আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কেন ভোলা উচিত নয়
- এহসান এ সিদ্দিক
- ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাত ১০টা ১ মিনিটে আবদুল কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তিনিই ছিলেন বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া প্রথম ব্যক্তি। তার মামলাটি দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ন্যায়বিচারের অন্যতম গুরুতর বিচ্যুতির দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য, আইনসভা পূর্ববর্তী সময়ে কার্যকারিতা দিয়ে সংশ্লিষ্ট আইনটি সংশোধন করে সরকারকে তার প্রাথমিক যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ করে দেয়। তৎকালীন আপিল বিভাগ তার ফাঁসি নিশ্চিত করার জন্য সরকারের অভিপ্রায়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আইনশাস্ত্রের প্রতিষ্ঠিত নীতি এবং প্রমাণের পুনর্ব্যাখ্যা দেন।
২০১৩ সাল ছিল নির্বাচনী বছর আর সংসদ সদস্য ও সরকারের মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকে ‘জাতির জন্য একটি উপহার’ বলে উল্লেখ করেন। তৎকালীন আপিল বিভাগের দেয়া এক ‘সংক্ষিপ্ত আদেশের’ ভিত্তিতে আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। যে দিন রায়টি গ্রহণ করা হয় সে দিনই যাতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যায় সেই অনুমোদন দেয়ার জন্য মামলাটি বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়। অভিযুক্তকে কখনোই পূর্ণাঙ্গ আদেশ দেখার সুযোগ দেয়া হয়নি, যার ওপর ভিত্তি করে তার জীবনের অবসান ঘটানো হয়েছিল। এ ঘটনাটি তৎকালীন আপিল বিভাগের ইতিহাসে সবচেয়ে লজ্জাজনক পর্বগুলোর একটি, যার মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচারের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের ক্ষেত্রে একটি গুরুতর ও ন্যক্কারজনক অবহেলার প্রতিফলন ঘটে।
এই ডিসেম্বরে আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের ১১তম বার্ষিকী। সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সদস্যদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে যারা এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর সংশোধনের কথা বলছেন তাদের জন্য মোল্লার মামলাটি মনে রাখা অত্যাবশ্যক। তার মৃত্যুদণ্ড শুধু একটি সেকেলে এবং ত্রুটিপূর্ণ আইনের ফসল নয়; বরং একটি অনুগত বিচারব্যবস্থারও ফল ছিল।
প্রাথমিকভাবে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য একেবারে সীমিত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ট্রাইব্যুনাল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। তার মামলায় বেশির ভাগ প্রমাণই দুর্বল ছিল এবং জেরা ও প্রমাণ-পরীক্ষায় তা ভেঙে পড়েছিল। একজন উল্লেখযোগ্য সাক্ষী মোল্লাকে ট্রাইব্যুনালে জড়ান কিন্তু তার লেখা একটি বইতে একই ঘটনার বিবরণে তাকে অভিযুক্ত হিসেবে উল্লেখই করেননি। তার কী অজুহাত ছিল? তিনি যখন সাক্ষ্য বক্সের জন্য ‘সত্য রক্ষা করেছেন’ বলে অঙ্গীকার করেছেন। বিচারকরা প্রসিকিউশন বা সরকার পক্ষকে কার্যকরভাবে চ্যালেঞ্জ করার জন্য ডিফেন্স বা অভিযুক্ত পক্ষের ক্ষমতা ক্ষুণœ করে প্রায়ই সাক্ষীদের জেরা থেকে রক্ষা করতে হস্তক্ষেপ করেছেন।
আপিল বিভাগ অবশ্য আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করে দেন। তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল একটি একক অভিযোগের ভিত্তিতে এবং ঘনিষ্ঠভাবে পরীক্ষা করলে স্পষ্ট হয়, কিভাবে রাষ্ট্র এবং তৎকালীন আপিল বিভাগ তার ফাঁসি নিশ্চিত করার ষড়যন্ত্র করেছিল। প্রথমত, আপিল বিভাগ আন্তর্জাতিক আইন সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে গেছেন। আন্তর্জাতিক আইনি মান মেনে চলার বিষয়টি মামলাটিকে জটিল করে তুলবে বলে স্বীকার করে ঘোষণা করা হয় যে, আন্তর্জাতিক আইন এই ট্রাইব্যুনালের জন্য প্রযোজ্য নয়। এটি যুগোস্লাভিয়া, রুয়ান্ডা ও সিয়েরা লিওনে জাতিসঙ্ঘের ট্রাইব্যুনালগুলোতে স্থাপিত নজিরগুলোর বিস্তৃত অংশ বাদ দিয়ে দেয়। আপিল বিভাগ তার দীর্ঘ রায়ে একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায়েরও উল্লেখ করেননি। এর পরিবর্তে আপিল বিভাগ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে হত্যার নিজস্ব সংজ্ঞা তৈরি করে।
আবদুল কাদের মোল্লার কৌঁসুলি আবদুর রাজ্জাক যখন জাতিসঙ্ঘের রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনালের রায়ের উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন, তখন প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন একটি অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য দিয়ে সেটি খারিজ করেছিলেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাস, ১৭২৬ সালের মেয়র আদালতের সময়ের তুলনায় অনেক বেশি উন্নত। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা আফ্রিকান দেশগুলোর আইনি ব্যবস্থার চেয়ে উন্নত। এভাবে খারিজ এবং জাতিগতভাবে অভিযোগ পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইনি মান উপেক্ষা করে সুবিধাজনকভাবে অবস্থান নেয়া হয়েছে, যা আপিল বিভাগকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সংজ্ঞা পুনর্নির্ধারণ করার সুযোগ এনে দেয়। এ ধরনের অপরাধ প্রমাণের জন্য ব্যাপক বা পদ্ধতিগত আক্রমণ বা বেসামরিক জনগণের ওপর আক্রমণের প্রয়োজন নেই বলে উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক আইনের বিপরীতে গিয়ে, আপিল বিভাগ রায় দেয়। বৈশ্বিক মানদণ্ড থেকে এই উদ্বেগজনক বিচ্যুতি মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পথ তৈরি করে দেয়।
দ্বিতীয়ত, আপিল বিভাগ যৌথ ফৌজদারি অপরাধ উদ্যোগ মতবাদের পুনর্ব্যাখ্যা করে কার্যকরভাবে এটিকে সাহচর্যের অপরাধের সমপর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন। আবদুল কাদের মোল্লাকে দোষী বলে গণ্য করা হয়েছিল কারণ তাকে এমন ব্যক্তিদের সাথে মেলামেশা করতে দেখা গেছে যারা অপরাধ করেছিল।
অবশেষে আপিল বিভাগ জেরা এবং সাক্ষ্যের গ্রহণযোগ্যতা যাচাইয়ের রুল বা নিয়ম পরিবর্তন করে ফেলে। মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার মূল অভিযোগটি ছিল মোমেনা বেগমের সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করে, যিনি তাকে ট্রাইব্যুনালে তার জবানবন্দীতে অভিযোগের সাথে জড়িয়েছিলেন। তবে তিনি একটি জাদুঘর এবং ট্রাইব্যুনালের নিজস্ব তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে তার আগের বিবৃতিতে অভিযুক্তের নাম উল্লেখই করেননি। এই আগের অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিবৃতিগুলো অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের মামলাকে দুর্বল করে ফেলে। এটি মোকাবেলা করার জন্য, আপিল বিভাগ এ ক্ষেত্রে বিধান বা রুলটাই পাল্টে দেয় : বলা হয়- সরাসরি সাক্ষ্যের (এক্সামিনেশন-ইন-চিফ) সময় দেয়া বিবৃতিতে জেরা সীমাবদ্ধ থাকবে। এটি ডিফেন্সকে মোমেনার আগের অসামঞ্জস্যপূর্ণ বক্তব্যের বিষয়টি উপস্থাপনে বাধা সৃষ্টি করে। জেরা-পরীক্ষার উল্লেøখযোগ্য অংশ তুলতে অনুমতি না দিয়ে, আপিল বিভাগ আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পথ পরিষ্কার করে।
একজন ডিফেন্স আইনজীবী হিসেবে ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করায়, এটি দ্রুতই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ন্যায়বিচারের সবচেয়ে বড় বাধা শুধু সেকেলে আইন নয়- বাধা ছিল ট্রাইব্যুনাল এবং তৎকালীন আপিল বিভাগের কর্মকাণ্ড। বারবার দেখা যায়, ট্রাইব্যুনাল আমাদের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জেরা করার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত প্রমাণাদি উপস্থাপনের সুযোগ দিতে অস্বীকার করেছে, যা অভিযুক্তের আত্মরক্ষাকে সমর্থন করতে পারে। অথচ একই সময় সরকার পক্ষকে একই সুযোগ অবাধভাবে দেয়া হয়েছে। এ দিকে আপিল বিভাগের আইনি নীতির নির্বাচিত পুনর্ব্যাখ্যা আমাদের মামলাকে আরো দুর্বল করেছে। এটি কেবল আইনি কাঠামোর ত্রুটি ছিল না; বরং এটি ছিল ন্যায়বিচার সমুন্নত রাখার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বারা আরোপিত পদ্ধতিগত পক্ষপাত ও পদ্ধতিগত বাধা, যা একটি ন্যায্য প্রতিরক্ষাকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছিল।
একজন সাবেক ডিফেন্স কৌঁসুলি হিসেবে বর্তমান চিফ প্রসিকিউটর মো: তাজুল ইসলাম, আইসিটির ঘাটতিগুলো সম্পর্কে তীক্ষèভাবে সচেতন এবং আইন সংশোধনের পক্ষে পরামর্শ দিয়ে সেগুলো মোকাবেলার জন্য নিষ্ঠার সাথে কাজ করছেন। অতীতে আইসিটির আন্তর্জাতিক আইনের সাথে অনুসৃতির ঘাটতি এবং বিচারক ও প্রসিকিউটরদের জন্য অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের মতো সমস্যার সাথে লড়াই করেছিল প্রসিকিউশন। ব্রিটিশ ব্যারিস্টার ও বিখ্যাত আন্তর্জাতিক অপরাধবিষয়ক আইনজীবী টবি ক্যাডম্যানকে প্রধান প্রসিকিউটরের বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে সাম্প্রতিক নিয়োগ প্রসিকিউশনের মান বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি পূরণের ইঙ্গিত দেয়। বিশেষ করে অতীতের প্রসিকিউটরদের ঘাটতি বিবেচনায় এটি একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে, যাদের অনেকেরই আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে প্রশিক্ষণের অভাব ছিল। আর্থিক অসদাচরণ ও পেশাগত অনৈতিকতার অভিযোগে কাউকে কাউকে বাদ দেয়া হয়। দক্ষতা ও সততার ওপর এই নতুন করে ফোকাস আরো শক্তিশালী ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রসিকিউশন প্রক্রিয়া এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছে।
নতুন ট্রাইব্যুনাল এখন একটি গভীর কলঙ্কিত ইতিহাস কাটিয়ে ওঠার গুরুদায়িত্বের মুখোমুখি। এ ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে সংঘটিত ন্যায়বিচারের বিচ্যুতির সমাধান করতে হবে। যারা ন্যায্য বিচার নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর পরিবর্তনের পক্ষে, তাদের কাছে প্রশ্ন, কেন একই ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থার অধীনে ইতোমধ্যে সংঘটিত অন্যায়ের বিষয়ে কথা বলা হলো না? অতীতের অন্যায় উপেক্ষা এবং একই আইনের অধীনে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সদস্যদের মুখোমুখি করা দুর্ভোগ ও মৃত্যুদণ্ডকে উপেক্ষা করে শুধু বর্তমান বিচারের ন্যায্যতা নিশ্চিত করার জন্য সংশোধনী চাওয়া একটি সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডারই প্রকাশ ঘটায়। এ ধরনের পক্ষপাতমূলক ওকালতি ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতার বৃহত্তর সাধনাকে দুর্বল করে।
এ ক্ষেত্রে একটি গঠনমূলক উপায় হবে যুক্তরাজ্যের ক্রিমিনাল কেস রিভিউ কমিশনের (সিসিআরসি) মতো একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা। এ ধরনের কমিশন গঠনের জন্য আইন সংশোধন জরুরি। আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করা হয়েছে অথবা আপিল নিষ্পত্তি করা হয়েছে- এমন নির্বিশেষে এ সংস্থাটিকে মামলাগুলো পর্যালোচনা করার দায়িত্ব দেয়া হবে। এটি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পরিবারের পক্ষ থেকে মরণোত্তর আবেদনগুলোও পরিচালনা করবে। কমিশন পুনর্বিবেচনার সুপারিশ করলে আপিল বিভাগকে দোষী সাব্যস্ত ও সাজা পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করতে হবে।
যারা ন্যায্য বিচারের পক্ষে কথা বলছেন তাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, আজ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য অতীতের অন্যায়ের প্রতিকার করা প্রয়োজন। ন্যায়বিচারে অতীতের বিচ্যুতি সংশোধন করা ভবিষ্যত ট্রাইব্যুনালের ন্যায্যতা এবং আইনের শাসন মেনে চলার গুরুত্ব সম্পর্কে একটি অনুস্মারক হিসেবে কাজ করবে। এটি ন্যায়বিচার পরিচালনাকারীদের জন্য সততা এবং ন্যায্যতার সাথে কাজ করার ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী উদ্দীপনা তৈরি করবে।
লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিবন্ধিত কৌঁসুলি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা