মোহন মিয়া এক মানবতাবাদী রাজনীতিবিদ
- ডা: ননীগোপাল সাহা
- ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়া এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বিশিষ্ট নাম। এক প্রখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। যে যুগে মোহন মিয়া তার কর্মমুখর জীবনের পথে যাত্রা শুরু করেছিলেন সে যুগ ছিল সাফল্যে পরিপূর্ণ। এ যুগেই ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে। সেদিনের রাজনৈতিক অঙ্গনে মোহন মিয়া ছিলেন এক সুযোগ্য এবং বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তার রাজনৈতিক দর্শনের মূল কথা ছিল মানবতাবাদ। বর্তমান পুঁজিবাদ বা সাম্রাজ্যবাদ কোনোটিতেই বিশ্বাস করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন এক লোকাশ্রিত গণতন্ত্রে।
১৯৪৫-১৯৪৭ সালে ফরিদপুরে তাকে একবার দেখেছিলাম। বিরাট মিছিলের পুরোভাগে মাল্যভূষিত একটি সৌম্য শান্ত মানুষ অম্বিকা ময়দানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। জেনেছিলাম ইনিই ফরিদপুরের জনপ্রিয় নেতা মোহন মিয়া। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তির জন্য স্বাধীনতা আন্দোলনের দুর্বার ঢেউ দিল্লি থেকে তখন সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে। ’৫২ সালের রক্তাক্ত বাংলার মাটিতেই রোপিত হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ। ভাষা আন্দোলনের দিনটিতে মোহন মিয়া ফরিদপুরে ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের প্রতি তার অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। মুসলিম লীগে থাকলেও তিনি ভাষা আন্দোলনে নুরুল আমিনের কার্যক্রম সমর্থন করেননি। ওই সময় মোহন মিয়া একটি দৈনিক পত্রিকায় ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন।
১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানী কাগমারী সম্মেলন করে নেতাজি সুভাষ গেট, গান্ধী গেট করে বিতর্কিত হন এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরাগভাজন হন। এই সময়ই তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। তখন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন মাওলানা তর্কবাগীশ এবং সম্পাদক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এই সময় পর্যন্ত পাকিস্তানের রাজনীতিতে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের আধিপত্য এবং প্রতিপত্তি অনেকটাই বজায় ছিল। আইয়ুবের সামরিক শাসনামলে দীর্ঘ কয়েক বছর রাজনৈতিক কার্যক্রম একেবারেই স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলো একত্রে বা পৃথকভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। ৬০-এর দশক থেকেই ধীরে ধীরে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণ-অসন্তোষ বাড়তে থাকে। ১৯৬২ সালের জুন মাসে আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে যৌথ আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে সব বিরোধী দলের নেতারা একটি যৌথ বিবৃতি প্রচার করেন। সেটি নয় নেতার বিবৃতি নামে পরিচিত। ৯ নেতার মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগ থেকে আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান, মুসলিম লীগ নূরুল আমিন, ন্যাপ থেকে মাহমুদ আলী, নেজামী ইসলাম থেকে পীর মোহসিন উদ্দিন এবং কৃষক পার্টি থেকে হামিদুল হক চৌধুরী, আবু হোসেন সরকার, সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া) ও ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়া।
মোহন মিয়াদের এই বিবৃতি গণসমর্থন লাভ করেছিল। জনগণের মধ্যে একটা আশার আলো সঞ্চারিত হয় এবং একটা আলোড়ন তোলে। এতে আইয়ুব খান ভীত হলেন। তিনি রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ বন্ধের লক্ষ্যে ১৯৬২ সালের ৩০ জুন জাতীয় পরিষদে একটি বিল আনেন। এই বিলের সংক্ষেপ নাম এবডো। এই আইনে যেকোনো রাজনৈতিক নেতাকে অযোগ্য ঘোষণা করা যাবে এবং তিনি কোনো দল গঠন করতে পারবেন না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একটি দলহীন ঐক্য সংস্থা গড়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং সব বিরোধী দলের নেতাদের নিয়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নামে একটি জোট গঠন করেন।
এই জোটের ঘোষণাপত্রে আইয়ুবের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয়া হয় এবং গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার সঙ্কল্প ব্যক্ত করা হয়। এই জোটে ৫৪ জন নেতার নাম ঘোষণা করা হয়। তার মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ নয় নেতার সবাই ছিলেন যেমন- ইউসুফ আলী চৌধুরী, মোহন মিয়া, নুরুল আমিন, আজিজুল হক, আতাউর রহমান, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ।
আইয়ুবের উদ্ভট চিন্তার ফসল হচ্ছে তার দেয়া মৌলিক গণতন্ত্র। ১৯৬২ সালের আইয়ুব খান নতুন মেম্বারদের জন্য নির্বাচন দিলেন। অর্থাৎ জনগণ ভোট দিয়ে মেম্বার নির্বাচন করবেন। ১৯৬৪ সালে আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঘোষণা দিলেন। মৌলিক গণতন্ত্রের অধীনে নির্বাচন হবে। অর্থাৎ জনগণ সরাসরি ভোট দিতে পরবেন না। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবে মৌলিক গণতন্ত্রী অর্থাৎ মেম্বারদের ভোটে। যদিও এ নির্বাচন ছিল একটি প্রহসনের নির্বাচন।
মোহন মিয়ার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে কর্মবহুল দিন ছিল ফাতেমা জিন্নাহর সমর্থনে আইয়ুববিরোধী প্রচারণার দিনগুলো। মোহন মিয়ার জনপ্রিয়তা ছিল সবার শীর্ষে। শেষ পর্যন্ত সেই কাক্সিক্ষত নির্বাচনের দিনটি এলো ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি। ফরিদপুরের ভোটারের অনুকূল সাড়া দেখে আমরা ভেবেছিলাম নির্বাচনে জয়লাভ করব। কিন্তু আমাদের ধারণা ভ্রান্ত ছিল। কারণ ফরিদপুরের অনুকূল সাড়ার পেছনে ছিল মোহন মিয়ার অবদান। সারা দেশের চেহারাটি ছিল ভিন্নরূপ।
আইয়ুব খানের সামনে সব পথ তখন অবরুদ্ধ। উপায়ন্তর না দেখে তিনি দ্রুত ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নিলেন। আইয়ুব খানের বিদায় ভাষণটি আমার খুব ভালো লেগেছিল। কোনো স্বৈরশাসকের নিজের ভুল স্বীকার করে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাওয়ার নজির খুব বিরল। তবে আইয়ুব খানের দূরদৃষ্টি ছিল পাকিস্তানের দুই অংশ যে, একদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, এটা বোধ হয় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।
ইউসুফ আলী চৌধুরী, মোহন মিয়া স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে চিরকালই সোচ্চার ছিলেন। তিনি ছিলেন গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ সেবক। এ দেশের গণমানুষের রাজনৈতিক স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। মানুষের কল্যাণের জন্যই তিনি রাজনীতি করেছেন, নিজের ভাগ্য গড়তে নয়।
মোহন মিয়া এক কালজয়ী নেতা, তাকে ভোলা যায় না। তার কাছে দেশবাসী তথা ফরিদপুরের জনগণের ঋণ সীমাহীন। মোহন মিয়া মানেই এক আপসহীন সংগ্রামী নেতা। স্বদেশের কল্যাণই ছিল তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তার স্মৃতির প্রতি রইল আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা ও বিনম্র সালাম।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা