২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ড. ইউনূস ও থ্রি জিরো তত্ত্ব

-

জীবিত বুদ্ধিজীবীদের যেকোনো তালিকায় প্রফেসর ইউনূস প্রথম পাঁচের মধ্যে থাকবেন। অনেকে তাকে এক নম্বরে রাখবেন। একজন বাঙালি মুসলমান দুনিয়ার লিডিং স্কলার, এটি ইতিহাসে দেখা যায়নি। আবার কবে হবে কেউ জানে না। বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন গ্লোবাল সেলিব্রেটি কয়েক শ’ বছরে আসেনি। পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক তিনটি পুরস্কার হলো : নোবেল, অ্যামেরিকার প্রসিডেন্সিয়াল অ্যাওয়ার্ড ও মার্কিন কংগ্রেশনাল অ্যাওয়ার্ড। ইতিহাসে এ তিনটি পুরস্কারই পেয়েছেন এমন মানুষ মাত্র ১২ জন। তার মধ্যে প্রফেসর ইউনূস একজন। মেসি হলেন বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তারকাদের একজন, আক্ষরিকভাবেই মেসি লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন ড. ইউনূসের সাথে ছবি তুলতে। অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের সবচেয়ে সম্মানিত অতিথি ধরা হয় অলিম্পিকের মশাল বাহককে, যা তিনি হয়েছিলেন ২০২৪ ও ২০২০ সালে যথাক্রমে ফ্রান্স ও জাপানের অলিম্পিকে।
২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিকের মূল থিম করা হয়েছে ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসায় তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে। ফরাসি নাক উঁচু জাতির গর্বের অলিম্পিক গেমসের ওয়েবসাইটের টাইটেল পেজে একজন ধূসর বর্ণের বাঙালি মুসলমান ড. ইউনূসের ছবি। তার সামাজিক ব্যবসায় এবং থ্রি জিরো- এই দু’টি জনহিতকর তত্ত্ব।
পৃথিবীর ১০৭টি ইউনিভার্সিটিতে মু. ইউনূস সেন্টার আছে। ইউনিভার্সিটিগুলো নিজেদের উদ্যোগে এটি করেছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে- তার মাইক্রো-ফাইন্যান্স। যেটি তাকে ও তার গ্রামীণ ব্যাংক এ দুটোকে নোবেল শান্তি পুরস্কার এনে দিয়েছে। দারিদ্র্য দূরীকরণে ৪০টির বেশি দেশ অনুসরণ করছে তার সামাজিক ব্যবসার মডেল। ড. ইউনূসের চিন্তা, কাজ, ভবিষ্যৎ লক্ষ্য ও তার জীবনাদর্শ নিয়ে বিশ্বের ৮০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে গবেষণা হয়।
জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেয়ার জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমেরিকাতে পাঁচ দিন অবস্থান করে প্রায় পঞ্চাশটির মতো মিটিং করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রধান এবং বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে। উনার সাথে অত্যন্ত আপসপূর্ণ বা বন্ধুসুলভ অভিব্যক্তি নিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কুশলবিনিময় করবেন সেটি অস্বাভাবিক নয়,তবে তিনি শুধুই কুশলবিনিময় করেননি, মাত্র ১৫ মিনিটের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও উনি কিন্তু ৩০ মিনিট বৈঠক করেছেন অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে। এত অল্প সময়ে বাংলাদেশের বিগত কোনো সরকারপ্রধান বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে এভাবে উপস্থাপন করতে পারেননি এবং এত সফলতাও নিয়ে আসতে পারেননি।
কেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বিশ্রীভাবে ‘সুদখোর’ ঢাকা হয় বারবার? মজার ও অবাক হওয়ার বিষয় হলো- ড. ইউনূসকে যারা পছন্দ করেন, তাদের বেশির ভাগও জানেন না, মুহাম্মদ ইউনূসের সুদের ব্যবসা নেই। গ্রামীণ ব্যাংক তার প্রতিষ্ঠিত হলেও গ্রামীণ ব্যাংকে তার এক টাকার মালিকানাও নেই, শেয়ারও নেই। কখনোই ছিল না। জিনিসটি আপনার-আমার কাছে আশ্চর্যজনক মনে হতে পারে। কিন্তু এটিই সত্যি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মাইক্রো-ফাইন্যান্সের ধারণার মূল ভিত্তিই হচ্ছে এটি। এই ব্যবসার কেউ মালিক হতে পারবে না। সম্পূর্ণ নন-প্রফিট তথা অলাভজনক। এটিকেই বলে সামাজিক ব্যবসায়। নির্দিষ্ট কোনো মালিক নেই। জনগণই এর মালিক।
বাইর থেকে অনুদানের টাকা এনে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ড মুহাম্মদ ইউনূস। এর ২৫ শতাংশ মালিকানা সরকারের, বাকি মালিকানা গরিব মানুষের। নিজের প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস মাত্র ৩০০ ডলার বেতনে চাকরি করতেন। তিনি যে নিজের কোনো শেয়ার রাখেননি তা নয়, কোম্পানিকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, যাতে কেউ এর একক মালিক হতে না পারে। কোম্পানি অধ্যাদেশ ২৮ ধারা অনুযায়ী তিনি এটি রেজিস্ট্রেশন করেন।
এখন বলি তার প্রতিষ্ঠান কেন সুদ নিত বা নেয়। তার প্রতিষ্ঠিত সরকার নিয়ন্ত্রিত গ্রামীণ ব্যাংকে এখনো সুদের হার বাংলাদেশে সর্বোচ্চ তো নয়ই, মাঝারিও নয়। একটি প্রতিষ্ঠান যদি ব্যবসায় করে বা টাকা ইনভেস্ট করে, সেই প্রতিষ্ঠান বা মানুষ মিনিমাম লাভের ব্যবস্থা না করলে প্রতিষ্ঠান চলবে? একজন মানুষ ব্যবসায় করবে; অথচ সেখান থেকে নিজে কোনো লাভ করবে না, এটি কেউ করে? আপনি যে ব্যাংকে এফডিআর করেন, ডিপিএস করেন এসবে শতকরা হারে লাভ নেন না? ব্যাংকে কোনো অ্যাকাউন্ট নেই এমন মানুষ ক’জন আছেন? আর তবুও ধরেই নিলাম,আপনি ধোঁয়া তুলসী পাতা কিন্তু এরকম কয়জন ধোঁয়া তুলসী পাতার অস্তিত্ব এ দেশে আছে! সুতরাং মিনিমাম লাভ প্রতিষ্ঠান নিয়েছে, সেটায় ব্যক্তি ইউনূসের শেয়ার না থাকায়, লাভের অংশ তিনি সিম্পলি পাননি। এখন আপনাদের মনে প্রশ্ন থাকতে পারে, ড. ইউনূস এত ভালো মানুষ হলে তার নামে মামলা দেয়া হলো কেন? সেই মামলা কতটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, কতটা প্রতিহিংসাপরায়ণ, কতটা রাজনৈতিক, বাংলাদেশের মানুষের জোচ্চুরির তুলনায় কতটা ছোট নাকি বড় মামলা সেসব বিষয় নিয়ে অন্য একটি লেখায় আলোচনা করব।
এবার ড. ইউনূসের Three zero theory নিয়ে একটু আলাপ করি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি বিশ্বের কাছে ‘ড. ইউনিভার্স’ নামে পরিচিত, তার মাইক্রোক্রেডিট ধারণার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে দারিদ্র্যবিমোচনে একটি বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন। এ কাজের জন্য তিনি ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। তবে তার অবদান এখানেই শেষ নয়। ২০১৭ সালে প্রকাশিত তার বই ‘A World of Three Zeros’ এ, ড. ইউনূস একটি নতুন এবং সাহসী ধারণা উপস্থাপন করেছেন, যা তিনি ‘থ্রি জিরো’ থিওরি নামে পরিচিত করেছেন। এ থিওরি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য নিয়ে গঠিত : Zero Poverty, Zero Unemployment এবং Zero Net Carbon Emissions । এ ধারণা বাস্তবায়িত হলে এটি আবারো ড. ইউনূসকে নোবেল পুরস্কারের মঞ্চে নিয়ে আসতে পারে, কেননা এই থিওরি আমাদের বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর সমাধান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। Zero Poverty: দারিদ্র্যের অবসান ড. ইউনূসের Three Zeros থিওরির প্রথম লক্ষ্য হলো Zero Poverty, অর্থাৎ দারিদ্র্যের সম্পূর্ণ অবসান। তিনি বিশ্বাস করেন যে দারিদ্র্য কেবল অর্থনৈতিক সমস্যার ফল নয়; বরং এটি একটি সামাজিক সমস্যা যা সঠিকভাবে সমাধান করা সম্ভব। মাইক্রোক্রেডিট ধারণার মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন যে, কিভাবে ছোট ঋণ মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে পারে। এ মডেলটি দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য কার্যকর একটি উপায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ড. ইউনূস এখন আরো বড় পরিসরে এ ধারণাকে প্রসারিত করতে চান, যাতে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের সম্পূর্ণ অবসান সম্ভব হয়।
থ্রি জিরো থিওরির দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো Zero Unemployment, অর্থাৎ বেকারত্বের সম্পূর্ণ অবসান। ড. ইউনূস বিশ্বাস করেন, প্রত্যেক মানুষের কর্মসংস্থান একটি মৌলিক অধিকার এবং এ অধিকার নিশ্চিত করার জন্য তিনি সোশ্যাল বিজনেস মডেলগুলোর ওপর জোর দেন। এসব মডেল লাভের পরিবর্তে মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হয়, যা কর্মসংস্থান তৈরি করতে সহায়ক। ড. ইউনূস মনে করেন, এসব মডেল যদি বৈশ্বিকভাবে গৃহীত হয়, তা হলে বিশ্বের সব মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। Three Zeros সর্বশেষ লক্ষ্য হলো Zero Net Carbon Emissions, অর্থাৎ কার্বন নিঃসরণকে সম্পূর্ণভাবে শূন্যের ঘরে নামিয়ে আনা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে আমাদের গ্রহকে রক্ষা করতে হলে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস একটি জরুরি পদক্ষেপ। ড. ইউনূস বিশ্বাস করেন, সোশ্যাল বিজনেস মডেলগুলোর মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগগুলোর প্রসার ঘটানো সম্ভব, যা কার্বন নিঃসরণ কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। যদি এসব মডেল বৈশ্বিকভাবে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমিয়ে পৃথিবীকে একটি সবুজ ও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
ড. ইউনূসের থ্রি জিরো থিওরি আমাদের সময়ের জন্য একটি প্রয়োজনীয় সমাধান হিসেবে দেখা যেতে পারে। তার এই সাহসী ও প্রয়োজনীয় ধারণা বিশ্বকে একটি নতুন পথে নিয়ে যেতে পারে, যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ, দারিদ্র্যমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব পৃথিবী সম্ভব হবে। ড. ইউনূস তার কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন, মানবতার কল্যাণে কাজ করতে ইচ্ছুক একজন ব্যক্তি কতটা প্রভাব ফেলতে পারেন।
আমাদের দেশের অনেকেই হয়তো জানেন না, তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ও অসামান্য অবদানে রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি একটি নাগরিক কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং অন্য বাংলাদেশীদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সমর্থন সংগ্রহ করতে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার পরিচালনা করেন। পাশাপাশি ন্যাশভিলের তার বাড়ি থেকে ‘বাংলাদেশ নিউজলেটারও’ প্রকাশ করতেন। এ ছাড়া জনমত গঠনেও অন্যতম ভূমিকা রাখেন। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৮৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার পান।
আমার বলতে দ্বিধা নেই, আমরা ভালো-মন্দ মিলিয়েই মানুষ। তবে ব্যক্তি আমার উপলব্ধিতে উনার ভালোর পাল্লা ভারী। উনি যা কিছু অর্জন করেছেন বা দেশকে দিয়েছেন বা দিচ্ছেন তা নিয়ে আমার গর্ব হয়। আমি গর্ব করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ব্যাচমেট, বিদেশী বন্ধু এবং জার্মানদের সাথেও কথা বলেছি ওরা বাংলাদেশের ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ভালোভাবে চেনে।
আপাতত আমরা দেখতে উদগ্রীব, ড. ইউনূস সাহেব উনার মেধা, প্রজ্ঞা ও ব্যবসায়িক মাইন্ড সেটআপ ব্যবহার করে এ দেশটিকে কতটা সমৃদ্ধ করতে পারেন। আমি আশাবাদীদের কাতারে। আপনারা নিরাশা ছড়াতে থাকেন কিন্তু যোগ্য মানুষটিকে নিয়ে অপমানমূলক, উদ্ভট প্রচারণা দয়া করে চালাবেন না, এসবে নিজের মেধার ও বুদ্ধি-বিবেচনার দীনতাই প্রকাশ পায়। একটি কথা বলা জরুরি, যে সমাজে জ্ঞানের প্রতিযোগিতা হয় না, জ্ঞানীকে জ্ঞানী বলতে উৎসাহিত করা হয় না, সে সমাজে জ্ঞানচর্চার কাঠামো এমনভাবে গড়ে ওঠে- যেন জ্ঞানের চেয়ে জ্ঞানের ছদ্মবেশকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়।
পুনশ্চ: ১৯৮০ সালের শেষের দিকে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও আবেদ সাহেব বিভিন্ন প্রাইভেট প্রোগ্রাম করতেন, একবার তাদের একটি প্রোগ্রামে আহমদ ছফা আমন্ত্রিত ছিলেন, তো প্রোগ্রামে ড. ইউনূস তার সফলতার গল্পগুলো শোনালেন। একটা পর্যায়ে তাকে আহমদ ছফা প্রশ্ন করলেন, ইউনূস আমরা তো আপনার সফলতার গল্প শুনেছি এখন আপনার ব্যর্থতার গল্প শোনান। ইউনূস তার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললেন, আমার কোনো ব্যর্থতার গল্প নেই।
লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক, গবেষক, ফ্রাই ইউনিভার্সিটি বার্লিন
Email : sahidsams7@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement