২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ব্যাংক খাত সংস্কারে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা

-

অন্তর্বর্তী সরকার যেখানে হাত দিচ্ছে সেখানেই নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের চিত্র ফুটে উঠছে। স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের লুটপাট, দুর্নীতি ও অনিয়মের এমন সব ভয়াবহ তথ্য গণমাধ্যমে আসছে যে, কোন খাতে কম বা কোন খাতে সবচেয়ে বেশি নির্ণয় করা কঠিন। তবে ব্যাংক খাতের অবস্থা যে সবচেয়ে ভঙ্গুর তা সবাই মানবেন।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকির পরও ব্যাংক খাতের দুর্দশার জন্য মূলত দায়ী দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন। আইনি দুর্বলতা, ফাঁকফোকরও এজন্য দায়ী। প্রচলিত ও ইসলামী ধারার ব্যাংকসহ বর্তমানের প্রায় ৬২টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে গুটিকয়েক ছাড়া অধিকাংশই তারল্য সঙ্কটে রয়েছে।
আজকের সমাজ-অর্থনীতি বহুলাংশে অর্থপ্রবাহের স্বচ্ছতা, নির্ভরযোগ্যতা ও মসৃণতার ওপর নির্ভরশীল। অর্থের প্রবাহ নির্ভর করে ব্যাংকগুলোর ওপর। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং রেমিট্যান্স প্রেরণ ও প্রাপ্তিতে ব্যাংকের ভূমিকা আছে। অর্থ সঞ্চয়, সুদ-মুনাফা অর্জন, ঋণ বা বিনিয়োগ গ্রহণ বা বৃদ্ধির মাধ্যমে আয়/প্রাপ্তিতে ব্যাংকই নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান।
পতিত স্বৈরাচারী সরকার অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা বের করে নিয়েছে। হাতেগোনা কয়েকজন দুষ্ট ব্যবসায়ীকে এক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ব্রিটিশ গণমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা তার শাসনামলে ব্যাংক খাত থেকে ১৭ বিলিয়ন বা এক হাজার ৭০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ সরিয়েছেন।
তিনি আরো জানান, এর মধ্যে এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম (এস আলম) ও তার সহযোগীরাই নিয়েছেন অন্তত ১০ বিলিয়ন বা এক হাজার কোটি ডলার।
প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা দফতরের (ডিজিএফআই) সাবেক কিছু কর্মকর্তা শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক দখলে তাকে সহায়তা করেন। তিনি জানান, এসব ব্যাংক দখল করে আনুমানিক দুই লাখ কোটি টাকা (এক হাজার ৬৭০ কোটি ডলার) বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। এভাবে ব্যাংক ও আর্থিক খাত ভয়াবহ খাদের কিনারে পতিত হয়। যার ফলে ব্যবসায়-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে বিরাট শূন্যতা দেখা দেয়। বেড়ে যায় খেলাপি ঋণ। ২০২৪ সালের জুন শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকার ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। শুধু তাই নয়, গত ১৬ বছরের মধ্যে বিতরণ করা ঋণ ও খেলাপি ঋণের সর্বোচ্চ অনুপাত এটি। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাত সংস্কারে সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া ব্যাংক খাত সংস্কার সম্ভব নয়।
ব্যাংক খাত সংস্কারে ইতোমধ্যে গঠিত হয়েছে টাস্কফোর্স। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, টাস্কফোর্স আপাতত দুর্বল ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে কাজ করবে। তবে নন-ব্যাংক ফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) সংস্কারে আপাতত কাজ করছে না। কারণ, আর্থিক খাতে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অ্যাসেট মাত্র ৪ শতাংশ। বেশির ভাগ অর্থই ব্যাংকগুলোতে। এ জন্য ব্যাংক খাত নিয়েই আগে কাজ করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা রাখতে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন- মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়ন, টাকার সরবরাহ হ্রাস, সুদের হার দফায় দফায় বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারভিত্তিক করা এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং ক্রলিং পদ্ধতিতে ডলারের দর নির্ধারণের বিষয়গুলোও রয়েছে। তবে এ মুহূর্তে ব্যাংক খাতে প্রয়োজন খেলাপি ঋণ আদায়ের মাধ্যমে তারল্য ঘাটতি দূর করা, পরিদর্শনের মাধ্যমে অনিয়ম উদ্ঘাটন এবং আর্থিক খাতের সুশাসন নিশ্চিতের লক্ষ্যে প্রণীত রূপরেখা জনগণকে জানানো।
ব্যাংক খাত সংস্কারে যেসব বিষয় দেখা উচিত তা হলো : ১. গ্রাহকসেবার মান বাড়াতে হবে; ২. ব্যাংকের প্রকৃত মালিক কারা, মালিকানা স্বত্ব ও কর্তৃত্ব কেমন হবে, প্রতিষ্ঠানে তাদের প্রভাব; ৩. সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে সমন্বয় এবং সম্পর্ক থাকা; ৪. আমানতকারীদের ব্যাংকের ওপর আস্থা সুরক্ষা; ৫. বিনিয়োগ বা ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে নিয়মনীতি পরিপালন ও প্রভাবশালীদের বিষয়ে ব্যবসায়ীও ব্যাংকের সম্পর্কের বিষয় পরিষ্কার করা; ৬. ব্যাংকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও ব্যাংকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা-সংক্রান্ত বিষয়; ৭. প্রজেক্ট বিনিয়োগ ও অপচয় রোধ, ব্যয় কমানো ও মুনাফা বৃদ্ধির বিষয়; ৮. ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক বিষয়গুলো সম্পর্কে সুস্পষ্ট কাঠামো ও নীতিনির্ধারণ বিষয়গুলো বিবেচনা করা ও পদক্ষেপ নেয়া। খেলাপি ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালত কি যথেষ্ট সেটিও বিবেচনায় থাকা উচিত। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের কমিটমেন্ট ও তাদের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়গুলোও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানে অর্থনীতির পরিস্থিতি ও টেকসই অর্থনৈতিক ধারা রক্ষায় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনেক গুরুত্বের দাবি রাখে। ব্যাংক খাত সংস্কারে অর্থনীতির পাশাপাশি রাজনৈতিক উদ্যোগ ও বন্দোবস্ত এ মুহূর্তে খুবই জরুরি।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার
ইমেইল : main706@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement