রাজনীতিতে নির্বাচনী রোডম্যাপ জটিলতা
- ডা: ওয়াজেদ খান
- ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে রাজনীতিতে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার এখন রোডম্যাপ গ্যাঁড়াকলে। রোডম্যাপের দাবিতে সরব রাজনৈতিক দলগুলো। বিশেষ করে দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে বিএনপি। সংস্কারের জন্য যৌক্তিক সময় দেয়ার পূর্ব অঙ্গীকার থেকে সরে এসেছে দলটি। অনেক রাজনৈতিক নেতা রোডম্যাপ প্রশ্নে বাক্যবাণ ছুড়ছেন সরকারের প্রতি। সমালোচনা করছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারীদেরও। অতিশয় ধীরলয়ে চলমান সরকার কবে সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের পথে হাঁটবে এ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোতে। বাড়ছে পারস্পারিক অবিশ্বাস, অশ্রদ্ধা ও আস্থাহীনতা। এরই মধ্যে সরকারের ১০০ দিন পূর্তিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ভাষণে রোডম্যাপের কোনো উল্লেখ করেননি তিনি। অত্যাবশ্যকীয় সংস্কারকর্ম শেষে কাক্সিক্ষত নির্বাচন আয়োজনের পথে হাঁটবে সরকার। সংশ্লিষ্টদেরকে ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা। সংস্কারের জন্য নির্বাচন কয়েক মাস বিলম্ব হতে পারে এমন আভাসও দেন তিনি। ড. ইউনূসের ভাষণে হতাশা প্রকাশ করেছেন বিএনপি মহাসচিব। অন্তর্বর্তী সরকারকে ম্যান্ডেটবিহীন বলে অভিহিত করে দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানান তিনি। সব কিছু মিলিয়ে চলমান রাজনীতিতে ক্রমেই বাড়ছে সঙ্ঘাতের সম্ভাবনা। চারদিকের অনেক অমূলক দাবি ও বিতর্ক বাহাসে চাপা পড়তে বসেছে হাজারো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক আকাক্সক্ষা।
রোডম্যাপ আসলে কী? সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে চাউর আছে শব্দটি। রোডম্যাপ হলো কৌশলগত পরিকল্পনা। কোনো কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছতে এমন পরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে কত সময় প্রয়োজন তা নিরূপণ করা। পরিকল্পনার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছতে কী কী ধাপ অতিক্রম করতে হবে এবং আর্থিক ব্যয়সহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে প্রকল্পের শুরুতে সব কিছু স্পষ্ট করা। অন্তর্বর্তী সরকারের মূল অ্যাজেন্ডা রাষ্ট্র সংস্কার। নির্বাচন আগে না রাষ্ট্র সংস্কার আগে? রাজনীতিতে এমন বিতর্ক চলছেই। সরকার চায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে সংস্কারকাজ সম্পন্ন করতে। এ জন্য কোনো সময়সীমার উল্লেখ না করে সরকার গঠন করেছে ১০টি সংস্কার কমিশন। যেহেতু বিএনপি সবচেয়ে বড় দল এবং আওয়ামী লীগ রাজনীতির ময়দান ছাড়া, তাই দলটি স্বভাবতই গোল দিতে চায় খালি মাঠে। রোডম্যাপ নিয়ে বিএনপিতে অস্থিরতা এ কারণেই। সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করলে নিশ্চিত হতে পারে দলটি। সেনাপ্রধান ১৮ মাসের মধ্যে সংস্কার শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি ধারণা দিয়েছেন। কিন্তু সরকার বিষয়টি আমলে না নেয়ায় বিএনপিতে ক্রমশই ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে উৎকণ্ঠার পারদ।
বিএনপির কাছে রোডম্যাপের গন্তব্য হচ্ছে জাতীয় সংসদ। আর মূল লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া। দলটি রোডম্যাপের দাবিতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করলেও তাদের নেই কোনো নিজস্ব রোডম্যাপ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি একটি মধ্যপন্থী দল। তারা দীর্ঘ সময় দেশ শাসন করেছে। বিগত ১৬ বছর ক্ষমতার রাজনীতি করতে গিয়ে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী দুঃশাসনে গুম, খুন, হত্যা জেল-জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছে বিএনপির লাখো নেতাকর্মী। আন্দোলন সংগ্রামে অনেক ভুলভ্রান্তি ও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে দীর্ঘদিন পর্যন্ত সাফল্যের মুখ দেখেনি দলটি। জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছিল বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। এই আন্দোলনে ফ্যাসিবাদী শক্তি ছাড়া এক রােতধারায় মিশে যায় সারা দেশের মানুষ। গণ-অভ্যুত্থানের মূল আকাক্সক্ষা হলো বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, আইনের শাসনের মানবিক বাংলাদেশ। আর এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য দাবি ওঠে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের। ৫ আগস্টের আগের পুরনো রাজনীতি, পুরনো সংবিধান গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে অচল। রাজনীতির পুরনো সংস্কৃতিতে পুনরায় ফিরে যাওয়ার সব রোড ক্লোজড। ফ্যাসিবাদের পতনের সাথে যবনিকাপাত ঘটেছে রাষ্ট্রীয় নাটকের অনেক অধ্যায়েরও।
গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটলেও রাজনৈতিক দলগুলোর ন্যূনতম কোনো পরিবর্তন ঘটেনি অভ্যন্তরীণ সংস্কৃতিতে। কোনো কোনো দল রাষ্ট্র মেরামতের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে বটে, কিন্তু মৌলিক রাজনৈতিক সংস্কারের স্পষ্ট উল্লেখ নেই তাতে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মৌলিক ও ব্যাপক সংস্কারের বিষয়টি আলোচিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্রের মূল নিয়ামক। দিন শেষে রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকেন রাজনীতিকরাই। রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতান্ত্রিক, কলুষমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক করতেই প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কার। এটি যেমন সময়ের দাবি, তেমনি প্রয়োজন দলগুলোর নিজ স্বার্থে। রাজনীতির পুরনো সংস্কৃতিই যে ফ্যাসিবাদ তৈরির কারখানা- এটি এখন প্রমাণিত সত্য। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট করে তুলেছে শেখ হাসিনাকে। দলগুলো যে অতীত রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে সরে এসেছে তার দৃশ্যমান প্রমাণ রাখতে হবে জনগণের কাছে। রাষ্ট্র সংস্কার ছাড়া অতিদ্রুত নির্বাচন এবং ক্ষমতার হাতবদল ক্ষমতা হারানোর পথকে ত্বরান্বিত করবে মাত্র। স্থিতিশীল ও টেকসই গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনের আগেই রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে আনতে হবে কাঠামোগত পরিবর্তন। নেতাকর্মীদের গোপন ব্যালটে নিশ্চিত করতে হবে নেতৃত্ব। এ কাজটি শুরু করতে হবে তৃণমূল থেকে। গণতন্ত্র ও দুর্নীতির গতি বিপরীতমুখী। গণতন্ত্র ধাবিত হয় নিচ থেকে উপরে। পক্ষান্তরে দুর্নীতির গতি উপর থেকে নিম্নমুখী।
রাজনৈতিক দলগুলোকে বিবেচনায় রাখতে হবে- নির্বাচন হলেই দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন কায়েম হয় না। অতীতে এক ডজন সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারগুলো পারেনি এ ধরনের নজির স্থাপন করতে। এছাড়া জাতীয় সংসদে স্থান পায়নি যোগ্য প্রতিনিধি। আইনপ্রণেতার পরিবর্তে জাতীয় সংসদে বারবার হাট বসেছে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী ও পেশিশক্তির অধিকারীদের। জনবিচ্ছিন্ন এসব বেনিয়ারাই তৈরি করেছে হাসিনার মতো ফ্যাসিস্ট। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে রাজনৈতিক দলের টিকিট কেটে বিনা ভোটে এমপি হয়েছেন এরা। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর তিন জোটের রূপরেখাও হয়নি বাস্তবায়িত। রাজনীতির এহেন সংস্কৃতি বন্ধ করতেই প্রয়োজন নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত।
অন্তর্বর্তী সরকারকেও রোডম্যাপের দাবি আমলে নিতে হবে গুরুত্বের সাথে। বোবার শত্রু নেই মনে করে নিশ্চুপ থাকা যাবে না। রোডম্যাপ ঘোষণা করে উৎকণ্ঠা লাঘব করতে হবে রাজনীতিকদের। কেউ কাউকে প্রতিপক্ষ ভাবার সুযোগ নেই। বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা কটাক্ষ করা বয়স্ক রাজনীতিকদের জন্য বেমানান। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার সব কিছু সংস্কার করতে পারবে না। সম্ভব নয় রাতারাতি সব কিছু বদলে ফেলা। সরকারকে রাষ্ট্রীয় কর্মপরিকল্পনায় নির্ধারণ করতে হবে অগ্রাধিকার। ওয়ান-ইলেভেনের ফখরুদ্দীন-মঈনউদ্দিন সরকার শতমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করে জটিলতার মুখে পড়ে। গ্রামের গুদারা ঘাট থেকে সমুদ্রবন্দর। সরকারি অফিসের পিয়ন থেকে সচিব। চৌকিদার থেকে সেনাপ্রধান। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। এসব করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে দুর্নীতিবিরোধী মূল অভিযান। সেই সরকার দু’বছর সময়কাল ক্ষমতা ধরে রাখলেও রাষ্ট্রব্যবস্থায় আসেনি কোনো পরিবর্তন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভেতর সংস্কার আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তারা।
বর্তমান সরকারকে শিক্ষা নিতে হবে অতীত থেকে। অসময়োচিত কাজে কালক্ষেপণ করে ব্যাহত করা যাবে না কাক্সিক্ষত রাষ্ট্রসংস্কারের কাজ। দু’হাজার প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন-সাধ অপূর্ণ থেকে গেলে দেশ ও জাতি নিপতিত হবে গভীর সঙ্কটে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও প্রমাণ রাখতে হবে ধৈর্য ও সহনশীলতার। ধরে রাখতে হবে গণ-অভ্যুত্থানের সফলতা। মহান এই পরিবর্তনের অংশীদার রাজনৈতিক দলগুলোও। তাই অন্তর্র্বর্তী সরকারকে চাপে না রেখে সমস্যার সমাধান করতে হবে আলোচনার মাধ্যম। গণ-অভ্যুত্থানের কাক্সিক্ষত নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নের শিখরে পৌঁছতে হাতে হাত রেখে হাঁটতে হবে সবাইকে। ঐতিহাসিক ও নজিরবিহীন মহান এ গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা ও মেয়াদকাল নিয়ে কোনো প্রশ্ন বা বিতর্কের অবতারণার অবকাশ নেই। এমনিতেই সরকারের সব উদ্যোগ, পরিকল্পনা ও সফলতাকে ম্লান করে দিয়েছে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। সাধারণ মানুষ স্বভাবতই তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে দেখতে চায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য।
বড় বড় দুর্নীতিবাজদের গ্রেফতার করে কারাগারে নেয়া হচ্ছে ভালো কথা। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাগ্যের যদি সামান্যতম পরিবর্তন না ঘটে, তাহলে সরকারের পক্ষে দুরূহ হবে জনসমর্থন ধরে রাখা। এ জন্য সরকারকে পালন করতে হবে উদ্যমী ও গতিশীল ভূমিকা। সরকারের উচিত সব ধরনের জটিলতা ও বিতর্কের ঊর্র্ধ্বে থেকে ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। ইংরেজিতে একটি কথা আছে- ‘সামথিং অব এভিরিথিং, এভরিথিং অব সামথিং, বাট নট এভরিথিং অব এভরিথিং।’ ‘সব কিছুর কিছু কিছু, কিছু কিছুর সব কিছু। কিন্তু সব কিছুর সব কিছু নয়।’ ব্যক্তি, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই কথাটি প্রযোজ্য। সব কিছুর সব কিছু সম্পন্ন করা সম্ভব নয় সরকারের পক্ষে। সব কিছু করতে গেলেই বিপাকে পড়বে, পাকিয়ে ফেলবে তালগোল। কঠিন হবে রোডম্যাপের গ্যাঁড়াকল থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের বেরিয়ে আসা।
লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, নিউ ইয়র্ক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা