পরিকল্পিত নৈরাজ্যের নানা দুয়ার
- রিন্টু আনোয়ার
- ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা বিনষ্টকারীদের অপতৎপরতা উদ্বেগজনক হয়ে দেখা দিয়েছে। ‘সারা দেশে একটি পরিকল্পিত নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা ক্রমেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেছেন, গত কয়েক দিন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব ঘটনা ঘটেছে, এ ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার অবকাশ নেই।
স্বাধীনতার এক আজব সংজ্ঞা ও উদাহরণে ভাসছে এখন বাংলাদেশ। যে দিক দিয়ে পারছেন তার মনমতো স্বাধীনতা কায়েম করে ফেলছেন। মন যা চায় করছেন, ঘটাচ্ছেন। এতে গণ-অভ্যুত্থানে তৈরি হওয়া নতুন রাজনীতির সম্ভাবনা মার খেতে বসেছে। তা বান্দরবান সাভার-গাজীপুর, ডেমরার ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ থেকে পুরান ঢাকার সোহরাওয়ার্দী-কবি নজরুল কলেজ বা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ। নতুন ঢাকার তিতুমীর কলেজ অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজ। অটোরিকশা থেকে কাভার্ড ভ্যান। পাহাড় থেকে সমতল, পাতাল আর হাসপাতাল- গোটা দেশে পরতে পরতে বিরতিহীন অন্তর্ঘাত প্রায় সব খানেই। এ সরকারকে এক দিনও শান্তিতে থাকতে না দেয়ার একটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নমুনা স্পষ্ট।
নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে মিশে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ ছড়াচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের মধ্যে অনৈক্য, সন্দেহ, অবিশ্বাস আর বিভ্রান্তি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাদের কয়েকজন সরকারে আছেন। আবার রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত কয়েকজন। যে তারুণ্য জাতির বুকের উপর থেকে ১৫ বছরের পাথর সরাল, আজ সেই তারুণ্যকে আতঙ্ক ছড়ানো ও পরস্পরকে বধের নেশা চাপানো হয়েছে। কয়েকজন সমন্বয়ককে হিডেন রাজনীতির বটিকা বানানো হয়েছে। এ সরকারের চালিকাশক্তি ছাত্রদেরকে দুর্বল করা ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে প্রধান উপদেষ্টার উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের স্ট্যাটাসে।
ছাত্র-জনতাসহ বিশেষ কয়েকটি মহলে তোলপাড় করা স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, অনেক মিত্রই আজ হঠকারীর ভূমিকায়। ... আমরা আমাদের ব্যর্থতা স্বীকার করি। আমরা শিখেছি এবং ব্যর্থতা কাটানোর চেষ্টাও করছি। ...বাম ও ডান মানসিকতার কতিপয় নেতৃত্ব বা ব্যক্তি অভ্যুত্থানে এবং পরবর্তী সময়ে সরকারে নিজেদের শরিকানা নিশ্চিত না করতে পেরে উন্মত্ত হয়ে গেছেন। তাদের উন্মত্ততা, বিপ্লবী জোশ ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড দেশটিকে অস্থির করে রেখেছে।’
ছাত্ররা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল চালিকাশক্তি- এ কথা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বারবার তার বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের উপস্থিতে একটি অনুষ্ঠানে মাহফুজকে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। সেই মাহফুজেরই এই স্ট্যাটাস অনেকের জন্য ভাবনার বিষয় হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগের বিদায়ের পর ক্ষমতাপ্রত্যাশী হয়ে ওঠা বিএনপি-জামায়াতের ভেতরও টেনশন। কোত্থেকে কী হয়ে যাচ্ছে বুঝে উঠতে উঠতেই ঘটছে আরেকটি ঘটনা। নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী, ভাবুক ও চিন্তক গোষ্ঠী সভা-সেমিনার, ওয়েবিনার, ফেসবুক বা ইউটিউবে অস্তিত্বের জানান দিলেও কুলিয়ে উঠতে পারছে না। তার ওপর অচেনা গোপন শক্তি তৎপর। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের এ অবস্থার মধ্যে নানান চিন্তায় আগোয়ান সম্প্রদায়গত একাধিক গ্রুপ। তারা হিন্দু-মুসলিম দু’দিকেই। পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময়কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে কেবল জাতীয় পতাকা অবমাননার মামলায়। তার তৎপরতা ভিন্নদিকে যা কৌশলগত কারণে সামনে আনতে চায় না সরকার। বিএনপিও এ ব্যাপারে অতি কৌঁসুলি। আওয়ামী লীগ রাখঢাক রাখেনি। তাকে গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে আওয়ামী লীগ অবিলম্বে তার মুক্তি দাবি করেছে।
দলের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক বিবৃতিতে এ প্রতিবাদ জানিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর প্রতিক্রিয়া মারাত্মক ঝাঁঝালো। চিন্ময় ব্রহ্মচারীকে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও ইসকন নেতা উল্লেøখ করে নিন্দাই জানাননি তিনি। তাকে মুক্তি না দিলে সীমান্তে সনাতনীদের নিয়ে অবরোধ করবে বলে হুমকিও দিয়েছেন। এমনকি কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনে বিক্ষোভ করার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন। ভারত থেকে পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে কোনো পরিষেবা বাংলাদেশে ঢুুকতে না দেয়ার হুঙ্কারও দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করে চিন্ময়কে বলা হয়েছে বাংলাদেশে হিন্দুদের অস্তিত্ব রক্ষার নেতা নামে। যে যার মতো যা করার এ সিরিয়ালে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার এরই মধ্যে বলী হয়ে গেলেন চট্টগ্রামের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ। সেই সাথে যোগ হলো চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে সারজিস ও হাসনাতের গাড়িতে ট্রাকচাপার ঘটনা। এত সব ঘটনায় ব্যতিব্যস্ততার ফাঁকে সংস্কারসহ আসল কাজ হবে কিভাবে?
অবস্থা কোথায় গেলে বিনা জামানত এবং বিনা সুদে ঋণ দেয়ার প্রলোভনে ফেলে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অভাবী মানুষদের ঢাকায় এনে গণ্ডগোল পাকানোর অপচেষ্টা পাকানোর সাহস করা যায়? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্রুত পদক্ষেপে এবারের যাত্রায় তা ভণ্ডুল হয়েছে। ধরে ধরে ইস্যু তৈরির এ নোঙরা পথে যে যেদিক দিয়ে পারছে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। একটি বিশাল গণ-অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র মেরামত অনিবার্য কাজ। কোনটি মেরামত দরকার তা নাম ধরে ধরে বলার তো কোনো প্রয়োজন নেই! যেখানেই ত্রুটি সেখানেই মেরামত। সেই পথে পদে পদে বাধা। এ আয়োজনেই রাজধানীতে তিন কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে ডেমরার মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ এলাকা। কলেজে ভাঙচুর করে লুটপাট করা হয়েছে কম্পিউটারসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম ও আসবাবপত্র। তিন কলেজের সংঘর্ষের ঘটনায় আহত হয়েছে অর্ধ শতাধিক শিক্ষার্থী। রোববার ক্যাম্পাসে ভাঙচুরের প্রতিবাদে সোমবার এভাবেই ডেমরার মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ ভাঙচুর করে সরকারি কবি নজরুল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে কলেজের ভেতরে গিয়ে ভাঙচুর করে নিয়ে যায় জিনিসপত্র।
ইস্যু বানাতে গিয়ে রিকশাওয়ালা-হকার-কাজের বুয়া-বস্তিবাসী কাউকেই ছাড় দেয়া হচ্ছে না। আয়োজন এমনভাবে করা হচ্ছে, এক জায়গায় শ’ খানেক লোক জড়ো হয়ে বলছে, এটি জনগণের দাবি- সরকার সেটি মেনে নিচ্ছে। ব্যাটারিচালিত রিকশা ড্রাইভাররা দেখিয়েছে আচ্ছা রকমের খেল। টক অব দ্যা টাউন হয়েছে তারা। প্রেস ক্লাব, শহীদ মিনার, আগারগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় আইনের লোকেদের সাথে সংঘর্ষ বাধিয়ে হিম্মত দেখিয়েছে। হামলে পড়ে সেনাবাহিনীকে উসকানোর অপচেষ্টাও ছাড়েনি। দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা সদস্যরা ধৈর্যের পরিচয় দিয়েই যাচ্ছে। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা থাকার পরও মাঠে যারপরনাই সতর্ক অবস্থানে থাকতে হচ্ছে তাদের। সময়টা খারাপ তথা স্পর্শকাতর। ব্যারাকের দায়িত্বের পাশাপাশি বাইরের এসব জরুরি কাজে হিসাব কষে এগোতে হয়। পাহাড়ি জনপদে অশান্তি তৈরির হোতাদের রোখা সেনাবাহিনীর আরেক দায়িত্ব। এরই মধ্যে পাহাড়ি এলাকার সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো নতুন করে আবারো বেপরোয়া। তাদের দমন করতে গিয়ে বান্দরবানের রুমার দুর্গম এলাকায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফের গোপন আস্তানায় অভিযান চালিয়েছে সেনাবাহিনী। অভিযানে কেএনএফের গোপন আস্তানার সন্ধান পাওয়া গেলে সেখানে তল্লাশি অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী। এ সময় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে অনবরত গুলি ছুড়তে থাকে।
এ সময় কেএনএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে গোলাগুলিতে তিনজন কেএনএফ সন্ত্রাসী ঘটনাস্থলে নিহত হয়। কয়েকজন সন্ত্রাসী গহীন জঙ্গলে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে ওই এলাকা তল্লাশি চালিয়ে সেনাবাহিনী কেএনএফ সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত একটি চাইনিজ রাইফেল, দু’টি একনলা বন্দুক, বেশ কিছু গোলাবারুদ, ইউনিফর্ম, বেতারযন্ত্র, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন ও ওষুধসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করে। পাহাড়ি এলাকায় সন্ত্রাসীদের তৎপরতার পেছনেও রাজনীতি ও কালো টাকার খেলা আছে। মাত্রাগতভাবে সমতলে আরো বেশি। ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের কয়েকজন জানিয়েছে, তাদের এ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ-যুবলীগের কর্মীরা অনুপ্রবেশ করেছে। তারাই মূলত নানা অপকর্ম ও বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করছে। মূল সড়কে নয়, অলি-গলিতে রিকশা চালানোর কথাও বলেন তারা। ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে হাইকোর্টের দেয়া নির্দেশনায় এক মাসের জন্য স্থিতাবস্থা দিয়েছেন চেম্বার আদালত। এর ফলে এক মাস ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলে আপাতত কোনো বাধা নেই। এরপর কী হবে?
হালদশা উপলব্ধি করে দ্রুত নির্বাচনের নিশ্চয়তা চায় বিএনপি। নইলে নতুন ওয়ান-ইলেভেন, নেতা-নেত্রীর মাইনাস আতঙ্ক তাদের। কোথাও কিছু একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে বার্তা দিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিএনপি নেতারা বলছেন, নির্বাচনই এখন সমাধান। নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা হলে অর্ধেক সমস্যা কেটে যাবে- এমন কথাও বলছেন তারা। বাস্তবতাটা বড় কঠিন।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বর্তী সরকার কার্যত হাসিনার অলিগার্ক আমলা, পুলিশ, গোয়েন্দাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। হাসিনাপন্থী কর্মকর্তাদের কয়েক জনকে বাদ দিলেও এখনো বেশির ভাগ কর্মকর্তা আওয়ামী অনুসারী। তারা বসে নেই। একের পর এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরিতে বেশ ভূমিকা তাদের। তারা তাদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে, এটিই স্বাভাবিক। তাদের কাছে এটি রাজনীতি-কূটনীতি। সরকার বা জুলাই-আগস্ট আন্দোলনকারীদের কাছে ষড়যন্ত্র। কিন্তু, মানুষ এখন আর ষড়যন্ত্র-ষড়যন্ত্র শুনতে চায় না। তারা চায় সমাধান-ষড়যন্ত্রের মূল উৎপাটন। এ কাজে ফ্রন্টলাইনে ভূমিকা রাখতে পারে শিক্ষার্থীরা, যাদের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছে ৫ আগস্ট। দুঃখজনকভাবে সেখানেই বিপত্তি। মুক্তিযুদ্ধের পর তখনকার সরকার তরুণদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে পারেনি। ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের পরও সেই নমুনা। তার ওপর তরুণদের ব্যবহার-অপব্যবহার বাড়ছে।
লেখক : কলামিস্ট
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা