই প্রজন্মের তরুণ, বিশেষ করে যারা আগস্ট বিপ্লবের সৈনিক তাদের গানের একটি চরণ স্মরণ করে এ লেখার দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা টানতে চাই। চরণটা সম্ভবত এমন, যুদ্ধ করিনি যুদ্ধ দেখিনি পড়েছি ইতিহাস। আজকের প্রজন্ম প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ তারা করেনি বটে, সে অবকাশ তাদের ছিল না এটাও সত্য। যাক যাই হোক ’৭১ এ যে যুদ্ধ হয়েছিল তার তাৎক্ষণিক বয়ান ছিল শুধু লীগ আর লীগ, তারাই কেবল সে যুদ্ধ করেছে, আর কেউ নয়। সে বয়ান ছিল অবৈধ মিথ্যাচার। সেই কথা পূর্বেই বলা হয়েছে। আগস্ট বিপ্লবের সত্যটা যেন কখনো ভুলভাবে চিত্রিত না হয়। এটা আগাম হুঁশিয়ারি এ জন্য যে, এখন পথেঘাটে বিপ্লবের বহু দাবিদারকে লক্ষ করা যাচ্ছে। আরো লক্ষণীয় যে, যারা বিপ্লবের ভাগিদার হতে চান তাদের কথাবার্তায় প্রতিবিপ্লব। এখন উৎসাহ উদ্দীপনা পাচ্ছে। ঐক্যের কথা বলে ঠিক কিন্তু পরক্ষণে তাদের বচন অনৈক্যের ব্যঞ্জনা খুঁজে পাওয়া যায়। এমন ‘দো দিল’ বান্দাদের পরিশেষে ‘অপক্ব কদলি’ হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় শুধু কি তাই, এক ঘরের বাসিন্দা হয়েও কেউবা উত্তরে আব্দার কেউ দক্ষিণে উঁকিঝুঁকি দেন। এসব অস্থিরতা নয়। রাজনীতি স্থির মস্তিষ্কের অনুশীলন অস্থিরতার স্থান সেখানে খুব সঙ্কোচিত।
শেষ কথা এটাই, বৈষম্যের ক্ষেত্রে সংখ্যা সাম্যের কোনো মূল্য নেই। কিন্তু বহু ক্ষেত্রের সংখ্যা সাম্য অচল। কেউ বাইরে থেকে কেউ কেউ আমাদের ধর্মের শিক্ষা দিতে চায়। তাদের বলতে হবে ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও।’ শুনে রাখুন আমরা অকৃতজ্ঞ নই। অনেক স্বীকার করি, আপনারা বেশ উপকার করছেন, আপনাদের যে স্বরূপ এতদিন মেঘে ঢাকা ছিল। ধীরে ধীরে সেটা সরাচ্ছেন। যে স্বরূপটা পাচ্ছে সেটা দেখেশুনে বাংলাদেশীদের ছোটখাটো বিভেদ সরে যাচ্ছে, ঐক্য অটুট হচ্ছে।
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement