গণহত্যার বিচার ও আওয়ামী রাজনীতি
- শরিফুল ইসলাম
- ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের গত ১৬ বছরের শাসনামলে দেশে একের পর এক নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সবশেষ জুলাই-আগস্টের গণহত্যাসহ এই সময়ের মধ্যে তিনটি গণহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। শুরুটা হয়েছিল অবশ্য ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের আগেই। সেটি ছিল ২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। তৎকালীন চারদলীয় ঐক্যজোট সরকারের ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হলে তারা যখন নিয়মানুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে, ঠিক সে দিন শেখ হাসিনার পূর্ব নির্দেশে সারা দেশে লগি-লাঠি-বৈঠা নিয়ে এক তাণ্ডবে মেতে ওঠে আওয়ামী লীগ। ঢাকার পল্টনসহ আশপাশের এলাকায় প্রকাশ্যে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের পিটিয়ে হত্যা করে লাশের ওপর নৃত্য করে উল্লাস প্রকাশ করেছিল তারা; যা দেখে গোটা দুনিয়ার মানুষ স্তম্ভিত হয়ে যায়।
এরপর শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের কিছু দিনের মধ্যেই পিলখানায় দেশের ইতিহাসে এক নিকৃষ্টতম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সদস্যদের ওপর। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেশী একটি দেশের স্বার্থে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভঙ্গুর করে দেয়ার লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে ৫৭ জন দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। সব কিছু জেনেও সে দিন না জানার ভান ধরেছিলেন শেখ হাসিনা।
২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের দিন দেশে একটি গণহত্যার ঘটনা ঘটে। এ দিন তথাকথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রহসনের রায়ে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ দেয়। এতে দেশের লাখ লাখ সাঈদীভক্ত মানুষ প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। সরকার সাঈদীভক্তদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ বিক্ষোভ দমনে নির্মম নিষ্ঠুর গণহত্যার পথ বেছে নেয়। পাখির মতো গুলি করে অসংখ্য সাঈদীভক্তকে হত্যা করে।
একই বছরের মে মাসে দেশে আরেকটি গণহত্যা চালায় ফ্যাস্টিস শেখ হাসিনার সরকার। ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে রাতের অন্ধকারে মাদরাসার শিক্ষার্থী ও আলেমদের ওপর ‘অপারেশন ফ্ল্যাশআউট’ নাম দিয়ে গণহত্যা চালানো হয়। সবশেষ এবারের জুলাই-আগস্টের গণহত্যা শেখ হাসিনার শাসনামলের অতীতের সব গণহত্যার রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে প্রায় দুই হাজার নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে ক্যামেরার সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করে শেখ হাসিনা সরকার। আহত হয়েছেন প্রায় ২৫ হাজার মানুষ। যাদের মধ্যে কেউ এক চোখ, এক পা কিংবা এক হাত হারিয়েছেন। আবার অনেকে চিরজীবনের জন্য হারিয়েছেন দুই হাত, দুই পা কিংবা দুই চোখ।
এসব হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি গত ১৬ বছরে শেখ হাসিনা তার ফ্যাসিবাদী শাসন প্রলম্বিত করার জন্য বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের কত নেতাকর্মীকে যে হত্যা করেছে তার ইয়ত্তা নেই। এ ছাড়া শেখ হাসিনার শাসনামলে গুম হওয়া মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজারের মতো মানুষকে গুম করে শেখ হাসিনা সরকার। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, যার নেতৃত্বে দেশে হত্যা, গণহত্যা, গুম-খুন হয়েছে সেই শেখ হাসিনাকে ৫ আগস্ট নিরাপদে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে দেয়া হয়েছে। শুধু শেখ হাসিনাই নন তার সাথে থাকা অপকর্মের সহযোগীদেরও নিরাপদে দেশত্যাগের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এসব মানবতাবিরোধী অপরাধীদের যারা নিরাপদে দেশত্যাগে সহযোগিতা করেছেন তাদের আইনের আওতায় আনা দরকার।
৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যা ও গুম-খুনের মামলার বিচার শুরু হয়েছে। কিন্তু এসব মামলার ভবিষ্যৎ কী হবে তা বলা মুশকিল। একই সাথে উৎকণ্ঠার বিষয় হলো ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার এই বিচার সম্পন্ন করতে পারবে কি না। কারণ পরবর্তী কোনো সরকার ক্ষমতায় এসে বিচার কাজ আদৌ কতটুকু সম্পন্ন করবে, তা নিয়ে জনমনে সংশয় আছে। আগামী দিনে যে সব রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার হবেন তারা আওয়ামী সরকারের গণহত্যার বিচার করার ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে অঙ্গীকার না করলে এসব বিচার ব্যাহত, বিলম্বিত কিংবা বন্ধ হয়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়। সে ক্ষেত্রে গণহত্যাকারীরা বিনা বিচারে পার পেয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পরপরই দেশে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে কথা উঠেছে। যেখানে এখনো গণহত্যায় নিহত স্বজনদের শোক কাটেনি, গণহত্যার বিচার হয়নি, আহতরা হাসপাতালের বিছানায় সুস্থ হওয়ার আকাক্সক্ষায় কাতরাচ্ছেন, গুম হওয়া মানুষের স্বজনরা তাদের প্রিয়জনদের ফিরে আসার প্রহর গুনছেন, সেখানে এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অধিকার থাকবে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক করা গণহত্যার শহীদদের রক্ত ও গুম-খুন হওয়া মানুষদের সাথে রীতিমতো বেইমানি ছাড়া কিছু নয়।
দেশে একাত্তর সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর সব ধরনের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে শুরু করে দেশের সব কার্যালয় ছিল তালাবদ্ধ। যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে জামায়াতের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের ওপর চলেছে ভয়াবহ নির্যাতন। এত কিছুর পরও জামায়াত যুদ্ধাপরাধের বিচার সৎসাহসের সাথে মোকাবেলা করেছে, ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায়। কিন্তু তারা ন্যায়বিচারের পরিবর্তে পেয়েছে চরম জুলুম আর বিচারের নামে প্রহসন। বলা যায়, এটি ছিল বিচারিক হত্যাকাণ্ড। যার মধ্য দিয়ে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের তথাকথিত বিচারের অধ্যায় শেষ হয়েছে। জামায়াত রাজনীতি করছে নিজেদের মতো। কিন্তু গত ১৬ বছরে শেখ হাসিনার আমলে সংঘটিত হত্যা, গণহত্যা ও গুম-খুনের বিচার না হওয়া পর্যন্ত দলটি দেশে রাজনীতি করার স্বপ্ন দেখে কীভাবে?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নির্যাতিত নেতা ও বর্তমান তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি বলেছেন, জীবন থাকতে আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরতে দেয়া হবে না। আওয়ামী লীগ যদি রাজনীতিতে ফিরে আসে, তাহলে গণ-অভ্যুত্থান ও শহীদদের সাথে প্রতারণা করা হবে। তথ্য উপদেষ্টা যে আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরতে দিতে চান না, তা তিনি কিসের ভিত্তিতে নিশ্চিত করবেন? এ কথা সত্য যে, প্রবল জনমতের কারণে এ সময়ে আওয়ামী লীগের মাঠের রাজনীতিতে ফেরা সম্ভব নয়। কিন্তু এমন একটি গণহত্যাকারী দলকে কি বিচারের আগ পর্যন্ত আইন করে রাজনীতির নামে অপরাজনীতি করা থেকে বিরত রাখা সম্ভব না?
আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক সাক্ষাৎকারে বিশ্ববিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনকে বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে স্বাগত জানানো হবে, যখন দলটির যারা হত্যা ও ক্ষমতার অপব্যহারের সাথে জড়িত তাদের বিচার সম্পন্ন হবে।
গণহত্যাকারী হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার তো নিশ্চিত করতেই হবে, সেই সাথে দল হিসেবেও আওয়ামী লীগের বিচার করা জরুরি; যাতে ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ তো নয়ই, আওয়ামী লীগের মতো আর কোনো রাজনৈতিক দলই দেশে গুম-খুন ও গণহত্যার মতো ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড চালাতে না পারে। বিচারের আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফেরা ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ বন্ধ করতে ড. ইউনূসের সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। একই সাথে এই কাজে বিএনপি-জামায়াতসহ ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সব দলের ঐক্যবদ্ধ থাকা হসময়ের অপরিহার্য দাবি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা